প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আলমগীর শাহরিয়ার | ০৯ নভেম্বর, ২০১৭
I disapprove of what you say, but will defend to the death your right to say it - Voltaire.
জন্মান্ধ, বুদ্ধি ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি মানবিক সমাজে অনেক কিছুই করার থাকে। কিন্তু সমাজে যারা নকল বুদ্ধি ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী সেজে আছে এদের জন্যে কী করার আছে? এ রকম কিছু নকল বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের অসুস্থ চিন্তার ফসল সমাজে আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দীর্ঘদিন বিতর্ক করেছি। জেনেছি বিতর্ক একটি ইতিবাচক শব্দ। যার গঠনমূলক উদ্দেশ্য রয়েছে। একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর লক্ষ্য থাকে। বিতর্ক যেকোনো সুস্থ সমাজের লক্ষণ। বিতর্ক না বলে বিষয়টিকে বরং কুতর্ক বলি।
সম্প্রতি সমাজে এ কুতর্ক দুরারোগ্য ব্যাধির মত বিস্তার লাভ করছে কিছু অসুস্থ মস্তিষ্কের কুবুদ্ধির ফলে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে এদেশের লাখ লাখ তরুণদের জাগরণের সময় একজন ‘বাই চান্স’ সম্পাদকের কুবুদ্ধির ফলে এ কুতর্ক বেশ গাঢ় হয়। সময়ের পরিক্রমায় যা সমাজ স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, জগতের সকল সৃষ্টির মধ্যে আমার প্রথম পরিচয় আমি একজন মানুষ। স্থানিক বা ভৌগলিক অবস্থানের কারণে আমার নাগরিক পরিচয় আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা। একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করার ফলে জন্মসূত্রে ও ধর্ম পরিচয়ে একজন মুসলিম।
আমরা জানি, ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় সভ্যতার উৎকর্ষতার মূলে রয়েছে অজস্র মননশীল, চিন্তাশীল মানুষের শ্রম, ঘাম, অপরিমেয় ত্যাগ তিতিক্ষা। হররোজ না পারলেও আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে তাদের অবদানকে স্মরণ করি। সমাজের প্রায় সবাই বিজ্ঞান ও প্রগতির সমস্ত সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। পোশাক পরিচ্ছেদ থেকে শুরু করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বশেষ সকল ফসল। মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট কিছুই বাদ পড়ে না। সভ্য সমাজের কেউ এসব ছাড়া আধুনিক জীবন এখন কল্পনা করতে পারেন না।
আমরা আমাদের দিনযাপনের সবকিছুতেই আধুনিকতার ছোঁয়া চাই। কিন্তু পরিতাপের বিষয় বাহ্যিক ব্যবহারে আমরা আধুনিক হলেও মন মগজে আচরণে অনেকেই সযতনে লালন করে একজন অনাধুনিক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, প্রগতি বিরোধী মানুষের ভৌতিক ছায়া। সেই মগজের গভীর অসুখের পরিচয় পাওয়া যায় বিভিন্ন সমাজ-রাজনৈতিক সংকট কালে। এসব সংকট কালে আমরা চারপাশে অনেক গুহাবাসী মানুষের মুখোশ খুলে যেতে দেখি।
ধরুন, কুৎসা রটনাকারীদের প্রায়ই বলতে শুনি জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক জাফর ইকবাল একজন নাস্তিক। শুধু জাফর ইকবাল না আরও অনেকের বিরুদ্ধেই এই সচেতন মিথ্যাচার চলছে অনেকদিন ধরে। এই মিথ্যাচারের পেছনে রাজনীতি আছে। জাফর ইকবাল এদেশের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়। তিনি দেশের জ্ঞান পিপাসু তরুণ-তরুণীদের মধ্যে উৎকর্ষ বৃদ্ধির সকল কার্যক্রমের সঙ্গে নিজেকে জড়িত রাখেন। মেধাভিত্তিক আলোকিত একটি প্রজন্মের স্বপ্ন দেখেন। এটাই তাঁর অপরাধ!
জাফর ইকবাল ও হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখির সঙ্গে স্কুলজীবন থেকে পরিচয়। আজ পর্যন্ত কোথাও নাস্তিকতাবাদ বা ঈশ্বর, আল্লাহ, ভগবান বিরোধী কোন লেখা আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। জাফর ইকবাল মূলত ছোটদের জন্য লেখালেখি করেন। সায়েন্স ফিকশনের একজন জনপ্রিয় লেখক। লাখ লাখ ছেলেমেয়েরা তাঁর লেখার একনিষ্ঠ পাঠক। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ বিনির্মাণে তিনি বিশ্বাস রাখেন। সে লক্ষ্যে কাজও করেন। এদেশে রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনীর যারা রাজনৈতিক উত্তরাধিকার, যারা এদেশের মুক্তিযুদ্ধে আস্থা রাখে না, জ্ঞান ও প্রগতি ভাবনার বিপরীতে যাদের অবস্থান-জাফর ইকবালে তাই তাদের ভীষণ ভয়। জাফর ইকবালসহ এরকম অন্যান্যদের বিরুদ্ধে সচেতন কুৎসা রটনার ভাবাদর্শিক রাজনীতির এটাই নেপথ্য কারণ।
বিশ্বের ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যা নিয়ে আমেরিকার বিখ্যাত গবেষণা ও জরিপ প্রতিষ্ঠান 'পিউ ফোরাম' ‘The Global Religious Landscape’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিশ্বে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা দুশো কোটির (বিশ্ব জনসংখ্যার ৩১.৪) উপরে, মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা দেড়শ কোটির(২৩.২ভাগের) উপরে, আর যারা কোন ধর্মে বিশ্বাস করে না অর্থাৎ নাস্তিকের সংখ্যা একশো কোটির(১৬.৪) উপরে। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা তারও কম। এ দেশে অনেক উগ্র ধর্মানুসারীরা বিশ্বাস করেন নাস্তিককে হত্যা করা জায়েজ।
কোন সভ্য মানুষ নিশ্চয়ই পৃথিবীর একশ কোটি মানুষকে হত্যার স্বপ্ন দেখে না। যেখানে আমাদের ইসলাম ধর্মই বলেছে, একজন মানুষকে হত্যা করা সমগ্র মানবজাতিকে হত্যার সমান। কেউ যদি ধর্মে অবিশ্বাস করে বিশ্বাসীরা তার কাছে ধর্মের দাওয়াত নিয়ে যেতে পারে। গ্রহণ না করলে তাকে হত্যা করে ফেলতে হবে-এমন আদিম, অসভ্য, বর্বর চিন্তার বিরুদ্ধে মানুষের অবস্থান নেয়াই স্বাভাবিক।
নাস্তিক, মুরতাদ আখ্যা দিয়ে কাউকে হত্যা করা উগ্রপন্থীদের কাছে এখন সবচেয়ে সহজ তরিকা। ইসলাম কি সত্যই তা বলে? পৃথিবীর কোন ধর্মই কি তা বলে? যারা ইসলামের নামে হত্যার ডিলারশিপ নিয়েছেন, ধর্মের নামে বিশ্বব্যাপী নৃশংস হত্যাকাণ্ডে পুলকিত বোধ করছেন তারাই ইসলামের, ধর্মের বদনাম করছেন। অপরিমেয় ক্ষতি করছেন। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী বিভীষিকা, ভয় ও ঘৃণা ছড়াচ্ছেন। ফলে ইউরোপ আমেরিকায় এ মুহূর্তে ইসলামোফোবিয়া যে কোন সময়ের চেয়ে ভয়াবহ মাত্রার এবং উদ্বেগজনক পর্যায়ের।
দিনদিন এশিয়া, আফ্রিকায় মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলো থেকে অভিবাসন প্রক্রিয়া জটিল হয়ে যাচ্ছে। যা দীর্ঘমেয়াদে উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তির লেনদেন, শ্রমবাজার, রেমিটেন্স আহরণে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
মাদার তেরেসার একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শেষ করি। তিনি বলেছিলেন, “আমরা যদি দৃশ্যমান মানুষকে ভালো না বাসতে পারি অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসবো কেমন করে”। আসুন বুদ্ধি ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী সেজে নয়; মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির নয়ন মেলে জগত সংসারে আসল সোনার মানুষ খুঁজি। মানুষ ভজলে নাকি সোনার মানুষ পাওয়া যায়।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য