আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

‘অপূর্বার মৃত্যুতে ব্লু হোয়েলই দায়ী’ প্রমাণিত সত্য নয়!

এমদাদুল হক তুহিন  

রাজধানীর হলিক্রস স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণার মৃত্যুর পেছনে ব্লু হোয়েল গেমই দায়ী- এটি প্রমাণিত সত্য নয়। কারণ হিসেবে বলছি, প্রথমত অপূর্বার লাশের কোন ময়নাতদন্ত হয়নি। অর্থাৎ পরিবারের পক্ষ থেকে তা করতে দেওয়া হয়নি। কারণ হিসেবে অপূর্বার বাবা সুব্রত বর্ধন বলেছেন, অপূর্বার মা সীমা বর্ধন চাননি ময়নাতদন্ত হোক। মেয়ের লাশ কাটাছেড়া হোক। সীমা বর্ধন সুব্রত বর্ধনের শার্টের কলার টেনে বলেছেন, সব জায়গায় আইন দেখাবে না। আমার মেয়ের লাশ কাটাছেড়া হলে আমি তোমার সঙ্গে থাকবো না। এই কথাগুলো সুব্রত বর্ধনের। তবে ময়নাতদন্ত না হওয়ার পেছনে এই যুক্তি ছাড়াও আরেকটি কারণ ছিলো। মেয়ের শরীরের কোথাও মেজর কোন ইনজুরি ছিলো না। ফলে বাবা নিজ জিম্মায় লাশ নিতে পারেন। তবে আমার মনে হয়, ময়নাতদন্ত না হওয়ার পেছনে কোন ইস্যু লুকিয়ে থাকতে পারে।

দ্বিতীয়ত, ব্লু হোয়েল গেমস খেলে কেউ আত্মহত্যা করলে সে অবশ্যই হাতে নীল তিমির একটি ছবি আঁকবে। গেমের একটি পর্যায় এটি আঁকবেই। তবে অপূর্বা বর্ধনের হাতে নীল তিমির আঁকা কোন ছবি পাওয়া যায়নি। সুব্রত বর্ধনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির সময় জুই নামে অপূর্বার এক পিসি প্রথমে ব্লু হোয়েল প্রসঙ্গ টেনে আনেন। সন্দেহ করেন মেয়ে হয়তো ব্লু হোয়েল গেমস খেলে আত্মহত্যা করেছে। পরবর্তীতে জুইই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানায়, প্রথমে আমরা সন্দেহ করেছিলাম মেয়ে হয়তো ব্লু হোয়েল গেম খেলে আত্মহত্যা করেছে। তবে তার হাতে নীল তিমির আঁকা কোন ছবি পাওয়া যায়নি।

বিষয়টি সম্পর্কে সুব্রত বর্ধন বলেন, ‘আমি কখনওই সরাসরি বলিনি আমার মেয়ে ব্লু হোয়েল গেমের শিকার। পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টের সময় জুইই প্রথম বলে অপূর্বা সম্ভবত ব্লু হোয়েল গেমসে আক্রান্ত হয়েছে। ওরও মনে হয়েছিল। সন্দেহ হয়েছিল। তবে এটি প্রমাণিত সত্য নয়। আর আমি কোথাও বলিনি আমার মেয়েসহ এতজন ব্লু হোয়েল গেমসে আক্রান্ত হয়েছে।’

রিপোর্ট তৈরি করার জন্য সুব্রত বর্ধনের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, তখন তিনি এভাবেই বলছিলেন। তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, অপূর্বার হাতে যেহেতু নীল তিমির আঁকা ছবি পাওয়া যায়নি, ব্লু হোয়েল গেমে আক্রান্তের বিষয়টি শুধু সন্দেহই, প্রমাণিত নয়। তবে পরিবারের দাবী, ব্লু হোয়েল গেমসে আক্রান্তরা যা যা করে থাকে, তার বেশ কিছু লক্ষণ অপূর্বার মধ্যে ছিলো। যুক্তি হিসেবে তারা বলছেন, মেয়ে কোন এক রাতে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে চেয়েছিলো। মেয়ে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকতো। এছাড়াও সে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের সব কিছুই পরিবারের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতো। একাজগুলো অনেক ছেলে মেয়েরাই করে থাকে।

তৃতীয়ত, গত ৭ অক্টোবর প্রকাশিত মানবজমিন পত্রিকায় ‘‘বাংলাদেশেও ‘ব্লু হোয়েল’ আতঙ্ক’’ শীর্ষক প্রতিবেদনে অ্যাডভোকেট সুব্রত বর্ধনকে কোট করে বলা হয়, ‘অ্যাডভোকেট সুব্রত বর্মন আরও বলেন, তার মৃত্যুর পর আমি  ব্লু হোয়েলের বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়া শুরু করেছি। জেনেছি যে, রাশিয়ার এক সাইকিস্ট সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এই গেমটি উদ্ভাবন ও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছে। এরই মধ্যে নাকি বাংলাদেশে আমার মেয়েসহ অন্তত ৬১ জন ব্লু হোয়েলের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে।’

পত্রিকাটিতে এখানে অবশ্য সুব্রত বর্ধনের স্থলে বর্মন ছাপা হয়েছে। সেই যাই হোক এখানে বড় একটি মিথ্যার প্রশ্রয় নিয়েছে মানবজমিন। সুব্রত বর্ধন গত মঙ্গলবার আমাকে বলেন, আমার মেয়েসহ এতজন মারা গেছে গণমাধ্যমে আমি এমন বক্তব্য দেয়নি। কয়েকটি যায়গায় এই তথ্যটির ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানীদের কথা বলা হলেও আদতে সেই মনোবিজ্ঞানী কারা তা আমাদের জানা নেই।

মানবজমিনের এই ৬১ জনের মৃত্যুর তথ্য ধরে  ইত্তেফাক পত্রিকাটিতে একটি ভুল রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। কাট-কপির এই যুগে পত্রিকাটিতে গত ৯ অক্টোবর ‘দেশে নতুন আতঙ্ক ব্লু হোয়েল গেম’ শীর্ষক প্রতিবেদনে  দেশে ব্লু হোয়েল গেমে আক্রান্ত হয়ে ৬১ জনের মৃত্যুর তথ্য উল্লেখ করা হয়। পত্রিকাটি অবশ্য বরাত দিয়েছে মনোবিজ্ঞানীদের। তবে কোন মনোবিজ্ঞানী তাকে এই তথ্য দিয়েছেন সাংবাদিক তা ইত্তেফাকে উল্লেখ করেননি।

তবে একজন রিপোর্টার হিসেবে এইটুকু বুঝতে পারি, ব্লু হোয়েল সম্পর্কে রিপোর্ট প্রকাশ করতে গিয়ে মানবজমিন পত্রিকা যে ভুলটি করেছে, সেই একই ভুলে দুষ্ট প্রথম সারির পত্রিকা ইত্তেফাকও। আর মানবজমিনের রিপোর্ট ৭ তারিখের। ইত্তেফাকের রিপোর্ট ৯ তারিখের। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যে তথ্যটি নেই, গণমাধ্যমের কাছে যে তথ্যটি নেই, একজন ভিকটিমের বাবা বললেন এতজন মারা গেছে; আর তাই ছেপে দেবে গণমাধ্যম। হাস্যকর। সত্যিই, অদ্ভুত! আর সেই অদ্ভুত তথ্য পরবর্তীতে প্রাধান্য পাবে আরও একটি বড় গণমাধ্যমে। এ যেন সত্যিই বিচিত্র! মানুষের মৃত্যু নিয়ে এতো বড় মিথ্যে ছড়ানো গণমাধ্যমের কাছ থেকে কখনওই আশা করে না গণমানুষ। ব্লু হোয়েল নিয়ে মূলত আতঙ্ক ছড়িয়েছে এ দুটি রিপোর্টের মাধ্যমেই। আর মেকিং স্টোরি তৈরির জন্য নাম সর্বস্ব পোর্টাল তো আছেই।

অপূর্বা বর্ধনের মৃত্যুর পেছনে ব্লু হোয়েল ছাড়াও  অন্য কোন কারণ লুকিয়ে আছে বলে আমি মনে করি। তদন্ত এগিয়ে গেলে হয়তো অনেক কিছু বেরিয়ে আসতে পারে। তবে সে পথ অনেকটা রুদ্ধ। মামলা হয়নি, তদন্তটাই হবে কী করে।

আজ পথেঘাটে ব্লু হোয়েল নিয়ে যেভাবে আলোচনা হচ্ছে, মানুষ যেভাবে ব্লু হোয়েলের টাস্কগুলো জেনে যাচ্ছে, গেইম না হোক; সেই কর্মগুলোতে কেউ অনুপ্রাণিত হলে দেশের জন্য তা সর্বনাশ বয়ে আনবে। ব্লু হোয়েল গেমসে যতোগুলো টাস্ক আছে, যদি ১০টি টাস্কও কেউ নিয়মিতভাবে অনুসরণ করে; তাও বিপদে ফেলবে ওই তরুণ ও কিশোর-কিশোরীদের। কারণ ব্লু হোয়েল গেমসের প্রতিটি টাস্কই মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার অনুঘটক।

ব্লু হোয়েল গেমসের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ থাকলেও মনোজগতের দিক থেকে আমাদের আরও সতর্ক হওয়া উচিৎ। শিশু-কিশোরদের মনোজগতকে বুঝতে চেষ্টা করা উচিৎ। তারা কী করছে, তাদের কতোটা শাসন করা উচিৎ, দেয়া উচিৎ কতোটা স্বাধীনতা- অবশ্যই তার একটা সমন্বয় থাকা প্রয়োজন। সময় এসেছে, কিশোর-কিশোরী ও তরুণ সমাজকে ইন্টারনেটের আসক্তি থেকে মুক্ত করার। আর ইন্টারনেটে বন্দি এই জীবনে গেম খেলার ক্ষেত্রেও লক্ষ্য রাখতে হবে তা যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়। ভুলক্রমেও অপরিচিত কোন লিঙ্কে যেন ক্লিক করা না হয়। আর অভিভাবকদের বলছি, হঠাৎ করে অতি শাসনে উৎসাহিত না হয়ে;  প্রথম থেকেই মুঠোর ভেতরে রাখুন সব।

এমদাদুল হক তুহিন, ব্লগার, কবি ও সংবাদকর্মী। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ