প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রেজা ঘটক | ২৪ মে, ২০১৫
যে সময়ে নারী লাঞ্ছনা ও যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে, সেই সময়েই চলন্ত মাইক্রোবাসে গণধর্ষণের শিকার হলেন এক গারো তরুণী। রাত সোয়া নয়টায় ঢাকা শহরে প্রচুর মানুষ বাইরে থাকে। যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকায় ঘুরে ঘুরেই চলন্ত মাইক্রোবাসের মধ্যে পাঁচ পাষণ্ড এই গণধর্ষণ করেছে। দেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতি কতোটা নাজুক হলে একেবারে রাজধানীতে প্রকাশ্যে এভাবে চলন্ত মাইক্রোবাসের মধ্যে গণধর্ষণ ঘটানোর দুঃসাহস পায় ধর্ষকরা। এতো গেল মেয়েটির উপর দেড় ঘণ্টার পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা। পরের ঘটনাগুলো আরো ভয়ঙ্কর।
প্রথমে তুরাগ থানা, তারপর গুলশান থানা, তারপর ভাটারা থানায় ভুক্তভোগী যেভাবে বারবার নাকাল হয়েছেন, এটা পুলিশের কোন আইন? যে কোনো থানায় কেন অভিযোগ দায়ের করা যাবে না? তাহলে পুলিশের কাজটা কি? ঘটনা যেখানে ঘটল সেই স্থান যে থানার অধীনে নাকি ভুক্তভোগী যে থানার বাসিন্দা সেই থানায়ই কেবল অভিযোগ করা যাবে, এটা কোন ধরনের ফালতু আইন? আইন তো হওয়া উচিত, একজন ভিকটিম যত কাছে পুলিশ পাবে, তার কাছেই সেই অভিযোগের কথাটি জানাবে। ঘটনা কোথায় ঘটল, আর ভিকটিমের বাসা কোন এলাকায়, এসব ফালতু বিষয় পুলিশ কি আইনের কোথাও দেখাতে পারবে? যদি আইনে সেরকম থেকে থাকে, তাহলে আগামী সংসদ অধিবেশনেই এই আইনের উপর সংশোধন আনা হোক। একজন ভিকটিম বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্তে যেখানেই হামলার শিকার হোক না কেন, পুলিশের কাছে যাওয়া মাত্র পুলিশ সেই অভিযোগ নিতে বাধ্য থাকবে। নইলে আর আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠার যত গালগপ্পো আমরা শুনি, সব বাকোয়াজ। রাষ্ট্র ইচ্ছে করেই আইনে এমন জটিল জটিল প্যাচগোচ রেখে দিয়েছে।
ফাইনালি যে ভাটারা থানা মেয়েটির অভিযোগ নিল, সেটি কখন নিল? পুলিশ কি এই বিষয়টিকে ততোটা গুরুত্ব দিয়েছে? সকাল ৬টা থেকে ভিকটিমকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ওসি সাহেব থানায় আসলেন সকাল নয়টায়। তারপর অভিযোগ নিতে দুপুর বারোটা বাজল। তারপর ভিকটিমকে পুলিশ হেফাজতে রেখে দেওয়া হল। পরদিন ঢাকা মেডিকেলে পরীক্ষা করা হবে। মানে ভিকটিমের অভিযোগ সঠিক কিনা, সেই পরীক্ষা নিরীক্ষা পুলিশ আগে করবে। ততক্ষণ সেই পাঁচ ধর্ষক কি ওই থানার সামনে গিয়ে ঘুরঘুর করবে?
শনিবার (২৩ মে) সকাল ১১টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে মেয়েটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। ফরেনসিক বিভাগের প্রধান চিকিৎসক মো. হাবিব উজ জামান চৌধুরীর ভাষ্য, স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। তিনি খুবই দুর্বল। এক সপ্তাহের মধ্যে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রদান করা হবে। এ ছাড়া ওই তরুণীর বয়স নির্ধারণের এক্স-রে করানো হবে বলে জানান তিনি। তার মানে এই সুযোগে মেয়েটি প্রাপ্ত বয়স্ক নাকি শিশু এটা জানার জন্য পুলিশ আরো এক সপ্তাহ নাকে সরিষার তেল দিয়ে ঘুমাবে। তাহলে দেশে পুলিশ পোষে কি লাভ?
ঘটনার বর্ণনা থেকে যেটা বোঝা যায়, পুলিশ এ ধরনের কেস নিতেই এক ধরনের গড়িমসি করল। পুলিশের এই গড়িমসি করার হেতু কি? নাকি পুলিশ ধর্ষকদের পক্ষে? ভিকটিম প্রথম যে তুরাগ থানায় গেল, পুলিশ কি তখন সুস্পষ্টভাবে অভিযোগ শুনে ব্যবস্থা নিতে পারতো না? সরকার যে এত ডিজিটাল ডিজিটাল করে, ডিজিটালের সুবিধা আসলে কখন কিসে লাগবে, সরকার তো মনে হয় সেটাই জানে না। থানাগুলো কেন ডিজিটাল হচ্ছে না? যে কোনো ব্যক্তি যদি কোনো থানায় অভিযোগ দায়ের করে, সেটি বাংলাদেশের যে কোনো থানা থেকেই মুহূর্তে দেখতে পাওয়ার সুবিধা কেন সরকার করছে না? পুলিশের হাতের যে ওয়াকিটকি, সেগুলো কোনপূজায় লাগে? কেবল ক্ষমতাবান লোকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য? তুরাগ থানা কি ওয়াকিটকিতে ভাটারা বা গুলশান থানাকে ঘটনা জানিয়ে দিতে পারতো না? এই না জানানোর হেতু কি? এই যে থানায় মামলা করা নিয়ে ভিকটিম যে পরিমাণ নাজেহাল হল, এই ঘটনার বিচারের দশা কি হবে, তা এই চিত্র থেকেই সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
পুলিশের জনগণকে সেবা দেবার কোনো মানসিকতা নেই। আইনেও তেমন ফাঁকফোকর ইচ্ছে করেই রাষ্ট্র রেখে দিয়েছে। আইনে কেবল ক্ষমতাবানদের দ্রুত সহায়তা দেবার ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছে। দেশের সাধারণ মানুষের জন্য পুলিশ কোনো সেবা সংঘ নয় বরং নাজেহাল সংঘ।
পুলিশের আইজি সাহেব পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে মেয়েদের উপর নিপিড়নের ঘটনাকে দুষ্টু ছেলেদের দুষ্টামি বলে অভিহিত করেছেন। তাহলে এবার চলন্ত মাইক্রোবাসে গণধর্ষণের ঘটনাকে মাননীয় আইজি সাহেব কি বলবেন? একটু বাড়াবাড়ি টাইপের দুষ্টামি? নাকি বলবেন, ঘটনা কেউ দেখেনি, মেয়েটি কেন রাত সোয়া নয়টার ঘটনা এত দেরিতে পুলিশকে জানালো, সেজন্য বরং মেয়েটিকে থানার লকারে আটকে রাখো! বাস্তবে কিন্তু মেয়েটি এই ঘটনার পর পুলিশের হেফাজতে বন্দিই ছিল। যেখানে তার হাসপাতালে চিকিৎসা নেবার কথা। পুলিশ কেন দুপুর বারোটায় ঢাকা মেডিকেলে নিতে পারল না? সকাল নয়টায় ওসি থানায় আসলেন। মামলা নিতে বারোটা বাজালেন। তারপর একটা রাত মেয়েটি পুলিশ হেফাজতে থাকল। নাকি পুলিশ আরো এক দফা মেয়েটিকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল? তাই পুরো দিন নষ্ট করে পরদিন তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হল? পুলিশের এই যে গাফিলতি এর শেষ কোথায়?
সরকার যতোই চোপার জোর দেখাক না কেন, দেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতি ভয়ংকর রকমের খারাপ। মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। রাত নয়টায় ঢাকায় হাজার হাজার গাড়ি চলে। অথচ এই দেড় কোটি মানুষের চোখের সামনে একটি চলন্ত মাইক্রোবাসে একটি মেয়েকে পাঁচ ধর্ষক পালাক্রমে গণধর্ষণ করল, কেউ দেখল না। আমরা কোথায় বসবাস করছি? আসলে এই পাঁচ ধর্ষক গোটা বাংলাদেশকেই ধর্ষণ করেছে।
মেয়েটি একটি গরীব পরিবারের। তারপরে আবার সংখ্যালঘু। তারপরে আবার খ্রিষ্টান। তার তো বাংলাদেশে পুলিশের সরাসরি সাপোর্ট পাবার কথা নয়!!! আজ যদি এই মেয়েটির জায়গায় কোনো মন্ত্রী সাহেবের মেয়ের বেলায় একই ঘটনা ঘটত, তাহলে ঘটনার রাতেই পুলিশ শুধু ঢাকায় না, গোটা বাংলাদেশে তল্লাশি চালিয়ে পাঁচ ধর্ষককে ১০০ হাত পানির নিচ থেকে হলেও খুঁজে বের করত। গরীব মানুষের জন্যে এই রাষ্ট্রে আইন এমন ঢিলা। পুলিশও গরীব মানুষ দেখলে তেমন পাত্তা দেয় না। গড়িমসি করে, নানান তালবাহানা করে।
তাহলে গারো মেয়েটি চলন্ত মাইক্রোবাসে গণধর্ষণের ঘটনা থেকে আমরা কি শিখলাম?
১. বাংলাদেশে এখন চলন্ত মাইক্রোবাসেও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
২. পুলিশ ঘটনাস্থল আর ভিকটিমের বাসার তথ্য দিয়ে অভিযোগ নিতে নানান বাহানা করেছে।
৩. পুলিশ ইচ্ছে করেই এই মামলা নিতে দেরি করেছে।
৪. পুলিশ ইচ্ছে করেই ডাক্তারি পরীক্ষা দেরিতে করিয়েছে।
৫. পুলিশ ভিকটিমকে চিকিৎসা সেবা না দিয়ে নিজেদের হেফাজতে আটকে রেখেছে।
৬. পুলিশ ভিকটিমের অভিযোগ নিতে অন্তত তাকে তিন থানায় ঘুরিয়েছে।
৭. পুলিশ এই ঘটনায় মামলা নিতে এক ধরনের তালবাহানা করেছে।
৮. শেষ পর্যন্ত পুলিশ মামলা নিলেও অভিযোগের আলামত যাতে নষ্ট হয়, সেজন্য পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে সময় নষ্ট করেছে।
এই ঘটনায় তো এখন স্বয়ং পুলিশের বিরুদ্ধেই এই অভিযোগগুলো দিয়ে মামলা করা যায়। যদি সত্যি সত্যিই দেশে আইনের শাসন থাকতো, তাহলে পুলিশ এই এতগুলো অপরাধ থেকে কিভাবে ছাড় পায়? ভাটারা থানার ওসি কিভাবে এখনো থানায় থাকতে পারে? এখন প্রশ্ন হল তাহলে এই পুলিশ পোষে আমাদের আসলে কি লাভ হচ্ছে? পুলিশের সামনে চাপাতি দিয়ে কাউকে খুন করলে পুলিশ নিরব দর্শক থাকে। পুলিশের সামনে মেয়েদের শ্লীলতাহানি করলে পুলিশ নিরব দর্শক থাকে। মেয়েদের শ্লীলতাহানিকারীদের পুলিশকে জনতা হাতে নাতে ধরে দিলে পুলিশ তাদের ছেড়ে দেয়। তাহলে এই পুলিশ দিয়ে বাংলাদেশে কিভাবে আইনের শাসন বাস্তবায়ন হবে???
প্রথম প্রশ্ন হল, যে কোনো থানায় কেন কেউ অভিযোগ দায়ের করতে পারবে না? এটা যদি আইনের কোনো মারপ্যা্চ হয়ে থাকে, সেই আইন এখনই সংশোধন করা হোক। বাংলাদেশের যে কোনো থানায়, বা রাস্তাঘাটে যে কোনো স্থানে ডিউটিরত পুলিশের কাছে যে কেউ অভিযোগ দায়ের করতে পারবে। এটাই তো থাকা উচিত। নইলে চোখের সামনে হাজার হাজার পুলিশ দেখলেও, তারা কেউ তো আপনার প্রয়োজনে কাজে লাগছে না। তাহলে এই পুলিশ কেন আমরা ট্যাক্স দিয়ে লালন-পালন করব?
এই গারো মেয়েটি যে এই গণধর্ষণের কোনো বিচার পাবে না, এই ধর্ষকদের যে পুলিশ নানান কিসিমের ছাড় দেবে, তা ঘটনার শুরু থেকেই পুলিশের আচরণ তাই প্রমাণ করছে। তো এই পুলিশ দিয়ে বাংলাদেশের রাজস্ব ধ্বংস করা ছাড়া আর কোনো পূজায় এদের লাগবে না।
দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের কঠিন আইন করে কাগজে কলমে রেখে দেওয়া হয়েছে। ওতেই সব উদ্ধার হয়ে যাবে। ওহে সরকার বাহাদুর একবার মুখ ফুটে বলুন, দেশে আইন আছে কিন্তু বিচার নাই। নইলে এসব বাকোয়াজ বন্ধ করুন। এই গারো মেয়েটিকে তিন দিন ধরে যেভাবে নানান ভাবে নাজেহাল করা হয়েছে, তার প্রতিটি ঘটনাই আরো আরো গণধর্ষণের সমান অপরাধ। মানে মেয়েটিকে এই তিনদিনে পাঁচ ধর্ষকের গণধর্ষণের পর আরো কয়েকদফা তাকে রাষ্ট্র ধর্ষণ করেছে। এটাই হল আসল কথা। এই দেশে আইনের শাসন নেই। কারো জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। কিন্তু পুলিশ, নির্বাহী বিভাগ, বিচার ভিভাগ, সংসদ সবই ঠিকঠাক আছে। এটাই মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তামাশার রাজত্ব।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য