আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

Advertise

৭ নভেম্বর: কিছু তথ্যানুসন্ধান

এনামুল হক এনাম  

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস বলে দীর্ঘদিন যাবত যে রসগোল্লা গেলানো হচ্ছিল কী তার পেছনের ইতিহাস?  জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের মদদে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। পরিষ্কার হয়ে যায় খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতার নেপথ্যে মূলত ছিলেন ১৫ই আগস্টের ঘটনার মুল নায়কেরা, মোশতাক ছিলেন তাদের হাতের পুতুল। বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুগত ও শ্রদ্ধাশীল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ (বীর উত্তম) ব্যাপারটি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। তিনি তাঁর অনুগত সৈন্য বাহিনী নিয়ে ৩ নভেম্বর মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে একটি 'রক্তপাতহীন' অভ্যুত্থান ঘটান। তিনি চেয়েছিলেন ১৫ আগস্টের পরিকল্পনাকারী এবং হত্যাকারীদের হটিয়ে '৭১ এর চেতনায় পুনরায় দেশকে একত্রিত করতে, প্রাথমিকভাবে তিনি সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৩ দিন। বস্তুত রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানই মাত্র তিনদিনের মাথায় তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।  

কী ঘটেছিলো?
খালেদ মোশাররফ একটা পরিবর্তন চেয়েছিলেন, কিন্তু হত্যাকাণ্ড চাননি। রক্তপাতহীন ক্যু করতে গিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তাঁর নিজ বাসভবনে গৃহবন্দি করেন। কর্নেল (অব.) আবু তাহের সে সময় চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। লক্ষ্য করুন, এই ৭ নভেম্বরের ঘটনায় আলোচিত তিন নাম- খালেদ মোশাররফ, জিয়াউর রহমান এবং আবু তাহের, তিন জনই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন।

যাই হোক ঘটনায় ফিরে আসি, কর্নেল তাহের ছিলেন জিয়াউর রহমানের বন্ধুস্থানীয় এবং একজন বিশেষ শুভাকাঙ্ক্ষী। কর্নেল তাহের সারা জীবন সমাজতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করে গেছেন। সৈনিক-অফিসার বৈষম্য তাঁর পছন্দ ছিলনা। তাঁর এই নীতি এবং আদর্শের জন্য তাহের সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিকদের মাঝেও দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন। কর্নেল তাহের বিশ্বাস করতেন জিয়াও তারই আদর্শের লোক।

জিয়াউর রহমানকে খালেদ মোশাররফ এর নির্দেশে তাঁর বাসভবনে বন্দি করে রাখেন তরুণ ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ। জিয়ার বাসার টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ একটি ভুল করেন। তিনি ভুলে যান বেডরুমেও একটি টেলিফোন আছে। জিয়া কৌশলে বেডরুম থেকে ফোন করেন তাহেরকে। খুব সংক্ষেপে বলেন "সেভ মাই লাইফ"।

তাহের জিয়ার আহবানে সাড়া দেন। তিনি ঢাকাতে তার অনুগত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহিদের পাল্টা প্রতিরোধ গড়ার নির্দেশ দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা রওনা হন, এ সময় তার সফর সঙ্গী ছিল শত শত জাসদ কর্মী। মূলত ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মূলে ছিল জাসদের সশস্ত্র শাখা। এই বিদ্রোহের মাধ্যমেই প্রথম “বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা” এবং “বিপ্লবী গণবাহিনী” প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করে। দুটি সংগঠনই মুক্তিযুদ্ধে দোর্দণ্ড প্রতাপে নেতৃত্বদানকারী-অংশগ্রহণকারীদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। তৎকালীন সিনিয়র সামরিক অফিসারদের অনেকেই বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত ছিলেন, এবং বিদেশি গোয়েন্দাদের সঙ্গেও যোগসাজশ ছিল তাদের। যারা ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেক সাধারণ সিপাহি ছিলেন। কর্নেল তাহেরের এই পাল্টা অভ্যুত্থান সফল হয় ৭ নভেম্বর। কর্নেল তাহের, জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। ঐ দিনই পাল্টা অভ্যুত্থানে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা জেনারেল খালেদ মোশাররফকে হত্যা করে।

জিয়াকে মুক্ত করতে তাহের টু ফিল্ড আর্টিলারিতে পৌঁছালে জিয়া এগিয়ে এসে তাহেরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। জিয়া তাহেরকে বলেন, “তাহের, ইউ সেভড মাই লাইফ, থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।” তাহের বলেন, “আমি কিছুই করিনি, করেছে এই সিপাহিরা। অল ক্রেডিট গোজ টু দেম।”

এরপর তাহের বসেন জিয়ার সঙ্গে আলাপে। কিভাবে তারা এই বিপ্লবটি সংগঠিত করেছেন তা জিয়াকে বিস্তারিত জানান। তাহের জিয়াকে পরের দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটা সমাবেশ করা এবং তাতে বক্তৃতা দেবার কথা বলেন। বক্তৃতার কথা শুনতেই জিয়া বেঁকে বসে। রেডিওতেও যেতে অস্বীকৃতি জানালেও পরে ক্যান্টনমেন্টেই রেকর্ড করা জিয়ার একটি বক্তৃতা প্রচার করা হয়েছে রেডিওতে। সেখানে জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেছেন। সিপাহীদের অভ্যুত্থানের কথা বললেও বক্তৃতায় জিয়া কোথাও অভ্যুত্থানের পেছনে জাসদ কিংবা কর্নেল তাহেরের কথা উল্লেখ করেননি।

পরবর্তী ঘটনা আমাদের সবার জানা, জিয়াউর রহমানের সরকারের আমলে দায়েরকৃত এক মিথ্যা হত্যা মামলায় সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই তাহেরকে ফাঁসি দেয়া হয়। কিছু তথ্য জানিয়ে রাখা প্রয়োজন মনে করছি, ১৭ জুলাই বিশেষ সামরিক আদালতে রায় ঘোষণার মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তড়িঘড়ি করে গোপনে কার্যকর করা হয়। যে ১২১ (ক) ধারায় কর্নেল তাহেরকে সাজা দেওয়া হয়েছিল তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি নির্দিষ্ট ছিল যাবজ্জীবন পর্যন্ত। কর্নেল তাহেরের মৃত্যুর ১০ দিন পর ৩১ জুলাই সামরিক অধ্যাদেশ জারি করে যাবজ্জীবনের স্থলে মৃত্যুদণ্ড বসানো হয়। একজন পঙ্গু ও বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুদণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম যা একটি ঠাণ্ডা মাথার খুন।

তথ্য সাহায্য:
উইকিপিডিয়া, এবং ‘অসমাপ্ত বিপ্লব’ লরেন্স লিফশুলৎজ

এনামুল হক এনাম, কলামিস্ট, সাহিত্যিক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ