প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
চিররঞ্জন সরকার | ০৫ নভেম্বর, ২০১৭
আমার খুব ইচ্ছে একবার ‘বিরহী’ গ্রামে যাওয়া। পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায় এই নামে একটি গ্রাম আছে। বারাসত থেকে জাতীয় সড়ক ধরে শান্তিপুরের দিকে এগোলে, হরিণঘাটা পেরোলেই এই ‘বিরহী’ গ্রাম।
‘বিরহী’ নামে কোনও গ্রাম হতে পারে-তা সত্যিই বিস্ময়কর! এই গ্রামের নামটি শোনার পর থেকেই মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। এই গ্রামের লোকগুলো কেমন? আমার আপনার মতো চিরকালীন বিষয়ী, লোভী, হিংস্র, স্বার্থপর, রাগী? না, একটু উদাস উদাস? চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে চূড়ান্ত উদাসীন? সংসার, মানুষজন, জীবিকা সম্পর্কে কি তারা কোনো খোঁজই রাখে না?
রোদ পড়েছে মাঠে, জ্যোৎস্নায় ভাসছে সবুজ বাগান, রিমঝিম বৃষ্টি পড়ে চলে জাতীয় সড়কে–শুধু এ সব নিয়েই তাঁদের যাবতীয় আগ্রহ? শুধু বিরহের গজল আর পুরোনো আধুনিক গান গায়? কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের গাওয়া কীর্তন শোনে? নিঃশব্দে হারানো প্রেমিক বা প্রেমিকার জন্য চোখের জল ফেলে? বা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলোর মতো পরাবাস্তব, স্বপ্নময় চরিত্র সব। মোটেই বিষয়ী নন। সংসারীও নন!
এখানে নাকি একটি নদীও আছে! নাম যমুনা। ভাগীরথী থেকে বেরিয়ে সে নাকি মিশেছে ইছামতীতে। কোথা থেকে কোথায় চলে গিয়েছে আরও শীর্ণা হতে হতে প্রেমিক ইছামতীর দিকে। এ নদী বিরহী হয়েও খুঁজে নিতে পারে প্রেমিক!
সেখানে বাজারের নাম ‘বিরহী বাজার’। ‘বিরহী’ নামের পাশে বাজার বসে তা হলে! বিরহী শব্দের সঙ্গে আর যাই হোক, ঠিক বাজার মানায় না। তবে ওটা কেমন বিরহী? বিরহী গ্রামে তো শুধু সবুজ আর সবুজ থাকার কথা! বাঁশ, কলা, ধান, বট, অশ্বত্থ। শব্দহীন। থাকবে বিশাল প্রাচীন ‘বটবৃক্ষ’। দীর্ঘ ছায়া নিয়ে।
পৃথিবীর এটাই মজা। গ্রামের নাম বিরহীও হয়, আবার মদনপুরও থাকে। মদনপুরের লোকদের নিশ্চয়ই বিরহীর লোকদের ওপর রাগ হয়, ঈর্ষা হয়। তোদের গ্রামের এত ভালো নাম, আর আমাদের…।
গ্রামের নাম কেন হল বিরহী হয়? নিশ্চয়ই কোনো গল্প বা লোকগাথা আছে। হোক না স্রেফ গল্প। তবু তো বিরহের স্পর্শে অন্য রকম হয়ে ওঠে ভালোবাসার সুগন্ধ। যেন সেই রাধা-কৃষ্ণের চিরন্তনী প্রেম।
খুব জানতে ইচ্ছে করে বিরহী গ্রামের নামের ইতিকথা। ওখানকার মানুষগুলো কী সবই বিরহী? কিন্তু ব্যক্তিগত বিরহ অনেক সময় অনন্ত হলেও সামষ্টিক বিরহের দিন তো এক সময় শেষ হয়। তবু কেন থেকে গিয়েছে বিরোহী নামটি?
আচ্ছা, বাংলাদেশে যমুনা পারের কোনো গ্রামের নাম হতে পারে না বিরহী? যমুনা পাশে থাকলে কি রাধার জন্য বিরহে কাতর হয়ে ওঠে না শ্যাম?
প্রতিটি মানুষই কী একেক জন শ্যাম নয়? মানুষের জীবনও কী অনন্ত বিরহ নয়? না পাওয়ার আকুতির সমষ্টি নয়?
আমি বাংলাদেশেও একটি গ্রাম বানাতে চাই, যে গ্রামের নাম হবে বিরহী অথবা বিরহপুর! যেখানে সব মানুষ হবে বিরহ-কাতর, উদাসীন! যেখানে কোকিলের উদাস কুহু তান, হৃদয় খাক করা ব্যাকুল জোছনা, মন পাগল করা রাখালি বাঁশির সুর, নির্মল বাতাসের সাঁ-সাঁ শব্দ আর নদীর কুল-কুল ধ্বনির মধুর সুর ছাড়া কিছু থাকবে না।
মানুষগুলো স্বার্থ-সুবিধা-লোভ দ্বারা চালিত হবে না। সবাই হবে ভাবুক, বাউল প্রকৃতির। ওরা একে অন্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করবে!
যেখানে রাজনীতি থাকবে না, হিংসুটে পেশীবাজ শিক্ষক থাকবে না, হানাহানি থাকবে না, মারামারি থাকবে না। কেউ কাউকে কটাক্ষ করে কথা বলবে না। স্বার্থের জন্য জীবন নিতে বেপরোয়া হবে না! যেখানে প্রতিযোগিতা থাকবে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে, কিন্তু শত্রুতা থাকবে না। একে অপরকে দেখে নেওয়ার বা উচিত শিক্ষা দেওয়ার মানসিকতা থাকবে না। সবাই হবে প্রেমময়! দয়াবান। উদার। পরের দুঃখে কাতর, নিজের দুঃখে উদাসীন! যেখানে মানুষ খবর বানাবে না, গুজব রটাবে না, ‘কান নিয়েছে চিলে’ বলে চিলের পেছনে ছুটবে না!
যদি সুযোগ পাই, তাহলে এমন একটি গ্রাম আমি বানাবোই বানাবো!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য