আজ মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িক করে বাংলাদেশ যখন অন্ধকার কবরে

ভায়লেট হালদার  

গত বছর জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি ঢাকা প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ চোখে পড়ল বেশ কিছু পায়জামা পাঞ্জাবী, মুখে দাড়ি আর মাথায় টুপি পরিহিত বেশ কিছু মানুষ ঠেলাঠেলি করে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়েছে। পরে বুঝতে পারলাম এরা ইসলামিক রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত। স্বভাবসুলভ কৌতূহলী চোখ নিয়ে আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। তারা একটি ব্যানার টানিয়েছে, তাতে লেখা আছে পাঠ্যপুস্তক থেকে হিন্দু লেখকদের লেখা বাতিল কর। সরকারের প্রতি আল্টিমেটাম জানাচ্ছে তারা। হঠাৎ তারা কেন নামল এমন পথে? আমার এক শ্রদ্ধেয়জন বড় ভাই তপংকর চক্রবর্তী তপুদার কথা মনে এলো। কোন এক আড্ডায় ‘হিন্দু ও মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ টপিকের আলোচনায় উনি টেবিল চাপড়ে বলেছিলেন, ‘লেখক, কবি, সাহিত্যিকের আলাদা কোন জাত আছে নাকি!’ হায় দাদা, এখন এই মুহূর্তে যদি আপনি আমারই সাথে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে উপস্থিত থাকতেন তবে আপনি এভাবে টেবিল চাপড়ে এদের বলতে পারতেন? প্রশ্নটা মাথায় খেলে যায় বারবার। পরে এই বিষয় নিয়ে অনেকবার আলোচনা হয়েছে আমাদের নিজেদের মধ্যে।

গত বছর হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট সংবাদ সম্মেলন করে পাঠ্যবই ‘সংশোধনে’র দাবি করে, অবিলম্বে পাঠ্যবই সংশোধন না হলে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছিলো কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড। কিন্তু আমি আজও বুঝতে পারিনি যে কেন কি কারণে হিন্দু লেখকের লেখা বাতিল করতে চেয়েছিল। অন্য ধর্মের কবি-লেখক সাহিত্যিকেরা কি খুব খারাপ কিছু লিখেছে যা নীতিহীন ও অবশ্যই বর্জনীয়! এরা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার জন্য ভালো সমালোচনা করে যাবেন, এটা তাদের পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত অধিকার। বেশ কিছুদিন ধরেই সংবাদপত্রগুলো তুলে ধরছে ইসলামিক চিন্তাবিদ ও রাজনীতিদের বয়ান। আজ পত্রিকায় একই বিষয়ে আরেকটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদ শিরোনাম: পাঠ্যবই থেকে সরে যাচ্ছে অমুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের নাম।

বাংলাদেশ সরকার বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দেয়, এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ও একটি ভাল উদ্যোগ। এ বছর আদিবাসী সম্প্রদায়ের শিশুদের নিজ মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক দিয়েছে সরকার। তবে ২০১৭ সালে পাঠ্যবইয়ে অমুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের লেখা বাদ দিয়ে ইসলামী ভাবধারার লেখা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নবম শ্রেণির বাংলা বই মাধ্যমিক বাংলা সাহিত্য থেকে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’ ও জ্ঞানদাসের ‘সুখের লাগিয়া’, ভরতচন্দ্রের ‘আমার সন্তান’, লালন সাঁইয়ের শাহের ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতা’ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকোটা দুলছে’ বাদ দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে শাহ মোহাম্মদ সগীরের ‘বন্দনা’, আলাওলের ‘হামদ’, আব্দুল হাকিমের ‘বঙ্গবাণী’, গোলাম মোস্তফার ‘জীবন বিনিময়’ ও কাজী নজরুল ইসলামের ‘উমর-ফারুক’। অষ্টম শ্রেণির বাংলা দ্রুতপঠন আনন্দপাঠ থেকে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘রামায়ণ-কাহিনী’, সপ্তম শ্রেণির বাংলা বই সপ্তবর্ণাতে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘লাল ঘোড়া’ বাদ দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে হবীবুল্লাহ বাহারের ‘মরু ভাস্কর’। এছাড়াও ষষ্ঠ শ্রেণীর দ্রুতপঠন আনন্দপাঠ থেকে শরৎচন্দ্রের ‘লালু’ ও সত্যেন সেনের ‘লাল গরুটা’ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ বাদ দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, তৃতীয় শ্রেণির হিন্দু ধর্ম বইয়ের পেছনে টুপি জুব্বা পড়া এক বালকের ছবি আছে। তার নিচে বড় বড় অক্ষরে লেখা, "Do not heart anybody" যখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি Heart / Hurt এর তফাত বোঝে না? নাকি শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলতে চেয়েছেন, কাউকে হৃদয় দিও না অথবা কাউকে কষ্ট দিও না, কোনটা? ধর্ম বইয়ে ইংলিশে বাক্য লেখার প্রয়োজনীয়তা কি? অন্যান্য ধর্ম বইগুলোতেও কি আরেক ধর্মের ছবি দেয়া আছে? যেমন ইসলাম ধর্মের বইয়ে হিন্দু, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ ধর্মের কোন ছবি যদি না থাকে তবে কেন একটি বিশেষ ধর্মের প্রচার ও সুকৌশলে শিশু মস্তিষ্কে বিশেষ ধর্মের প্রতি প্রীতি ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ গেঁথে দেয়া হচ্ছে?

এছাড়াও কয়েকদিন আগে আমরা সংবাদ মাধ্যমে জানতে পেরেছি প্রথম শ্রেণীর পাঠ্য বইয়ে ‘ও-তে ওড়না’ বিতর্ক ভাইরাল হয়েছিল। তখন এদেশের মানুষ প্রতিবাদ করে আরেকবার প্রমাণ করেছিল আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি অসাম্প্রদায়িক।

শিশুপাঠ্য থেকে হারিয়ে গেছে সীতানাথ বসাকের রচিত ‘আদর্শ লিপি।’ ওটাই ছিল আমার প্রথম বই এবং ওর পাশাপাশি রামসুন্দর বসাকের ‘বাল্যশিক্ষা’ নামে আরো একটি বই ছিল। তখনও আদর্শ ও লিপি শব্দের অর্থ বুঝতাম না এবং এর যে একটা মানে থাকতে পারে তাও ভাবার মত বয়স তখনও হয়নি। আর লেখার জন্য হাতেখড়ি হয়েছে সিলেট ও পেন্সিলে। একটা অ ও আ কেউ লিখে দিলে তার উপর হাত ঘুরিয়ে সবেমাত্র লিখতে শিখছি; তখন আদর্শ লিপির সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটে। বাড়ির বড়রা কেউ পড়ে শোনাত; শুনে শুনে মৌখিক পড়া শুরু হল; বইটিতে অ- অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করো, আ- আলস্য দোষের আকর, ই- ইক্ষু রস অতি মিষ্ট, ঈ- ঈশ্বরকে বন্দনা করো... । পড়তে পড়তে নানান প্রশ্নের জন্ম, শব্দের অর্থ বুঝতে শেখা, বাক্য গঠন, এসবই শিখতে শুরু করলাম। কখনো কারো মুখে শুনিনি এই আদর্শ লিপি বই পড়া যাবে না, এই বইয়ের লেখক হিন্দু বা বিধর্মী। বরং ঐ সময়ে সকল শিশুদেরই পাঠ্য ছিল এই সীতানাথ বসাকের ‘আদর্শ লিপি ও সরল বর্ণ পরিচয়’ ব্যাপকভাবে সমাদৃত ও জনপ্রিয় একটি শিক্ষামূলক বই। সীতানাথ বসাক এর ‘আদর্শ লিপি’ এখন ঘরে ঘরে দেখা না পাওয়া গেলেও কিনতে পাওয়া যায়। জনপ্রিয়তা হারিয়ে কোন রকমে টিকে আছে। নতুন বেশ কিছু সংযোজিত হয়েছে, তারপরও অনেক মিল আছে যা আমাদের শিশুদের জন্য অপরিহার্য ও শিশুদের চরিত্র গঠনে সহায়ক। বর্তমানে সীতানাথ বসাকের আদর্শ লিপি বর্ণ পরিচয় বইটিতে যা লেখা আছে: অ = অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করো। আ = আলস্য দোষের আকর। ই = ইন্টারনেট বিজ্ঞানের চমক। ঈ = ঈশ্বরকে বন্দনা করো। উ = উগ্রভাব ভালো নয়। ঊ = ঊর্ধ্বমুখে পথ চলো না। ঋ = ঋষিবাক্য শিরোধার্য। এ = একতা সুখের মূল। ঐ = ঐশ্বর্য রক্ষা করা কঠিন। ও = ওষধি ফল পাকলে মরে। ঔ = ঔদার্য অতি মহৎ গুন। ক = কটুবাক্য বলা অনুচিত। খ = খলকে বিশ্বাস করো না। গ = গর্ব করা ভালো নয়। ঘ = ঘন মেঘে বৃষ্টি হয়। চ = চন্দ্রকিরণ অতি স্নিগ্ধ। ছ = ছলনা করা বড় দোষ। জ = জনক-জননী অতি পূজ্য। ঝ = ঝগড়া করলে বিপদ ঘটে। ট = টাকার অহংকার ভালো নয়। ঠ = ঠকের বাক্য অবিশ্বাস্য। ড = ডুমুর ফুল দেখা যায় না। ঢ = ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। ত = তপস্বীরা বনে থাকেন। থ = থপ থপ করে ব্যাঙ চলে। দ = দরিদ্রকে অন্ন দান করো। ধ = ধর্মপথ অবলম্বন করো। ন = নম্র হতে চেষ্টা করো। প = পণ্ডিত লোক সভার প্রিয়। ফ = ফল দ্বারা বৃক্ষের পরিচয় হয়। ব = বন্ধুর হিত করা কর্তব্য। ভ = ভগ্নোৎসাহ হইও না। ম = মন দিয়ে বিদ্যাভ্যাস করো। য = যত্ন করলে রত্ন মিলে। র = রবির কিরণ অতি প্রখর। ল = লম্ফ দিয়ে পথ চলিও না। শ = শঠকে বিশ্বাস করো না। ষ = ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। স = সৎ পুত্র কুলের ভূষণ। হ = হঠকারিতা বড় দোষ। ক্ষ = ক্ষমা প্রদর্শন দেব ধর্ম।

আজকাল শিশুদের জন্য প্রথম পাঠ ও শিক্ষামূলক বইয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে বিচিত্র সব বই যা মেধা বিকাশে সহায়ক নয়। এসব বই পড়ে শিশু মানবিক গুণাবলীর সহিত বেড়ে উঠতে পারে না। নীতি ও আদর্শ বহির্ভূত শিশুর মনস্তত্ত্ব উপেক্ষিত এসব শিক্ষামূলক বই নিয়ে আমাদের শিশুদের মেধা ধ্বংসের অন্যতম যন্ত্র বলা যায়। বাংলা ভাষায় সমার্থক শব্দ কিন্তু বহুল প্রচলিত নয় বা অপ্রচলিত শব্দ দিয়ে বাক্য তৈরি যৌক্তিকতা কি! তাও আবার শিশু শ্রেণির জন্য। 'বর্ণ দিয়ে শব্দ গঠন ও শব্দ দিয়ে ছড়া গঠন' বইটিতে অনেক ভুল বানান ও কঠিন কিছু শব্দ ও এমন কিছু বাক্যের ব্যবহার করা হয়েছে যা সকল বাচ্চাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। একটি দেশে বিভিন্ন ধর্মের ও বর্ণের মানুষ বাস করে। সেখানে একটি বিশেষ ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে বাক্য গঠন করা হয়েছে; এসব বাক্য শিখিয়ে শিশুদের কোন শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা হবে? যারা মনে করেন, তাদের বাচ্চারা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করবে তারা তাদের সন্তানকে বিশেষ স্কুলেই পাঠাতে পারে এবং সে ব্যবস্থাও বাংলাদেশে আছে তবে কেন সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি বিশেষ ধর্মের ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হচ্ছে সকল শিক্ষার্থীর জন্য? হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের বিশেষ ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে বাধ্য করা হচ্ছে না কি? এসব শিক্ষা কি অন্য ধর্মের প্রতি অনীহা ও বিদ্বেষ প্রকাশ করে না? যেমন: অ - অজু, অন্যায়, অভিশাপ, অহংকার। অজু করে নামাজ পড়, আল্লাহর নামে জিকির করো। হবে খাঁটি মুসলমান, সবই যে তাঁরই দান। আ - আল্লাহ, আদর্শ, আব্বা-আম্মা, আদেশ। আল্লাহর পরে হযরত মুহম্মদ, সৎ আদর্শ তিনি মোদের, আব্বা-আম্মা তাঁহার পরে, আদেশ মানব তাদের। ঈ - ঈদ, ঈমানদার, ঈর্ষা, ঈদগাহ। ঈদের দিনের খুশী দেখ, ঈমানদার সব ভাই ভাই। ঈর্ষা সবে দূর করিয়া ঈদগাহতে যাই। এ - এক, এলমেদ্বীন, একতা, এক হওয়া। এক আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা, এলমেদ্বীন কুরআন। একতাই সুখের মূল, এক হও মুসলমান। ও - ওজন, ওদন, ওলামা, ওড়না। ওজন দিব সঠিকভাবে, ওদন খাবো ক্ষুধায়। ওলামা সাহেব ওয়াজ করেন, ওড়না দাও মাথায়।

স্বরবর্ণ এগারটি বর্ণের পাঁচটির বর্ণের মধ্যে ব্যবহার করা হয়েছে একটি বিশেষ ধর্মের সংস্কৃতি ও অবশ্যই পালনীয় বাক্য। যা শুধুমাত্র ও ধর্মের অনুসারীরাই মানতে বাধ্য। অন্যান্য ধর্মের মানুষেরা নয়। এলমেদ্বীন বিজাতীয় শব্দ, বাংলা শব্দ নয়। শিশু শ্রেণীর বাংলা পাঠ্য বইয়ে বিদেশী শব্দ যা বিশেষ একটি ধর্মকে প্রদর্শন করে তা শেখানোর যুক্তি কি! শিক্ষা সার্বজনীন যা সকল শিশুর জন্য প্রযোজ্য নয়, এমন শিক্ষামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা সমাজে প্রচলিত থাকলে বৈরী সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে শিশু বেড়ে উঠবে। যার ক্ষতিকর প্রভাব সমাজে পড়বেই। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক, এই দেশে বিভিন্ন ধর্মের ও বর্ণের মানুষ বাস করে। মানুষে মানুষে ভাতৃত্ববোধ গড়ে তুলতে অসাম্প্রদায়িক ও নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই। পাঠকেরা ভেবে দেখবেন। 'ঈমানদার সব ভাই ভাই, এক হও মুসলমান' - এ বাক্যটি একটি বিদ্বেষমূলক বাক্য। সকল মানুষ কেন ভাই ভাই নয়? মানুষ হইতে মুসলমানেরা কি ভিন্ন? নাকি মুসলমানেরা মানুষ বাকী ধর্মের সবাই অমানুষ! এরপরে আসি, ‘ওদন’ শব্দটি বাংলাদেশের কোন মানুষ শুনেছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ক’জন মানুষ জানে বা বলতে পারবে ‘ওদন’ শব্দের অর্থ! ‘ওদন’ মানে ‘অন্ন’ বা ‘ভাত’ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত একটি শব্দ যা বলতেও আমরা অভ্যস্ত। ‘ভাত’ বা ‘অন্ন’ শব্দ ব্যবহারে এত অনিহা কেন? শিশু শ্রেণিতে ‘অন্ন’ বা ‘ভাত’ শব্দ বাদ দিয়ে ‘ওদন’ শব্দটি ব্যবহারের দরকার হল কেন? আর শিশুদের ওড়না মাথায় দেবার দরকার কি? আমাদের সংস্কৃতি অনুযায়ী বিবাহিতা নারীরা ঘোমটা মাথায় দেয় শ্বশুর বাড়িতে এবং মুরুব্বীদের সামনে, শিশুরা নয়। এ ছাড়াও আছে: ঐ তে ঐরাবত টানে গাড়ী। ঐরাবত মানে হাতি। হাতি কি কখনো গাড়ী টানে? ঔ তে ঔদরিকের অসুখ হল, ঔষধ দেখ খায়। ঔদ্বত্য ছেড়ে তিনি এখন, ঔদার্য হতে চায়।' ‘ঔদরিক’ মানে পেটুক। পেটুকের সাথে ‘ঔদ্বত্য’ ও ‘ঔদার্য’ শব্দের সম্পর্ক কি? ‘ঔদরিক’, ‘ঔদ্বত্য’ ও ‘ঔদার্য’ শব্দগুলোর উচ্চারণ ও ব্যবহার শিশুর জন্য সহজ কি?

ব্যঞ্জনবর্ণের মাত্র কয়েকটি বর্ণ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছি, ক – কালেমা পড়ে মুসলমান হবো, কাফের নাহি থাকবো। কোরআনের বিধান মান্য করে কামেল মুমীন হবো। খ – খাবার খাবো বিসমিল্লাহ পড়ে, খাদক নাহি হবো, খালি মাথায় ভাত খাবো না, গরীবের খোঁজ নেবো। ঘ – ঘর থেকে বাঁচতে সুজন ঘুষ নাহি খায়, ঘোমটা মাথায় সতী নারী ঘরের বাইরে যায়। ছ – ছোয়ালাত কবুল হবে না কভু ছবিওয়ালা ঘরে, ছোয়াব দিবেন মহান প্রভু ছবর রাখলে ঘরে। ঞ – ঐ দেখো কষ্টে আছে, পিঠে বোঝা লইয়া, ঞ এবার হইলো খুশী মিঞা সাহেব হইয়া। ট -টুপি পড়া নবীর সুন্নত, টাকার বড়াই হারাম। টাখনুর উপর কাপড় পরে টংগী ওয়াজ শুনলাম।

‘কালেমা পড়ে মুসলমান হবো, কাফের নাহি থাকবো। কোরআনের বিধান মান্য করে কামেল মুমীন হবো।‘ ষোল কোটি মানুষের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সব ধর্মের শিশুরাও একই স্কুলে যায়, একই পাঠ্যবই পড়ে। সেখানে ‘কাফের’ শব্দটি ব্যবহার মানেই শিশুদের মাথায় সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। সকল ধর্মের শিশুরা ‘বিসমিল্লাহ’ বলে খাবার খাওয়া কেন শিখবে? যে নারী মাথায় ঘোমটা দেয় না সে কিভাবে অসতী হয়! ‘সতী’ শব্দটি নারীর জন্য চরম অবমাননাকর একটি শব্দ। ছবি ঘরে রাখলে ছোয়ালাত কবুল হবে না। ‘ছোয়ালাত’ কি বাংলা শব্দ? বাংলা বর্ণমালা শেখার বইয়ে কেন আরবি শব্দ? কি উদ্দেশ্যে ঢোকানো হয়েছে? সব মিঞারা কি সুখে আছে? ‘টাখনু’ কি বাংলা শব্দ? এসব অবাস্তববাদী শিক্ষা শিশুদের উচ্ছন্নে যেতে উৎসাহিত করে। পাঠকেরা ভেবে দেখবেন, কি শিখছে আমাদের সন্তানেরা?

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার এবং শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। যে শিক্ষা শিশুর মেধার বিকাশ ঘটিয়ে আত্মশক্তি যোগায় না, মানবিক গুণাবলী অর্জনে সহায়ক নয়, সে শিক্ষা অবশ্যই বর্জনীয়। নয়তো আমাদের সন্তানেরা হিতাহিতবোধ ও নীতিবাক্য ভুলে হয়ে উঠবে হিংস্র মানব যা আপনার, আমার ও পুরো সমাজের জন্যই ক্ষতিকর। আমাদের অসতর্কতাই বয়ে আনবে আমাদের সন্তানের জন্য কালরাত্রি। এসব বাক্য শিশুরা বুঝতে অক্ষম। উদ্ভট তথ্য, গল্প, ধর্মীয় ভাবাদর্শ শিশুদের মস্তিষ্কে গেঁথে দিয়ে শিশুদের তৈরি করছে নেতিবাচক মানুষ।

শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি হয় সাম্প্রদায়িক মনোভাব লালন-পালন তবে এ শিক্ষা ব্যবস্থাই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে অন্ধকার কবরে শুইয়ে রাখবে।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৪ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ