আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বর্ণবিদ্বেষের রকমফের ও রোহিঙ্গা সংকটের ছিন্ন ভাবনা

আলমগীর শাহরিয়ার  

“ওস্তাদ, বায়ে পেলাসটিক ডাইনে লন”-বলেই বাসটা একটু সামনে এগিয়েছে তারপরই একটা রিকশা বাগড়া দিল। বাসের হেল্পার আবার তার স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে বলল, ওই ‘রোহিঙ্গা’ দূর হ।

লোকাল বাসের এ অভিজ্ঞতাটা সাম্প্রতিক। এর বাইরেও নগরীতে আরও দু’এক জায়গায় রোহিঙ্গা শব্দের এমন বিদ্বেষমূলক ব্যবহার লক্ষ্য করলাম। রোমান ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসকে কী কেউ কানেকানে এ খবর মিয়ানমার-বাংলাদেশ সফরের আগেই বলেছেন? নাকি তিনি জেনে গিয়েছিলেন যে প্রতিভাবান বাঙালি জাতির কেউ কেউ রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর নাম ইতোমধ্যে গালি হিসেবে ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে! এ গোপন খবরের ভিত্তিতে তিনি হয়ত গোস্বা করে থাকতে পারেন। যে কারণে তাঁর পুণ্যমুখে বিতর্কিত 'রোহিঙ্গা' শব্দ ব্যবহারে এতো সংযত ছিলেন। যা মানবাধিকার কর্মীদের ক্ষুব্ধ করেছে। তারা পোপের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন।

ভ্যাটি-আমেরিকান, ইউরোপিয়ান বা তাবৎ পৃথিবীর ক্যাথলিক খৃস্টানদের ধর্মপ্রাণ রাজ-কূটনৈতিক অঙ্গনের প্রধান মুখপাত্রের লালখেলা (রেড ডিপ্লোম্যাটিক গেম) বা লীলাখেলা কি আমি নগণ্য জানি নে। তবু পোপ রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন।  এথনিক ক্লিনজিংয়ের শিকার এই বিপন্ন মানুষগুলোর পক্ষে আরও শক্ত অবস্থান তিনি নিতেই পারতেন।

পৃথিবীর সকল ধর্মের মানবতাবাদী বাণী আমাদের বিপর্যস্ত, বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেয়। ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফাঁদে পড়ে কাঁদা রোহিঙ্গাদের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে তাঁর শক্ত ভূমিকার খুবই প্রয়োজন ছিল। তবু ঢাকায় তাঁর পুণ্য পদধূলির জন্য আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

এপ্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, ছোটবেলা দেখতাম বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বাইরে থেকে এসে যারা সেটেলড হত তাদেরকে 'আবাদি' বা 'নোয়াখালী' বলে ডাকা হত। কুমিল্লা, নোয়াখালী ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষেরা সাধারণত সিলেট অঞ্চলে বেশি মাইগ্রেট করতেন। পেশায় তারা ছিলেন মসজিদ মক্তবের ইমাম-মোয়াজ্জিন, শিক্ষক, মাদ্রাসা পড়ুয়া তালেবে আলেম, কৃষি, মৎস্য ও শিল্প পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাছাড়া, ফসল তোলার মওসুমে দাওয়াল খাটতে যেতেন বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের মানুষেরা (অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধুর লেখায় এর উল্লেখ দেখতে পাই)।

আরও উল্লেখ করা যেতে পারে হিজরতকারী নোয়াখালীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের প্রভাবে তাদের নিজ অঞ্চলের নামে বৃহত্তর সিলেটে দু-একটা ইউনিয়নের নামকরণ পর্যন্ত হয়েছে। মজার বিষয় হলো হিজরতকারী যে অঞ্চলেরই হোন না কেন তারা ‘নোয়াখালী’ বলে বিবেচিত হতেন। এই ডাকটার মধ্যেও এক ধরনের বিদ্বেষ, তাচ্ছিল্য ও মানুষকে হেয় করার একটা গোপন সচেতন প্রয়াস দেখতাম।

এ ধরনের মনোভাব একদম সেকেলে ও হারিয়ে গেছে এ কথা এখনো হলফ করে বলতে পারি না। তবে ভাষিক বিচ্ছিন্ন এ আক্রমণের বাইরে আউটসাইডারদের প্রতি সিলেট অঞ্চলের মানুষেরা সহানুভূতিশীল এবং প্রাচীনকাল থেকেই দেশ-বিদেশে অতিথিপরায়ণ বলে সুনাম কুড়িয়েছেন। তা না হলে দক্ষিণের নদীভাঙা, বাস্ত্যুচ্যুত জীবিকার তাগিদে এতো বেশি সংখ্যায় মানুষেরা সিলেট অঞ্চলে স্থায়ী বসত গড়তে পারতেন না।

যে প্রসঙ্গে লেখা শুরু করেছিলাম সে প্রসঙ্গে ফেরা যাক। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতার শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা এদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের পাশে মানবিক ডাকে সাড়া দিয়ে এ দেশের নানা ব্যক্তি, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়েছে। খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, ওষুধ সামগ্রী ও নগদ অর্থ সাহায্য নিয়ে ছুটে গেছেন। সিলেটের বেশ কজন তরুণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করতে যেয়ে ফেরার পথে এক সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে জীবন দিয়েছেন। এগুলো এ দেশের মানুষের জাতিগত উদারতার পরিচয় বহন করে।

সীমান্তের দুঃখনদী নাফ পেরিয়ে টেকনাফ-উখিয়ায় আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের ঘিরে বহুমাত্রিক সংকট ঘনীভূত হবার আগেই সংকটের স্থায়ী, শান্তিপূর্ণ সমাধান ও রোহিঙ্গাদের জরুরী প্রত্যাবাসন দরকার। সে লক্ষ্যে রাষ্ট্র তার অনুকূলে থাকা আন্তর্জাতিক সব শক্তির সমর্থন নিয়ে যত দ্রুত কাজ করবে ততই সকলের জন্যে মঙ্গল।

আলমগীর শাহরিয়ার, কবি ও প্রাবন্ধিক। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ