আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

প্রিয় অর্ঘ্য, তোমার কাছে ক্ষমা চাই!

জফির সেতু  


‘‘প্রিয় বাংলাদেশ,
আশা করি ভালো আছ। তোমার মেরুদণ্ডহীন সিস্টেমের কাছে শেষপর্যন্ত হার মানলাম। বোকার মতো শিরদাঁড়াটা সোজা রেখে জীবনটা পার করার যে-জেদ ছিল সেটা তোমার মেরুদণ্ডহীনতার তন্ত্রে হার মেনে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতি থেকে এবং সিজিপিএ’র জন্য পড়াশোনা করে মেধাবী তকমা পাওয়া কিংবা দুর্ঘটনায় বা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর পর মিডিয়ার প্রচারের স্বার্থে মেধাবী খেতাব নেওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। শুধু শুধু গাধার মতো কোনো ইস্যু পেলে চেঁচিয়ে বারবার তোমার মেরুদণ্ডহীনতা বোঝানো ছাড়া বোধ হয় আমি আর কিছু পারতাম না।

তোমার মেধাবী সূর্যসন্তানদের দেখে আমার বড়ো আফসোস হয়। দেখ, কীভাবে তারা তাদের মেধাগত যোগ্যতাবলে তোমার সিস্টেমের সাথে সুন্দরভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। তারা আমাদের কী বলে জানো? যুক্তিবাদী বেয়াদব। আমরা ডিপার্টমেন্ট-এর বদনাম করি, দল করে সুন্দর-সাজানো একটা ডিপার্টমেন্টকে নষ্ট করি। সিনিয়র ভাইদের সাথে ঘুরে ঘুরে স্যারদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করি।

কাল সারারাত অনেক ভাবলাম, বুঝলে। সত্যি বলতে কী, আমার এখন মনে হচ্ছে আমরা, এই ‘যুক্তিবাদী বেয়াদবেরা’ আসলেই তোমার ক্ষতি করছি। পদ্মা ব্রিজ হচ্ছে, দেশে কর্মসংস্থান বাড়ছে, আধুনিকায়ন হচ্ছে। সুশাসন এবং আইন ব্যবস্থায় গুম, হত্যা, সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে, কোটি কোটি টাকা লোপাট হওয়ার পরও মন্ত্রী মহোদয় সেটা হাতের ময়লার মতো উড়িয়ে দেন। প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। দলীয় এবং নিয়োগবাণিজ্যের কল্যাণে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা বিশালসংখ্যক ডিপ্রেসড শিক্ষার্থী তৈরি করছেন। গর্ব করার জন্য বহির্বিশ্বে তোমার বংশদ্ভূত সন্তানেরা রয়েছেন, যারা নিজেদের উন্নতির স্বার্থে তোমাকে ত্যাগ করে অন্যদেশকে আপন করে নিয়েছে।

তোমার মেরুদণ্ডহীন বিদ্বান সূর্যসন্তানেরা তোমার এত উন্নতি করছে, সেখানে আমি তোমার কী উপকার করছি বল? তোমার টাকায় পড়ে, খেয়ে তোমার সিস্টেমের বিরোধিতা করছি, তোমার সাথে বেইমানি করছি। দেখে নিও, আর করব না। সেদিন ভিসি স্যার এবং চেয়ারম্যান স্যারের কাছে মাফ চাইনি। আজ তোমার কাছে মাফ চাইছি। তোমার আর কোন ক্ষতি করব না। আর তোমার বিরোধিতা করব না। সোজা হওয়া এই মেরুদণ্ড ভেঙে নোয়াতে পারব না। সেটা আমার দাঁড়া হবে না। সেজন্য অন্য পথটা বেছে নিলাম।

ভয় পেয় না। ধর্মান্ধতায় অন্ধ, ক্ষমতাবলে ভীত, অর্থমোহে ঘুমন্ত এই বালির নিচে মাথা ঢুকিয়ে থাকা উটপাখিসদৃশ জাতি কোনোদিনও তোমার ভেঙে-পড়ে-থাকা মেরুদণ্ড সোজা করার চেষ্টা করে তোমাকে যন্ত্রণা দিবে না। আমার মতো যেসব ‘বেয়াদবেরা’ তোমার সিস্টেম বাগের কারণে ভুল করে জন্মেছে তারাও আস্তে আস্তে তোমার সিস্টেমের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। আশা করি পৃথিবীতে তুমি তোমার উন্নতির ধারা বজায়ে রাখবে। ভাল থেক।

ইতি

‘যুক্তিবাদী বেয়াদব।’’


আত্মহননের আগে ওপরের চিঠিখানি লিখে গেছে আমাদের দেশের এক সূর্যসন্তান অর্ঘ্য। গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিল অর্ঘ্য বিশ্বাস। যে-কারণে সে আত্মহত্যা করেছে, চিঠিতে স্পষ্ট করে লিখেও গেছে। অর্ঘ্য সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে আত্মোৎসর্গ করেছে। এইটুকু জীবনে যে-সিস্টেমের বেড়াজাল তাকে নাড়া দিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে; তা হচ্ছে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার মতো উপস্থিতি তার ছিল না। সে-জন্য কর্তৃপক্ষ তাকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়নি। এবং এর অন্তরালে আরও যে ঘটনা ছিল তাও সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে। যা অতি দুঃখজনক। কিন্তু অর্ঘ্য আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেছে; সে কখনো আর ফিরে আসবে না। যদিও তার এ-যাওয়াটা একবারেই অপ্রত্যাশিত আর কোনোভাবেই তা মেনে নেওয়াও যায় না।

অর্ঘ্যের এই চলে যাওয়াটা নিঃশব্দে কিন্তু নয়। সে জানান দিয়ে গেছে; আশপাশের মানুষের মুখোশও উন্মোচন করে গেছে। প্রতিষ্ঠানের যথেচ্ছারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। অর্ঘ্য আপোস করেনি। ক্ষমা চায়নি। এই আপোস না-করা কিংবা ক্ষমা না-চাওয়ার মধ্যেও একটা বার্তা দিয়ে গেছে। সেটা খুুবই তাৎপর্যবহ। অর্ঘ্য স্পষ্টভাবে বলেছে ‘মেরুদণ্ড’ ও ‘মেরুদণ্ডহীনতা’র কথা। সে লিখেছে কীভাবে একটি জাতি তার মেরুদণ্ড হারাচ্ছে কিংবা হারিয়ে ফেলছে। তার জবানিতে এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। যদি কোনো জাতির মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যায় কিংবা হারিয়ে যায়; তাহলে সেজাতি কখনোই দাঁড়াতে পারে না কিংবা সামনে এগিয়ে যেতে পারে না। সুতরাং মানুষ হিসেবে এবং স্বাধীনসত্তার অধিকারী হিসেবে অর্ঘ্য এটা মানতে পারেনি। এই মানতে না-পারাটা খুব স্বাভাবিক এবং প্রতিবাদ করাটাও। এটা তার ব্যক্তিত্বের প্রকাশও। অর্ঘ্য মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে চেয়েছে; স্বপ্ন দেখেছে, মানুষ হিসেবে বাঁচতেও চেয়েছে। কিন্তু পারেনি। তার বিবেচনায় অরাজক সিস্টেমের সঙ্গে সে খাপ খাওয়াতে পারেনি; পারছে যেভাবে অন্য মেধাবীরা। তাকে বরং এই সিস্টেম মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ই তার জীবনের কাল হয়েছে। অথচ সে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিল বুকভরা আশা ও স্বপ্ন নিয়ে। বুঝাই যায়, অর্ঘ্যরে স্বপ্ন ছিল যেমন নিজেকে নিয়ে; তেমনি গোটা জাতিকে নিয়েও। কিন্তু লড়াইয়ে হেরে গেল অর্ঘ্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যি কি হেরে গেল সে?


এদেশের মানুষের ঘাম আর রক্ত দিয়ে বানানো হয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ইট আর ধুলিকণার সঙ্গে এদেশের জনগণের উপার্জন মিশে আছে। যেসব নিঃস্ব ও গরিব মানুষের সন্তান কখনোই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না কোনোদিন, তারাও নিজের অজান্তেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় জুগিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তাতে এই গরিব মানুষদের আফসোসও নেই। দেশ এগোলে বরং তারা বেজায় খুশি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কিছু মানুষকে কর্মের সংস্থান করেও দেয়; কিছু মানুষ চাকরি পায়। এদের কেউ সুযোগ্য, কেউ-বা অযোগ্য। সুযোগ্য বা অযোগ্য অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠের ভেতরে ঢুকেই যে-সমস্ত কর্মকাণ্ড করেন, তার বলি হন অর্ঘ্যরে মতো স্বপ্নবান ও স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিক শিক্ষার্থীরা। এদের মারখাওয়া জীবনের গল্প কেউ কখনো জানতে পারে না; যদি-না অর্ঘ্যের মতো কেউ প্রতিবাদ করে বসে; বা জানান দিয়ে যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অর্ঘ্য দুটি মারাত্মক অভিযোগ এনেছে; সেগুলোর একটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় ও নিয়োগবাণিজ্যের মাধ্যমে শিক্ষকনিয়োগ; এবং অন্যটি, শিক্ষক-কর্তৃক ‘ডিপ্রেসড’ শিক্ষার্থী তৈরি। এই কথাগুলো সূর্যালোকের মতো সত্য। এমন সত্য আজকাল বাংলাদেশে অনেকেই উচ্চারণ করতে পারেন না; বিশেষত যারা শিক্ষার্থী। অর্ঘ্যও পারেনি; পারেনি, কিন্তু বলতে চেয়েছে। এবং বলার জন্য, তাকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিতে হয়ে হয়েছে। অর্ঘ্যরে এই সত্যকথন কতটা সত্য, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ও বাইরের অনেকেই জানেন; কিন্তু গা করেন না, রা দেন না। দেন না বলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান যেভাবে পড়ে যাচ্ছে, তেমনি উপযুক্ত প্রজন্মও তৈরি হচ্ছে না। উপরন্তু প্রজন্মকে আমরা অন্ধকার তিমিরে পাঠিয়ে দিচ্ছি, ক্রমশ মেরুদণ্ডহীন করে তুলছি; যে-মেরুদণ্ডকে অর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে।
ক্ষোভে ও দুঃখে প্রয়াত বুদ্ধিজীবী হুমায়ুন আজাদ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বলতেন ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়’। তিনি এটা বলতেন জ্ঞানচর্চার দারিদ্র্য দেখে। আজকের পরিস্থিতিতে তিনি কী বলতেন, একমাত্র ঈশ্বর জানেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞানচর্চার দারিদ্র্যের চেয়েও বড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষার্থীদের ডিপ্রেশন। এটা স্পষ্ট করে জানান দেওয়া দরকার বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়েই একটা বড়ো আকারের শিক্ষার্থী হতাশ ও মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে; এরা নানা কারণে ডিপ্রেসড। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিস্টেম, পড়ানো, ফলাফল, শিক্ষকের অশিক্ষকসুলভ আচরণ ইত্যাদিতে ভুক্তভোগী হয়ে। দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে যে-ছেলে বা মেয়েটি একটা সিগোরেটেও মুখ দেয় দেয়নি; বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সে নীল দংশনে আক্রান্ত হয় প্রতিনিয়ত। আমি নিজ চোখে আমার বিভাগের ছাত্রকে দেখেছি গাঁজায় আসক্ত হয়ে কীভাবে তলিয়ে গেছে তার গোটা শিক্ষাজীবন।

শুধু যে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কারণেই কোনো তরুণ হতাশাগ্রস্ত হয়, তা কিন্তু নয়। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে তাদের একটা অংশের হতাশার কারণ খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ই। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন, শিক্ষকদের অবজ্ঞা, অবহেলা বা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ডিপ্রেশনের প্রধান একটা কারণ হয় অনেকের জীবনে। যে-শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনের দরোজা দিয়ে ঢুকেন; কিংবা যে-শিক্ষকের শিক্ষাজীবনই দুর্নীতিগ্রস্ত তার পক্ষে শিক্ষকতা তো একটা চাকরি; ক্ষুণিœবৃত্তির উপায়। আসলে এমন শিক্ষকের শ্রেণিকক্ষে দেওয়ার কিছু নেই; ফলে তার পক্ষে ছাত্রদের নিয়ে রাজনীতি করাই সম্ভব; কিংবা অন্য অনেক ধান্দায় ব্যস্ত থাকেন তিনি। কেননা তিনি এসেছেন দুর্নীতির পিচ্ছিল পথ ধরে। তার পক্ষে জ্ঞানচর্চা ও বিতরণ নয়, রক্তখেলাই আসল খেলা; নিজেকে রক্ষা করার একমাত্র কৌশল। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা শিক্ষকতাকে চাকরি মনে করা হয়; অথচ শিক্ষকতা তো আসলে একটা ব্রত। যারা বই মুখস্ত করে প্রথম হন, কিংবা যারা টাকা দিয়ে চাকরি কেনেন, কিংবা যারা রাজনীতির সুতোয় ভর করে চাকরিতে আসেন; এরাই মূলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিষিয়ে তুলছেন সর্বত্র।

আমি যতটা বুঝি, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগের সিস্টেমে গলদ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা পদ্ধতিতেও। আমাদের পরীক্ষাপদ্ধতি অনুযায়ী ভালো ছাত্রকে কখনোই চিহ্নিত করা সম্ভব হয় নয়। এর প্রমাণ আমাদের প্রশ্নের ধরন। যারা মুখস্থ করে, যারা নকল করে; কিংবা যারা প্রশ্ন হাতে পেয়ে যায়, তাদের অনেকেই পরীক্ষায় প্রথম হয়ে যেতে পারে। আবার প্রথম বা দ্বিতীয় হলে কিংবা ভালো সিজিপিএ পেলে চাকরির ক্ষেত্রে বড়ো সম্ভাবনা তৈরি হয়, বেশিরভাগ পায়ও। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় জানল না রেজাল্টধারীটা আসলে কত বড়ো একটা ‘আপদ’। বিশেষ করে মানবিকবিদ্যা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিষয়গুলোতে ‘ক-অক্ষর গোমাংস’ শিক্ষার্থী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তথাকথিত ‘ভালো ফলাফল’ করে। এদের মূল পুঁজি হচ্ছে উদ্ধৃতি, টীকাটিপ্পন্নী ও ভালো হাতের লেখা ইত্যাদি। যদিও মাস্টারির ‘চাকরি’-ভিন্ন জাতীয় জীবনে এদের বিশেষ কোনো অবদান থাকে না। আমি শিক্ষকতায় এসে দেখেছি, দেখেছি ছাত্র জীবনেও; যে-সব শিক্ষার্থী বেশি বই পড়ে, চিন্তা করতে শেখে এবং সৃষ্টিশীল; তারাই বরং পরীক্ষায় ‘খারাপ ফল’ করে। আর পরবর্তীকালে, রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে এদেরই অবদানই থাকে সবচেয়ে বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে কর্তৃপক্ষ এদের বাছাই করতে পারে না বলে; প্রজন্ম বঞ্চিত হয়, দেশের ক্ষতি হয় বেশি পরিমাণে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নের ধরনই এমন যে, শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার আগে ঠিক ধারণা করতে পারে কোন প্রশ্নগুলো পরীক্ষায় আসবে; আর এসব প্রশ্নের সমাধান করতে সময় লাগে বড়ো জোর একমাস; এবং প্র¯ুÍতি নিতে আরও একমাস; বাকি দিনগুলো হাজিরার জন্য শ্রেণিকক্ষে ঝিমানোর। এই পরিসংখ্যান কিন্তু বেশিরভাগকে নিয়েই।


যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়েও পড়ানোর যোগ্য নন; কিংবা যাদের মানসিকতা শিক্ষকসুলভ নয় তাদের পক্ষে সবই সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি হয়ে ওঠে এদের মৌরোসি পাট্টা। বাহাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে-সম্মান ও স্বাধীনতা দিয়েছিলেন; বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা ধুলায় লুণ্ঠিত হয়েছে আজ। স্বাধীনতা পরিণত হয়েছে স্বেচ্ছাচরিতায়। একজন শিক্ষক চাইলেই শিক্ষার্থীর জীবনে ‘বারোটা’ বাজিয়ে দিতে পারেন; দেনও। মানবিকবিদ্যার বিষয়গুলোতে একজন শিক্ষক কেউ ভালো লিখলেও ‘আন্ডার মার্কিং’ করতে পারেন; আবার ‘ওভার মাকিং’ও। এর কারণ, শিক্ষকের নিজের বিবেচনা। এই বিবেচনার কিন্তু কোনো মানদণ্ড নেই। কোনো শিক্ষার্থী টার্মটেস্টের খাতায় কিংবা পরীক্ষার খাতায় কম নম্বর পেয়ে শিক্ষককে এর কারণ জিজ্ঞেস করতেও সাহস পায় না। ছাত্রশিক্ষকের সম্পর্ক এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশে। যদি-বা ‘কম্প্রবক্ষে, নম্র নেত্রপাতে’ দাঁড়ায়ও কেউ; সে হয়ে ওঠে ‘বেয়াদব’। কিংবা শ্রেণিকক্ষে প্রশ্ন করলেও পরীক্ষার খাতায় ‘দেখে নেন’ কোর্স শিক্ষক। অর্ঘ্য ছিল সে-রকম এক ‘বেয়াদব’। চিঠির নিচে, এটা উল্লেখও করেছে অর্ঘ্য।
আমার এক ছাত্র; যে নিজে এখন একজন শিক্ষক; মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে এসে বলল, স্যার; আমার টার্মটেস্ট ও উপস্থিতির ফলাফল দেখে আমি অশ্চর্য হলাম! আমি ভালো পরীক্ষা দিয়েও দশের মধ্যে চার পেয়েছি; আর উপস্থিতির বেলায়, ছত্রিশটি উপস্থিতির মধ্যে দুইটিতে অনুপস্থিত থাকলেও আমাকে দেওয়া হয়েছে পঞ্চাশভাগ উপস্থিতি; মানে আমি ‘শূন্য’ নম্বর পেয়েছি। আমি বললাম, তুমি স্যারকে বলো। সে, বলল, আমি তা বলেওছি; কিন্তু স্যার বলেছেন; আমি একটা ‘বেয়াদব’! শুধু তা-ই নয়; সে জানায়; ওই শিক্ষক পছন্দ করেন এমন শিক্ষার্থীদের শতভাগ উপস্থিতিও দিয়েছেন; যদিও ওরা বেশিরভাগ ক্লাশে উপস্থিত ছিলই না; আর টার্মটেস্টের কথা তো বলেও লাভ নেই। এটা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বেচ্ছাচারিতার নমুনা। এই স্বেচ্ছাচারিতা শিক্ষার্থীদের হতাশায় নিমজ্জিত করে। কেউ কেউ এরূপ হতাশা থেকে বেরিয়ে আসতেও পারে না। শিক্ষকরা এখানে রক্ষক হয়েও ভক্ষক হয়ে ওঠেন। কিন্তু সকল শিক্ষক তো আর এমন নন; তাহলে ‘দুষ্ট’ শিক্ষকের দায় মহান শিক্ষকরা নিতে যাবেন কেন? আর রাষ্ট্রই-বা এইসব ‘দুষ্ট’দের লালন-পালন করবে কেন? এটা আমাকে প্রতিনিয়ত ব্যথিত করে।

অর্ঘ্যরে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি ও পরীক্ষা না-দিতে পারা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন দেশের প্রধান একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য মহোদয়। তিনি ছাত্রদের উপস্থিতি নিয়ে অভিযোগ করেছেন খোদ শিক্ষকের ওপর। আমি তার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সহমত পোষণ করি। উপাচার্য মহোদয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেছেন, ‘একজন শিক্ষক ক্লাশে কিছুই পড়াতে পারেন না, বসে বসে গল্প করেন। তার ক্লাশে কেন শিক্ষার্থীদের বসে থাকতে হবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমরা তো বসে থাকিনি। যে-শিক্ষকরা ভালো পড়ান তাদের ক্লাশ করতে অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাও চলে আসে। এটেন্ডেন্সের এই সিস্টেমটাই বাদ দেওয়া দরকার।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘একটা বাজে ছাত্র যে-কোনো দিন একটা বই ধরে দেখেনি সেও এটেন্ডেন্সে দশে দশ পেয়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার ক্লাশ না-করেও শিক্ষকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে দশ পেয়ে যাচ্ছে। এই দশ নাম্বার রেজাল্টের ওপর বিরাট প্রভাব ফেলে। এই দশ নাম্বার থাকা উচিত না। প্রকৃত মেধাবীরা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা তা ভেবে দেখার সময় হয়েছে।’

এখন কথা হচ্ছে, একজন শিক্ষার্থী তো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিই হয় ক্লাশ করার জন্য; শ্রেণিকক্ষ ত্যাগ করার জন্য নয়। তাহলে, তারা কেন শ্রেণিকক্ষ ত্যাগ করে? উপাচার্য মহোদয়ের কথায় বিষয়টা স্পষ্ট যে, শিক্ষকরা ক্লাশে ধরে রাখতে পারেন না বলেই শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষত্যাগে বাধ্য হয়। আর দোষটা পড়ে শিক্ষার্থীদের ওপরেই। উপস্থিতির নম্বরটাও তিনি স্পষ্ট করেছেন। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি; এমন শিক্ষক আছেন, শ্রেণিকক্ষে এসে মোটে তিনি সময় দেন ২০-২৫ মিনিট। আর একটি উপস্থিতির জন্য হয়ত সত্তরজন শিক্ষার্থীর ব্যয় হয়েছে পুরো আধবেলা। শিক্ষার্থী ভয়ে থাকে এই নম্বরের জন্য। যদিও এই ক্লাশ তার জন্য লাভের চেয়ে ক্ষতিগ্রস্তই করে বেশি। ফলে সত্যি ভাবার সময় এসেছে উপস্থিতির ব্যাপারে। শিক্ষার্থী যদি মনে করে; কোনো শিক্ষকের ক্লাশ বোরিং; জানার বিশেষ কিছু নেই; উপরন্তু ‘টাইম লস’, তাহলে সে লাইব্রেরিতে বসে রবীন্দ্রনাথ বা আইনস্টাইনের সান্নিধ্য পেতে পারে সহজেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটাই কি কাম্য নয়?

উপাচার্য মহােদয়ের কথার সূত্র ধরে; যেসব শিক্ষক ক্লাশে পড়াতে পারেন না; গল্প করেন কিংবা নিজের ছাত্রজীবনের ভালো ফলাফলের গরিমায় ন্যুব্জ; তাদের ব্যাপারে সম্প্রতি ফেসবুকে আমার এক সহকর্মী চমৎকার ও যুক্তিসংগত স্ট্যাটাস দিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন যে, ‘একজন শিক্ষক ক্লাসে কিছুই পড়াতে পারেন না, বসে বসে গল্প করেন। তার ক্লাসে কেন শিক্ষার্থীদের বসে থাকতে হবে? বলি, এমন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় ক্যান?’ এই প্রশ্ন আমারও। কিন্তু এই প্রশ্নে জবাব দেবে কে?


শুরুতে অর্ঘ্যকে আমি ‘সূর্যসন্তান’ বলেছি। কারণ সে দেশকে ভালোবাসত; সে ছিল অসাম্প্রদায়িক, স্বাধীনচেতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে অনমনীয়। অর্ঘ্যরে মেরুদণ্ড সোজা ছিল; সোজা মেরুদণ্ড নিয়েই বাঁচতে চেয়েছিল। সে পালের গরু হতে চায়নি। সে ছিল সাহসী ও প্রতিবাদী। অর্ঘ্যরে চিঠি নিয়ে অনেক কথাই বলা সম্ভব। কিন্তু আমার দৃষ্টি ছিল এখানে বিশেষ একটি বিষয়ে। যে-বাংলাদেশে অর্ঘ্য জন্মেছিল; সে দীক্ষা নিয়েছিল এই জাতির জনকের কাছ থেকেই। ছাত্রও ছিল জনকের নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাই সে মাথা নুয়ায়নি। সে জানত কার কাছে মাথা নত করতে হবে, আর কার কাছে নয়। সে-চেয়ার যত বড়োই হোক। সে জানত চেয়ারের চেয়ে মানুষ বড়ো। তাই চেয়ারকে কুর্নিশ করার চেয়ে মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছে সে। মৃত্যুর আগে মাথা নুইয়েছে শুধু দেশমাতৃকার কাছে। বলেছে; যত শত বিপত্তির পরেও দেশ এগিয়ে যাবে সামনে, এটা তার বিশ্বাস। দেশের প্রতি জানিয়েছে শুভকামনা। যার ভেতরে এই শুভবোধ; এবং যার শিড়দাঁড়া এতটাই শক্ত সে-অর্ঘ্য কীভাবে আত্মহননের পথ বেছে নিল, আমার কাছে এটাই বিস্ময়। একজন শিক্ষক হিসেবে অর্ঘ্যরে কাছে ক্ষমা চাওয়া ভিন্ন আমি আর দ্বিতীয় পথ দেখছি না। অর্ঘ্য আজ যেখানেই থাক; তার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে তোলে; আর বাতাসের কানে কানে আমি বলি; প্রিয় অর্ঘ্য, তোমার কাছে ক্ষমা চাই! আমাকে ক্ষমা করে দাও তুমি।

জফির সেতু, কবি, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক। সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ