আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

Advertise

যেখানে ‘মাদার তেরেসা’, ‘শেরেবাংলা স্বর্ণপদক’ বিক্রি হয়!

আলমগীর শাহরিয়ার  

আপনি কি পুরস্কারাকাঙ্ক্ষী? অনেক তদবির করেও কোন পুরস্কার বা স্বীকৃতি পাচ্ছেন না? কিন্তু সমাজসেবী ও জনহিতৈষী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে একটা পুরস্কার বড়ো দরকার! সমাজসেবা, মানবাধিকার, সাহিত্য ও শিক্ষা যে কোন এক শাখায় হলেই চলবে। আগ্রহ আর উৎসাহ থাকলেই এরকম পদক কিনতে পাওয়া যায়। তবে সঙ্গে কিছু খরচাপাতি লাগে এই যা। ঢাকা থেকে 'আলোকিত বাংলাদেশ', 'সুন্দর আগামী', 'সম্ভাবনার বাংলাদেশ', 'একুশ শতকের স্বপ্ন' -এমন সব বাহারি নাম বা মহান কোন ব্যক্তির নামে প্রতিষ্ঠিত ভুঁইফোড় কোন সংগঠনের আমন্ত্রণপত্র পুরস্কারাকাঙ্ক্ষীর ঠিকানায় পৌঁছে যাবে। উদ্যোক্তারা নিজেরাই যোগাযোগ করবে গ্রহীতার সঙ্গে।

তারপর সুন্দর এক সকালে ঢাকার কোন এক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মিলনায়তনে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কারও হাত থেকে পদক নিয়ে সদর্পে ফিরে যাবেন নিজ এলাকায়। ভক্ত বা জনগণের দরবারে পৌঁছে দেবেন আপনার অর্জনের সুখ্যাতি। খানিকটা প্রযুক্তিজ্ঞান সমৃদ্ধ হলে তৎক্ষণাৎ ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনুসারীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেন এ মহা সুসংবাদ। পদকপ্রাপ্তদের মধ্যে নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিকের ভক্তরা রাতের আঁধারে আপনার টাকায় পোস্টার ছাপিয়ে বলবে, স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সমাজসেবক অমুক ভাইকে আগামী ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন বা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেখতে চাই। সৌজন্যে: সচেতন (পড়ুন, অচেতন) এলাকাবাসী।

নগরীর এক মিলনায়তনে এ রকম এক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার দুর্ভাগ্য হয়েছিল বেশ আগে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে এসেছেন অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। তারা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তালিকায় বেশিরভাগ নাম রয়েছে জনপ্রতিনিধিদের। দুঁদে ও ক্ষুদে যশাকাঙ্ক্ষী নেতাদের পাশাপাশি ইউপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, এমনকি জেলা পরিষদের প্রশাসকের নামও দেখলাম। লেখক, জীবনে যার নামই শুনিনি লেখা পড়া দূরে থাক এমন লেখক, সাংবাদিক দুয়েকজনের নামও শোনা গেল। তাদের কেউ এসেছেন সমাজসেবায়, মানবাধিকার, শিক্ষা, সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য পদক গ্রহণ করতে। একসঙ্গে এতো গুণীজনকে সংবর্ধনা দিতে আমি আগে আর দেখিনি। অনুষ্ঠানে আলোচনা বা নামেমাত্র মূল্যের পদক নয়, নগরীর সিটিং বাসে উঠার প্রতিযোগিতার মত করে সারি বেঁধে ফটোসেশনই যেন মুখ্য হয়ে দাঁড়াল। অনুষ্ঠান নয়, এ যেন সান্ধ্যকালীন কারফিউ জারি করা কোন গলির স্টুডিওতে বিকেলবেলা ফটোসেশনের এক কুৎসিত মহড়া!

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিমন্ত্রী। উদ্বোধক একুশে পদকপ্রাপ্ত একজন ভাষা সৈনিক, বিশেষ অতিথি একজন সাংসদ। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর অনুষ্ঠানের সভাপতি (সাবেক এক তথ্য সচিব) দায়িত্ব হস্তান্তর করে অকুস্থল ত্যাগ করেন এক টিভি প্রোগ্রামে যোগদানের অজুহাতে। 'মহান মে দিবস উপলক্ষে কর্মজীবী মানুষের প্রতি শেরে বাংলার ভূমিকা শীর্ষক আলোচনা সভা ও গুণীজন সংবর্ধনা অনুষ্ঠান' এই শিরোনামের এ সভার আয়োজন করে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক গবেষণা পরিষদ (উল্লেখ্য, মে দিবস শেষ হয়েছিল মাসাধিকাল আগেই)। সভায় শেরে বাংলার উপর কিছু অথর্ব এবং মূর্খের বয়ান ধৈর্য ধরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও শুনতে হয়েছিল অভ্যাগত সুধী হিসেবে। শুনলাম সরকারি, বেসরকারি কিছু অপ্রাসঙ্গিক কীর্তন। মূলধারার বাইরের কিছু অচেনা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিকস মিডিয়ার রিপোর্টার ও ফটো সাংবাদিকদের সরব আনাগোনা দেখলাম।

যার অনুরোধের ঢেঁকি গিলে এমন আয়োজন দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল মিলনায়তন থেকে বের হয়ে কোন ভণিতা ছাড়াই তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বিনিময়ে কতটাকা দিয়েছিলেন। উত্তরে জানালেন বেশি না। মাত্র হাজার পাঁচেক টাকা। শুনেছি অন্যদের কাছ থেকে আরও বেশি নিয়েছেন আয়োজকরা। আমি বললাম একটা অংক করেন ৫০০০ গুণন ৫০/১০০। ক্রেস্ট ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক খরচাবাদে সপ্তাহখানেক, দিন দশেক বা পক্ষকালের শ্রমে এ আয়, উপার্জন একেবারে মন্দ না! পদক গ্রহীতার কাছে জানতে চাইলাম, এ আয়োজন আর সমাগমের ধরন দেখে কিছু বুঝলেন? সহাস্যে ইতিবাচক উত্তর দিলেন আর পরোক্ষভাবে বুঝালেন ব্যাপার না। ভোটের বাজার বা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বা সম্মানের আকাল পড়া সময়ে এ বানোয়াট এ পদক অনেক দরকারি।

সম্প্রতি, এ ধরনের আয়োজন আরও চোখে পড়ল। দেখলাম সম্মাননা জানানো বা পদক প্রদানের নামে এ প্রতারণা বাণিজ্য নগরীতে থামছেই না। জোচ্চুরির এ বিশাল ব্যবসা এখন ঢাকায় রমরমা। নামে বেনামে অগণন সংগঠন খুলে এ ব্যবসা চলছেই।

অভিযোগ রয়েছে সরকারি দলের সঙ্গে সংস্রব রয়েছে বা সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে কিছু ব্যক্তিরা রয়েছেন এমন প্রতারণা বাণিজ্যের নেপথ্যে। সংগঠনের উপদেষ্টা হিসেবে কাগজপত্রে বা ব্যানারে নাম থাকছে সমাজে প্রতিষ্ঠিত কিছু ব্যক্তিবর্গের। যারা নিজেদের অজান্তেই বা জেনেই এই প্রতারক চক্রের সহায়তাকারী হিসেবে সম্পৃক্ত আছেন।

যে রাষ্ট্রের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় বিদেশী অতিথিদের পদক প্রদানের স্বর্ণে প্রায় ষোল আনাই প্রতারণা হয়, সে দেশে যেসব অভিনব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা (পড়ুন, বড় বড় প্রতারকরা) কোন ধরনের পুঁজি বিনিয়োগ ছাড়াই এ সহজলভ্য ব্যবসায় নেমেছেন-তাদের দেখবেন কে!

জাতির এক শ্রেষ্ঠ সন্তান শেরে বাংলা কিংবা মহীয়সী রমণী মাদার তেরেসা বা অন্য কোন মহান ব্যক্তিবর্গের নাম ভাঙ্গিয়ে নির্লজ্জ জোচ্চুরির এমন নজির জাতি হিসেবে আমাদের নৈতিক স্খলন আর দেউলিয়াত্বকে দিনকে দিন আরও নগ্ন করে বৈ কিছু নয়।

আলমগীর শাহরিয়ার, কবি ও প্রাবন্ধিক। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ