প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ | ০৩ অক্টোবর, ২০১৭
আমাদের দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই হলো শিশু। সেই শিশুদের এক বিরাট অংশ শিশুশ্রমের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। যে কারণে আমাদের আগামীর ভবিষ্যতের মধ্যে অধিকাংশই স্বাক্ষরজ্ঞানহীন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। পাশাপাশি একটা বড় অংশ বাবা-মায়ের চাপিয়ে দেয়া বিষয় নিয়ে পড়তে পড়তে ক্লান্ত। অথচ তারা চায় নিজের মতো করে পড়ালেখা করে বড় হতে, প্রতিষ্ঠিত হতে, দেশ গড়তে। চাওয়া-পাওয়ার এ সংকটাবদ্ধ আমাদের বাংলাদেশ, আমাদের বিশ্ব।
অথচ শিশুদের এই বিষয়টি নিয়ে বিশ্ব সভ্য সমাজের সদস্য হিসেবে সচেতন হওয়া প্রয়োজন ছিল। আমরা সচেতন না হলেও বিশ্ব সচেতন। বিশ্বের শীর্ষস্থান থেকে ১৯৮৯ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শিশু অধিকার সনদ গৃহীত হয়। এ সনদে স্বাক্ষরকারী ২২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তারপর থেকে এ সনদ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ কারণে ১৯৯৪ সালে সরকার ‘মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ গঠন করেছে। ওই একই বছর জাতীয় শিশুনীতি গ্রহণ করেছে। তারপর থেকে এ মন্ত্রণালয় ও শিশু একাডেমি শিশু অধিকারের বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছে। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিবছর অক্টোবরের প্রথম সোমবার ‘বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ’ পালন করা হয়। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো ‘শিশু পেলে অধিকার, খুলবে নতুন বিশ্বদ্বার’। প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলাদেশ শিশু একাডেমি কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ ৬৪টি জেলা ও ৬টি উপজেলায় বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ-২০১৭ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। আগামী ১১ অক্টোবর থেকে ১৭ অক্টোবর ২০১৭ পর্যন্ত ৭ দিনব্যাপী সারাদেশে শিশু অধিকার সপ্তাহ উদযাপন করা হবে।
বাংলাদেশ মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমির উদ্যোগে ও ইউনিসেফের সহযোগিতায় এ সপ্তাহটি পালন করা হয়। অধিকাংশ দেশে ১ জুন শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯২৫ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক বিশ্ব সম্মেলনে এ দিবসটির জন্ম হয়। তবে এটা এখনো স্পষ্ট নয় কেন ১ জুন আন্তর্জাতিক শিশু দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেলো। অনেকেরই ধারণা, এ ব্যাপারে চীনাদের একটা ভূমিকা আছে। কারণ হিসেবে তারা বলেন, একবার আমেরিকার সানফ্রানসিসকোতে চীনের এক রাষ্ট্রদূত তার দেশের বেশ কিছু এতিমদের নিয়ে এক উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। এ উৎসবের নাম ছিল ‘ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল’। কাকতালীয়ভাবে দিনটি ছিল ১৯২৫ সালের ১ জুন। শুধু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে ১ জুন শিশুদিবস হিসেবে পালনের রেওয়াজ দেখা যায়।
অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে এ দিন শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। অন্যদিকে জাতিসংঘ ও ইউনেস্কো ২০ নভেম্বর বিশ্বজনীন শিশু দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর সারাবিশ্বে শিশুদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ পর্যবেক্ষণ করা হয় এ দিবসটিতে। তবে শিশু দিবস পালনের ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি দেশ নিজস্ব দিন নির্ধারণ করলেও একটা জায়গায় সবারই মিল আছে। সেটা হচ্ছে, সব দেশই তার শিশুদের নিয়ে চিন্তা করে। সব দেশই শিশুদের সমাজের সুন্দর ও মূল্যবান সম্পদ মনে করে। শিশুকেন্দ্রিক একমাত্র মানবাধিকার দলিল ‘শিশু অধিকার সনদ’র যাত্রা শুরু ১৯৯০ সালে। কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড বা সিআরসি নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত ৫৪টি অনুচ্ছেদ সংবলিত শিশু অধিকার সনদে বিশ্বের সব শিশুর নাগরিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সনদের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শিশু অধিকার সনদ গৃহীত হয়, যা ১৯৯০ সালের।
আমাদের দেশে একদিকে পালিত হয় বিশ্ব শিশু দিবস অন্যদিকে আমাদের শিশুরা বন্দি হয় শিশুশ্রমের কারাগারে। কথায় কথায় বলা হয় আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ; বলা হয় আজকের শিশুই আগামীর রাজনীতিক, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, কলামলেখক, সাংবাদিক, সম্পাদক, আইনজীবী, সমাজসেবক, শ্রমিক ও কৃষক। সেই শিশুদের মেধার বিকাশের প্রধান অন্তরায় বাবা-মায়ের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত। বড় হলে তুমি ডাক্তার হবে। বাবার এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হয়তো সে মুখে কোনও কথা বলে না। কিন্তু মনে মনে আঁকে বিদ্রোহের ছবি। যে কারণে সন্তান বড় হয়ে আর ভালো কিছু করতে পারে না। কারণ তার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে সে বড় বিজ্ঞানী হবে। এভাবে ধাপে ধাপে তারা তাদের প্রতিভা বিকাশে বাধার সম্মুখীন হয়। আর আমরা হারাই আমাদের আগামীর কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-রাজনীতিক। তা যেন না হয়, এ জন্য সন্তানের বড় হয়ে প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে কোনও অন্ধকার আমাদের ডেকে আনা ঠিক হবে না।
আমাদের উচিত হবে, এ ভবিষ্যৎ প্রবক্তাদের চোখে-মুখে আমরা আলোর রেণু এঁকে দেয়া। তাদের উপযোগী পৃথিবী আমাদের গড়ে দিতে হবে। তাদের বেড়ে উঠতে দিতে হবে অনুকূল পরিবেশে। আর আমরা যদি তাদের সেই শিশুবান্ধব পরিবেশ উপহার দিতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমরা যতো স্বপ্নই তাদের ঘিরে দেখি না কেন, সব বরবাদ হয়ে যাবে, যা আমরা অবশ্যই কখনো চাইবো না।
একটি শিশুর চোখে সব সময় সব ধরনের সম্ভাবনার বারুদ ফিনকি দেয়। সেই বারুদে কেবল আগুন ঢেলে দিতে হবে, যাতে তারা তাদের মেধা ও মননকে সঠিক জায়গায় নিয়ে লালন-পালন করতে পারে। মানুষের মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা- এ ৫টি বিষয়কে যদি আমরা পুরোপুরিভাবে শিশুদের জন্য নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে আমরা যা চাই তা পাওয়াটা বোধ করি খুব কঠিন হবে না।
আমাদের এ স্বাধীন স্বপ্নময় বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও এ সমাজে শিশুশ্রমের ব্যাপক বাজার রয়েছে। শিশুদের সহজে ঠকানো যায়, চোখ রাঙানি দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করিয়ে নেয়া যায় বলে কোনও কোনও ক্ষেত্রে শিশুদের নিয়োগের ব্যাপারে দারুণভাবে উৎসাহিত হতে দেখা যায়। এটা যে কতোটা গর্হিত কাজ তা সচেতন মানুষ মাত্রেই বুঝবেন। এ মানসিকতা আমাদের যতদিন না বদলাবে ততদিন শিশু অধিকারের সব বিষয়ই সূক্ষ্মভাবে লঙ্ঘিত হতে থাকবে। আর এ শিশুশ্রমের ব্যাপারে বলা হচ্ছে; ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সের শিশুদের বেতন, মুনাফা বা বিনাবেতনে কোনও পারিবারিক খামার, উদ্যোগ বা সংস্থায় কাজের জন্য নিয়োগ করা শিশুশ্রমের আওতায় পড়বে।
অর্থনৈতিক টানাপড়েনে বেশিরভাগ পরিবারকে তাদের সন্তানদের উপার্জনমূলক কাজে জড়িত করে থাকে। ১৫ বছরের নিচে বিশ্বের প্রায় ১০ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ১৫০ মিলিয়ন শিশু বিভিন্ন পেশায় যুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু পেশা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এসব কর্মজীবী শিশুর বেশিরভাগই চরম দারিদ্র্য ও বঞ্চনার মধ্যে বড় হয় এবং বেঁচে থাকে। তারা উন্নত জীবনের জন্য শিক্ষাগ্রহণ ও দক্ষতা উন্নয়নের কোনও সুযোগ পায় না।
আমাদের দেশে ৫ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের ঘরে, মাঠে এবং কারখানায় কাজ করতে দেখা যায়, যা অনেকটা বিনা বেতনেই বলা চলে। বেতন মিললেও তা অতি সামান্য। কেউ কেউ পেটে-ভাতেই সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। এখানে নানা সভা-সেমিনারে শিশু অধিকারের কথা বলা হলেও বিষয়টিতে প্রকৃত অর্থে সামান্যই গুরুত্ব দেয়া হয়। শিশু অধিকারের অব্যাহত অপব্যবহার এবং লঙ্ঘন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘনবসতি, সীমিত সম্পদ এবং ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে এবং এ অবস্থায় শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
শিশুরক্ষায় আইন আছে। তার সঠিক প্রয়োগই পারে আমাদের কোমলমতি শিশুদের সব অধিকার নিশ্চিত করতে। আমরা সবাই রাজা, আমাদের এ রাজার রাজত্বে... সত্যি সত্যিই শিশুরা একেকজন রাজা। সেই রাজাদের রানীদের গড়ে দিতে হবে নিজের মতো চলার পরিবেশ। যাতে আগামীতে তার স্বপ্নগুলো পায় ঠিকানা। তারা যেন চাইলে হয়ে যেতো পারে ফড়িং, রঙিন প্রজাপতি, আকাশে-বাতাসের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা ঘুড়ি কিংবা সাদা তুলোর মতো মেঘ। সেই মেঘ থেকে একটুখানি বৃষ্টি ঝরিয়ে ভিজিয়ে দিতে পারো তুমি যে কাউকে। কেউ আসবে না তাকে বকা দিতে, টিচার চোখ রাঙিয়ে বলবে না, দুষ্টুমি করছ কেন, দুষ্টু কোথাকার। কোনও ভয় নেই, বাধা নেই, শাসন নেই যেহেতু তবে শুরু হোক আলোর জীবন। মেঘের কোলে হেসে উঠেছে রোদ, ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজিয়ে বাদল সাহেব মানে বৃষ্টি চলে গেছেন মেঘের দেশে, আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি/কি করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোথাই যে যাই...।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য