প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
চিররঞ্জন সরকার | ০৪ অক্টোবর, ২০১৭
চারপাশে অন্ধকার নেমে আসার পর ভেসে এলো কান্নার শব্দ। বয়স্ক ও ক্লান্ত এক নারী কণ্ঠের আহাজারি। এ শব্দের উৎস পরিত্যক্ত একটি ভবন। নির্জন রাতে এরকম মায়াবী কান্নার সুর সাহিত্য-সিনেমায় রহস্যের সৃষ্টি করে। হতে পারতো এটি একটি ভৌতিক গল্প, কিন্তু বাস্তবে এর পটভূমি পুরোটাই ভিন্ন। সম্প্রতি টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিত্যক্ত ভবন থেকে ভেসে আসা এ কান্না কাঁদিয়ে গেছে এলাকাবাসীকে। শব্দের উৎস ধরে রাতের অন্ধকারে ওই পরিত্যক্ত ভবনে গিয়ে এক বৃদ্ধাকে আবিষ্কার করেন প্রতিবেশীরা।
ওই রুগ্ণ বৃদ্ধা নারী জানান, তার নাম ময়মন বেগম। বয়সের হিসেবে শতক হাঁকিয়েছেন অনেক আগেই। দুই ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের জননী তিনি। ১৯৮৮ সালে বন্যার সময় মারা যান তার স্বামী। বছর দশেক আগে ছোট ছেলেটাও ক্যান্সারে মারা যায়। বড় ছেলে নয়েজ মিয়া। মাছের ব্যবসা করেন। একই বাড়িতে থেকেও মাকে দু’মুঠো ভাত পর্যন্ত দেন না তিনি। মেয়ে জয়ফুন বেগম। একই এলাকায় বিয়ে হয়েছে। তিনিও এখন বুড়ো মায়ের খবর নেন না। তাই টাঙ্গাইলের বাসাইল পূর্ব পাড়ার একটি ঝুপড়িতে থাকেন বৃদ্ধ ময়মন বেগম। কিন্তু সম্প্রতি বন্যার পানি ওঠায় নিজের ঘরটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন এ নারী। বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ায় তিনি এক আত্মীয়ের বাড়িতে যান থাকার জন্য। কিন্তু সন্ধ্যা নামার পরে আত্মীয়রা তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিত্যক্ত ভবনে ফেলে রেখে যায়।
বাসাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিত্যক্ত ভবনে সে সময় অবস্থান নেন বন্যাদুর্গত ঘরহারানো কয়েকজন মানুষ। সেখানেই ঠাঁই হয় ময়মন বেগমের। টাঙ্গাইলের একজন নাগরিক ময়মন বেগমকে নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা অনাহারে-অর্ধাহারে থাকা শতবর্ষী এ নারীর পাশে দাঁড়ান।কিন্তু ময়মন বেগমের শঙ্কা তাতে কাটে না!
ময়মন বেগম বলেন, ‘বেটা-বেটিরাই আমার খোঁজ নেয় না। আর ক্যারা খোঁজ নিব।’ এসময় আবেগঘন কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহ জানি কেউরে বুড়ি না বানায়। আমার বেটা-বেটিগো জানি আল্লাহ এতো বুড়া না বানায়। আমি নয় কোন রহমে চইল্যা গেলাম। ওগো পুলাপানের নিগ্যা ওগো এরহম অবস্থা অইলে অরা তো কুলাইব্যার পারবো না।’
ময়মন বেগমের অসংখ্য বৃদ্ধা-বৃদ্ধ আমাদের সমাজে রয়েছে। কিন্তু তাদের জন্য সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতা অথবা কোনও নিরাপদ আশ্রমের ব্যবস্থা আমাদের দেশে এখনও তেমনভাবে গড়ে উঠেনি। বিষয়টি নিয়ে গভীর ভাবনা-চিন্তা করা প্রয়োজন।
‘যত দিন বিত্ত উপার্জনে সমর্থ, তত দিনই অনুরক্ত পরিবার। অতঃপর জরা আসিয়া দেহ জর্জরিত করিলে কেহ কুশল জিজ্ঞাসাও করিবে না।’ ‘মোহমুদ্গর’ রচনায় আদি শংকরাচার্যের এই ছিল সতর্কবাণী। হাজার বছরেও সংসারের এই চিত্র বদলায় নি।
নগরজীবনে বয়স্কদের জন্য শুশ্রূষা ও পরিচর্যার চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজঘরে এমন সহায়তা আর সহজলভ্য নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমন সেবা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু আমাদের দেশে এই সেবা এখনও তেমনভাবে প্রসার লাভ করেনি। কিন্তু বাস্তবতা হলো: বয়স্কদের জন্য শুশ্রূষা ও পরিচর্যার চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এত দিন বৃদ্ধবৃদ্ধাদের পরিচর্যা পরিবারের, বিশেষত পরিবারের নারীদের উপর ন্যস্ত ছিল। কিন্তু উন্নত দেশগুলির পাশাপাশি এখন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও পরিবারের কাঠামো দ্রুত বদলাচ্ছে। বিশেষত শহরে। যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, নারীরা শিক্ষিত হয়ে বাইরের কর্মজগতে প্রবেশ করছেন। অনেক সন্তানই পরিবার নিয়ে বিদেশে। বৃদ্ধের পরিচর্যার জন্য উদ্বৃত্ত কর্মী জোগান দিতে অক্ষম পরিবার। অপর দিকে, পরিচর্যায় দক্ষতার চাহিদাও বেড়েছে। একটি সেবাপরায়ণ মন এবং দুইটি কর্মতৎপর হাতই যথেষ্ট নয়। চিকিৎসা আগের চেয়ে জটিল হয়েছে, পরিচর্যার প্রকরণও অধিক দক্ষতা দাবি করছে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত কর্মী নাই, এবং এর সঙ্গে সঙ্গে, অধিকাংশ বৃদ্ধের প্রয়োজনীয় আর্থিক ক্ষমতাও নাই।
অতএব বয়স্কদের পরিচর্যাকে কেবল বাজারলভ্য পরিষেবা করে রাখলেই হবে না। সরকারকেও বিষয়টির প্রতি নজর দিতে হবে। নিজঘরে চিকিৎসা তথা শুশ্রূষার পরিষেবা কী করে সহজলভ্য করা যায়, সেই বিষয়ে যথাযথ নীতি ও সুচিন্তিত প্রকল্প প্রয়োজন। সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্যই এটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রথমত, নিজঘরে যথাযথ পরিষেবা দেবার ব্যবস্থা থাকলে হাসপাতালের ‘ক্রিটিক্যাল কেয়ার’ তথা অন্যান্য বিভাগের উপর চাপ কমিবে। শয্যাগুলির যথাযথ ব্যবহার হবে। দ্বিতীয়ত, নিজঘরে প্রশিক্ষিত কর্মী দিয়ে চিকিৎসার ফল হাসপাতালে চিকিৎসার সমান, কিন্তু তার খরচ অনেক কম। তাই স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়েও লাগাম আসবে। তৃতীয়ত, প্রশিক্ষিত কর্মীদের নিয়োগ ও রোজগারের একটি মস্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে আছে। এটা লক্ষণীয় যে, অপর বহু ক্ষেত্রেই কর্মসংকোচন হচ্ছে বটে, কিন্তু স্বাস্থ্য-পরিবেষা ক্ষেত্রে তা বেড়েছে। স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণের পর গৃহকেন্দ্রিক স্বাস্থ্য পরিষেবায় তরুণ-তরুণীদের নিয়োগ কর্মসংস্থানের একটি বড় উপায় হতে পারে। অপর পক্ষে, বয়স্ক বা তার পরিবার যাতে আর্থিক কারণে এই পরিষেবাগুলো থেকে বঞ্চিত না হন, তার জন্য নানা সরকারি ব্যবস্থা করেছে উন্নত দেশের প্রশাসন। বিশেষ কিছু প্রকল্পে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে অংশগ্রহণ করলে বার্ধক্যে গৃহপরিচর্যার সুবিধা মেলে। এ দেশে এখনও পর্যন্ত অল্প কিছু বৃদ্ধনিবাস চালিয়ে কাজ সারছে সরকার। আরও অনেক বেশি কার্যকর পরিকল্পনা করতে হবে।
সর্বোপরি ভাবতে হবে বয়স্ক মানুষটির কথা। জীবনের শেষ এক কিংবা দুই বৎসর অধিকাংশ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকেই নানা শারীরিক সমস্যায় কষ্ট পেতে হয়। অথচ সেই সময়টি তাঁরা নিজের ঘরে, আপনজন পরিবৃত হয়ে থাকতেই ইচ্ছা করেন। বস্তুত মৃত্যু এড়াবার ইচ্ছার তুলনায় শেষ দিনগুলি অর্থবহ, শান্তিময় রাখবার ইচ্ছাই তাঁদের অনেকের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু হাসপাতাল-সর্বস্ব চিকিৎসা তাঁদের সেই শেষ ইচ্ছা থেকে বঞ্চিত করে। অপরিচিত ঘরে, অনাত্মীয় মানুষের মাঝে তাঁরা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কোনও দেশ, কোনও সমাজ, পরমাত্মীয়ের জন্য এমন মৃত্যু কামনা করতে পারে না। পশ্চিম দুনিয়ায় ‘হসপিস’ পরিষেবা, বিশেষ শুশ্রূষা-সংবলিত বৃদ্ধাবাস থেকে নিজঘরে প্রশিক্ষিত সহায়তা, এমন নানা পরিষেবা রয়েছে। ক্রমশ তার সুফলগুলিও স্পষ্ট হচ্ছে। সেই সুফল দেখে নাগরিকরা উত্তরোত্তর এই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। এই দেশকেও সে পথে হাঁটতে হবে। পরিবার যার পাশে নাই, সেই বৃদ্ধের কুশল নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র।
বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের একাকিত্ব সত্যিই একটি সামাজিক সমস্যা। বয়স হলে মানুষ এমনিতেই শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে অশক্ত হয়ে পড়েন। মানসিক কিছু জটিলতা থেকে দৈহিক স্বাস্থ্যও খারাপ হয়। ঘরের পাশে থেকেও অনেক সন্তানই বাবা-মা’র সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না। আবার এটাও ঠিক, প্রত্যেক সম্পর্কে কোথায় যেন একটা অলিখিত দাবি থাকে। সেই মতো চাহিদা মিটতে নাও পারে। এই সব ভেবে যদি কোনও বয়স্ক মানুষ সর্বদা চিন্তা করতে থাকেন, তবে তিনি অবশ্যই একাকিত্বে পড়বেন। এতে আয়ু কমবে, বাড়বে না।
প্রত্যেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধারই নিজস্ব জগৎ তৈরি করে নেওয়া উচিত। সে জগতে তিনি নিজেকে অনেক বেশি ভালোবাসতে পারবেন, অতীতের সুখ-স্মৃতিতে ফিরে যেতে পারবেন। অন্য দিকে মৃত্যুকে অনিবার্য হিসেবে মেনে নিতেই হবে। একটু অন্য রকম ভাবে ভাবা যেতেই পারে, মৃত্যু যেন নতুন একটা জগতে প্রবেশের দ্বার। এটাকে ভয় না পেয়ে জয় করতে হবে। তবে মানসিক দৃঢ়তা অনেকটাই বাড়বে।
অন্য দিকে, এই প্রজন্মকে ভাবতে হবে, তারা যে আজ এত বড় হয়েছে, তার কারণ এই বয়স্ক মানুষরা। আজ যে যুবক, কাল সে বৃদ্ধ। এ ভাবে ভাবলে দু’পক্ষেরই বোঝাপড়ায় সুবিধা হবে।
সামাজিক অনেক কাজেই বহু বয়স্ক মানুষকে যুক্ত থাকতে দেখেছি। তাঁরা সেই কাজ নিয়ে ভালোই আছেন। তাঁদের মুখেই শুনেছি, কাজে আছি বলে দেহ-মন দুটোই ভালো আছে। বাড়িতে একা-একা ভালো লাগে না। আবার অনেকে সময়ের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। সমবয়সী-সমমানসিকতার মানুষও একসঙ্গে ভালো থাকার চেষ্টা করছেন। নিঃসঙ্গতা এড়ানোর নানা পথ খুঁজতে হবে। তবেই ভালো ভাবে বাঁচা যাবে।
একটা পরিবার কতটা উন্নত, সেই পরিবারের বাচ্চা কিংবা বৃদ্ধদের দেখলে বোঝা যায়। ঠিক সে রকমই একটা সমাজ কতটা উন্নত, স্বাস্থ্যবান, বর্ধিষ্ণু সেটাও বয়স্ক মানুষদের দেখলে কিন্তু বোঝা যায়।
আমরা বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে বিতাড়িত বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ত্রাণ ও পুনর্বাসন নিয়ে ব্যস্ত রয়েছি। এই ডামাডোলে দেশের মধ্যে থাকা ময়মন বেগমদের কথা যেন ভুলে না যাই!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য