আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

নিষ্পাপ শেখ রাসেল

মো. সাখাওয়াত হোসেন  

ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্বাভাবিকতা, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ব্যক্তিজীবনের অর্জন ও মূল্যায়নকে সামনে রেখেই সময় মানুষকে মূল্যায়ন করে থাকে। কারও জন্মানুষ্ঠানে কিংবা মৃত্যুতারিখে ব্যক্তিক জীবনের সার্থক কর্মের ইতিবাচকতাকে মূল্যায়নের মাধ্যমেই ইহজগৎ স্মরণ করে থাকে, পাশাপাশি মানবকুল আলোচনার সার্থকতা খুঁজে বেরায় অনুষ্ঠানে। আবার কেউ কেউ অল্প জীবনের অধিকারী হয়েও তাঁর বিশেষ কর্ম কিংবা ঐতিহাসিক পরিবারের জন্ম নিয়ে সামান্য সময় পেয়েও পরিবারের সকলের কাছে বিশেষ মূল্যায়নের অধিকার বহন করে থাকে। তাদের সামান্য জীবনকালের ব্যাপ্তি, চারিত্রিক মহিমা, বৈশিষ্ট্য ও আচরণগত উজ্জ্বলতার কারণে সকলের মণিকোঠায় বিশেষ স্থান অর্জন করে থাকে। এরকমই একজন বিশেষ গুণের অধিকারী শেখ রাসেল, বাংলাদেশের রাজনীতির আঁতুড়ঘরে তাঁর জন্ম হয় ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর। মাত্র ১০ বছর বয়সে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, কিন্তু এ সামান্য জীবনে শেখ রাসেল পরিবারের সকলের কাছে অত্যন্ত প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর বাচনভঙ্গি, চলাফেরার ধরণ, গাম্ভীর্য, আতিথেয়তা, রাশভারী আচরণ পরিবারের সকলকে বিমোহিত করেছিল অল্প দিনেই। ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিল রাসেল পাশাপাশি শেখ মুজিবকে না পাওয়ার হাহাকার ছোট রাসেলকে ব্যথিত করেছিল।

শেখ রাসেলের জন্ম হয়েছিল গভীর রাত্রে। অন্য ভাইবোনরা ঘুমিয়ে ছিল, হঠাৎ বঙ্গবন্ধুর বোনের ডাকে ঘুম ভাঙে সকলের। আবার ঐ দিন বঙ্গবন্ধু ছিল চট্টগ্রামে। ঘুম থেকে উঠেই সকলের আনন্দ ও কৌতূহল বাড়ির পরিবেশকে রোমাঞ্চকর করে তুলেছিল। তাদের পরিবারে নতুন শিশুর আগমন ঘটেছে। কি সুন্দর শিশুটা, ছোট ছোট মুষ্টিবদ্ধ হাত, দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। ভাইবোনদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়, কে আগে ফুটফুটে শিশুটাকে কোলে তুলে আদর করবে। আবার এ ব্যাপারে সবাই সচেতন ছিল, কোন কারণে যেন রাসেলের কষ্ট না হয়। তাই শিশুটির ব্যাপারে সবাই খু্ব উৎসুক এবং আগ্রহী ছিল। কোনভাবেই বাচ্চা ছেলেটির যেন কোনরূপ কষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতেন বড় বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ছোট বাচ্চার মুখ থেকে কথা বের করা, গোসল করা, খাওয়ানো ইত্যাদি সকল কাজ আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ রাসেলের বড় বোন শেখ হাসিনাই করতেন। আজো আমরা শেখ রাসেলের স্মরণসভায় প্রধানমন্ত্রীকে শোকে মুহ্যমান হতে দেখি।

শেখ রাসেলের নামকরণ সেটিও একটি ইতিহাসের মতই। মা ফজিলাতুন নেছা মুজিব এবং বাবা শেখ মুজিব উভয়েই ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন। ইংরেজিতে লেখা বইগুলো বাংলায় অনুবাদ করে ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে শোনাতেন এবং সেখান থেকেই খুব অনুরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। বাবা-মার পছন্দ মতোই দার্শনিকের নামের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই শেখ রাসেলের নামকরণ করা হয়। শেখ রাসেল ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে ছিলেন। যেমন: বাড়িতে সে দুধ খেতে চাইতো না, আবার বিকালে ফুপুর বাসায় ঘুরতে বের হতো সেখানে ঠিকই দুধ খেতো। তাই ফজিলাতুন নেছা মুজিব কৌশলে বাড়ির দুধ তাদের বাসার নিকটেই রাসেলের ফুপুর বাসায় পাঠিয়ে দিতেন। এখন যে ধানমন্ডি লেকটা দৃশ্যমান, এই লেকেই রাসেল বিকালে খেলাধুলা করতো। রাসেলের আরেকটি শখ ছিল বিকালে অফিস ফেরত ফুপার সাথে মোটরসাইকেলে ঘুরে বেড়ানো। এভাবে রাসেলের শৈশব কাটে। ভাইবোন এবং আত্মীয় স্বজনদের সাথে প্রাণোচ্ছল পরিবেশে রাসেলের শৈশব অতিবাহিত হয়।

তবে শিশু রাসেলের সবথেকে যে দিকটি খুবই বেদনার তা হলো বাবাকে কাছে না পাওয়া। রাসেলের জন্মের কিছুদিন পর থেকেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে কারান্তরীন করা হয়। কারাগারে যখন পরিবারের সবার সাথে বাবার সাথে দেখা করত রাসেল তখন এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচায় রাসেলের আবেগের কাছে নিজের পরাস্তের কথা উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন জায়গায়। রাসেলও কারাগার থেকে ফেরত আসার সময় কোনভাবেই বাবাকে রেখে আসবে না। সে সময় বঙ্গবন্ধু রাসেলকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, তুমি তোমায় মায়ের বাসায় যাও, আমি আমার বাসায় থাকি। এভাবে আর কতদিন রাখা যায়! তারপরে ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে রাসেল আব্বা বলে সম্বোধন করতেন। পরবর্তীতে একদিন রাসেল কারাগারে এসে বেগম মুজিবকে আব্বা বলে সম্বোধন করলে বঙ্গবন্ধু অন্তর্নিহিত কারণ জানতে চান। প্রতিউত্তরে বেগম মুজিব বলেন: বাড়িতে রাসেল শুধু তাঁর আব্বাকে খুঁজে, তাই আমি (বেগম মুজিব) বলে দিয়েছি আমিই তোমার আব্বা, আমিই তোমার আম্মা। তারপর থেকেই রাসেল তাঁর আম্মাকে আব্বা বলে ডাকতেন। কি অবর্ণনীয় অবস্থা, বাবা থাকতেও কাছে না পাওয়ার কারণে মাকে আব্বা বলে সম্বোধন করতে হয়!

রাসেল তাঁর মায়ের সাথে শেষ জীবনের সঙ্গী হিসেবে থেকেছিল। বাড়িতে মায়ের সাথে কবুতরের খাবার দিতেন। মা বেগম মুজিব রাসেলকে বিশেষ উপহার হিসেবে তিন চাকার সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। সাইকেল পেয়ে রাসেল বড্ড খুশি হয়েছিল। তবে সাইকেল চালানোর জন্য নির্দিষ্ট সীমানা বেধে দিয়েছিলেন মা। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়ে ফজিলাতুন নেছা মুজিব কড়া নজর রাখতেন। রাসেলের লেখাপড়ার বিষয়েও তিনি সচেতন ছিলেন। রাসেলকে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন মা এবং বাড়িতে রাসেলকে পড়ানোর জন্য নানা রকমের কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। রাসেলের জন্য স্বাধীনতার পরে গৃহশিক্ষক রাখার ব্যবস্থা হয়েছিল বাড়িতে। রাসেল ও ধীরে ধীরে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে উঠে। কারাগারে সাক্ষাতের সময় শেখ মুজিব ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে যে কোন মূল্যে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে তাগিদ দিতেন এবং তিনিও পড়াশোনার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন যাতে কোনভাবেই সন্তানদের পড়াশোনায় বিঘ্ন না ঘটে।   

ছোট্ট বয়সেও রাসেলের অনুধাবন করার ক্ষমতা ছিল উল্লেখ করার মতই। বাবা পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি, বড় দুই ভাই মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। এ রকম দুঃসহ পরিস্থিতিতে রাসেলের আচরণকে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরের পরপরই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হানাদারদের আক্রমণ চালানোর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী লিখছেন, ‘আমার মা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি হন। আমাদেরকে ধানমন্ডির আঠারো নম্বর সড়কে (পুরাতন) একটা একতলা বাসায় বন্দি করে রাখে।’ প্রথমদিকে রাসেল আব্বার জন্য খুব কান্নাকাটি করতো। ‘মনের কষ্ট কীভাবে চেপে রাখবে আর কীভাবেই বা ব্যক্ত করবে। ওর চোখের কোণে সবসময় পানি। যদি জিজ্ঞাসা করতাম, ‘কী হয়েছে রাসেল? বলত ‘চোখে ময়লা’। ওই ছোট্ট বয়সে সে চেষ্টা করতো মনের কষ্ট লুকাতে।’ রাসেল মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা কষ্টটাকে কারো কাছে প্রকাশ করত না, পরিস্থিতি অবলোকন করেই রাসেল নিজের কষ্টটাকে লুকিয়ে রেখেছিল।

স্বাধীনতার পরে রাসেল তাঁর বাবাকে কিছুটা সময় কাছে পেয়েছিল। রাষ্ট্রীয় কাজের ব্যস্ততা সত্ত্বেও শেখ মুজিব রাসেলের খোঁজখরব নিতেন সবসময়। বাবার সাথে রাসেল বিদেশ সফরে গিয়েছেন এবং সেখানে গাম্ভীর্যের পরিচয় দিয়েছেন। রাসেলের শখ ছিল বড়শি দিয়ে মাছ ধরা। গণভবনের পুকুর, ধানমন্ডির লেক এবং উত্তরা গণভবনে রাসেল বড়শি দিয়ে মাছ ধরেছেন। সহপাঠীদেরও বিভিন্ন খেলাধুলায় মাতিয়ে রাখতেন। তাঁর ছোট্টজীবনে অন্য কারো সাথে কোন ধরনের খারাপ আচরণ করেছেন তাঁর নমুনা পাওয়া দুষ্কর। অথচ সে রাসেলের জীবনের পরিণতি কি ভয়ানক হয়েছিল। ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেটের আঘাত শিশু রাসেলকে ঝাঁঝরা করতে ছাড়েনি। অথচ রাসেল বেঁচে থাকলে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের দুইজন জীবিত সদস্যদের মত বিভিন্ন বিষয়ে মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতেন।

যে রাসেল বাসায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতেন বেঁচে থাকলে স্বপ্নের সোনার বাংলার বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারতেন বঙ্গবন্ধুর দেখানো আদর্শের পথ ধরে। রাসেলের জন্মদিনে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ