আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বিজয়ের মাসের প্রত্যাশা

ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন  

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আজ বিশ্ব নন্দিত এবং ইউনেস্কো একে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য সম্ভার হিসেবে গ্রহণ করেছে। ইউনেস্কোকে এবং বিশেষ করে এর বর্তমান নির্বাহী পরিচালক এবং আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুজন পোল্যান্ডের প্রাক্তন স্থায়ী প্রতিনিধি আইরিন বকোবাকে এজন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।

লক্ষণীয় যে, ইউনেস্কো একে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দলিল হিসেবে গ্রহণ না করার পূর্বেই আমাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণ যার মাধ্যমে একটি নির্জীব, শান্তিপ্রিয়, পরম সহিংস বাঙালি জাতি দেশকে স্বাধীন করার জন্য নির্ভয়ে রক্ত দিয়েছে, কামান ও স্টেনগানের গুলিতেও পিছপা হয়নি। এই ভাষণের নির্দেশনায় পরম পরাক্রমশালী পাক বাহিনীকে পরাস্ত করে বাঙালি জাতি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে এবং এই ভাষণ একটি জাতিসত্তার জন্ম দেয়। পৃথিবীতে একটি ভাষণের কারণে একটি জাতিগোষ্ঠীর সৃষ্টি এবং স্বাধীনতা অর্জনের দৃষ্টান্ত বিরল।

আমরা যারা রেসকোর্সের ময়দানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর দরাজ কণ্ঠে তাঁর ভাষণটি শুনি তাদের কাছে ৭ মার্চের ভাষণ মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা এবং সে-দিন থেকেই আমাদের কাছে যা কিছু ছিল তাই দিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আজও সেই ভাষণ আমাদের হৃদয়ে প্রতিটি ধমনীতে রক্তের সঞ্চার করে। বঙ্গবন্ধু বলেন, "আমি যদি হুকুম দিবার না পারি, তোমাদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো......”  "....রক্ত যখন দিয়েছি, আরও রক্ত দিব, দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।”.... "এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।

বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের জেলে অন্তরীন, সেই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে যুদ্ধের ময়দানে এই ভাষণই আমাদের প্রেরণা যোগাত, হানাদার বাহিনীকে নির্মূল করার প্রতিজ্ঞা বলিষ্ঠ করতো।

বস্তুত দুইশত বছরের গোলামির কারণে আমাদের দেশে এক মন-মানসিকতা তৈরি হয়েছে যে, বিদেশি কোনো লোক বা প্রতিষ্ঠান আমাদের প্রশংসা না করা পর্যন্ত আমরা তাকে ততটুকু আমল দেই না।

সম্প্রতি ইউনেস্কো একে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দলিল হিসাবে গ্রহণ করায় আমরা সন্তুষ্টি লাভ করি। আমরা ভাবি না যে ইউনেস্কো একে স্বীকার করে নিয়ে তারাও যে সম্মানিত হলো, যেমনটি তারা আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারিকে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসাবে গ্রহণ করে সম্মানিত হয়েছে। তারা একে "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসাবে গ্রহণ না করলেও বাঙালি জাতি বছরের পর বছর একে মহান “শহীদ দিবস’’ বা “ভাষা দিবস” হিসেবে পরম শ্রদ্ধার সাথে পালন করে আসছে। অবিভক্ত ভারতের বর্ষীয়ান গবেষক অধ্যাপক গোপাল কৃষ্ণ গোখলে বলেছিলেন “What Bengal thinks today, India thinks tomorrow...” যা সরেজুনো লাইডো ও আরও অনেকের কণ্ঠে বার বার উচ্চারিত হয়েছে, তা হচ্ছে, “বাঙালিরা আজ যা চিন্তা করে, গোটা ভারতবর্ষ সেটা পরবর্তীতে অনুসরণ করে’’। আর বর্তমানে বলা যায় যে, “বাংলাদেশ আজ যা চিন্তা করে, গোটা বিশ্ব সেগুলো আগামীতে গ্রহণ করে।’’ মাতৃভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং ৭ মার্চের ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অধ্যাপক গোখলের বক্তব্যকে আবারো প্রমাণিত করলো।  

সাম্প্রতিককালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা দুটো প্রস্তাব বিশ্ববাসীর কাছে পেশ করেছেন। একটি হচ্ছে, “শান্তির সংস্কৃতি” এবং অন্যটি হচ্ছে “জনগণের ক্ষমতায়ন” এবং তাঁরই কন্যা সায়মা হোসেন ওয়াজেদ বিশ্ববাসীর কাছে “অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী’’ জনগণের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শেখ হাসিনার “শান্তির সংস্কৃতি” প্রস্তাবের মূল বক্তব্য হচ্ছে; বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে সংঘাত, হত্যা, নির্যাতন, বৈষম্য ও যুদ্ধবিগ্রহ চলছে এর মূল কারণ হচ্ছে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধের অভাব এবং অজ্ঞতা । যদি সকলের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি করা যায় যা ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী বা জাতিগত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে থাকবে, তা হলে সারা বিশ্বে সংঘাত এবং যুদ্ধবিগ্রহের পরিবর্তে টেকসই শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রবাহ বইবে। বস্তুত দেশে-বিদেশে সন্ত্রাস, সংঘাত এবং নিরীহ জনগণের উপর অত্যাচার, নির্যাতন, বঞ্চনা ও যুদ্ধেরও মূল কারণ হচ্ছে এই “শান্তির সংস্কৃতির” মন-মানসিকতার অভাব। এই শান্তির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্যে সবাইকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।

শেখ হাসিনার দ্বিতীয় প্রস্তাবটি হচ্ছে, “জনগণের ক্ষমতায়ন’। তিনি বিশ্বাস করেন যে,আগামী বছরগুলোতে নতুন নতুন সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে এবং তা সত্যিকারভাবে নিরসনের জন্যে জনগণকে ক্ষমতাবান করে তুলতে হবে। জনগণকে ক্ষমতার অধিকারী করতে হলে কয়েকটি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত কাজগুলোর নিশ্চয়তা বিধান করা অতীব প্রয়োজন এবং এগুলো হলো- ১) দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নির্বাসন, ২) বঞ্চনা বা  deprivation এর মূলোৎপাটন, ৩) গুণগত শিক্ষা ও উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান, ৪) চাকরি বা আয়ের নিশ্চয়তা প্রদান, ৫) সবাইকে সম্পৃক্তকরণ , যারা ঝরে পড়েছে তাদেরও নিয়ে আসা, ৬) প্রযুক্তি বিদ্যায় কুশলী এবং ৭) জনগণের ভোট ও ভাতের নিশ্চয়তা বিধান করে রাষ্ট্র পরিচালনায় সকলের অংশগ্রহণ। বস্তুত ২০১৫ সালে সম্মিলিত জাতিসংঘে গৃহীত টিকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যমাত্রায় এগুলো এবং এগুলোর নির্যাস নিবন্ধিত হয়েছে।

বিজয়ের মাসে জাতির সামনে নিজেদের ইতিহাস জানা যেমন অতীব প্রয়োজন সেই সাথে দেশের ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্বদের চিন্তা-ভাবনা ও জীবন-চরিত জানাও দরকার। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর “অসমাপ্ত আত্মজীবনী’’, “কারাগারের রোজনামচা’’ অথবা ৭ মার্চের বক্তৃতার কথাই বলি। তাঁর বক্তৃতায় শুধু “স্বাধীনতার” কথাই তিনি বলেন নি, তিনি বলেছেন, “..এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’’। আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি, তবে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক মুক্তি কতদূর অর্জিত হয়েছে তা বিবেচ্য। অর্থনৈতিকভাবে আমরা “তলাবিহীন ঝুড়ি’’--- সেই অপমান ঘুচিয়ে এখন বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশের জন্যে “Model of Economic Development’’ উন্নয়নের মডেল এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশ সমূহের “Standard Bearer’’ এর গৌরব অর্জন করেছি।

সাম্প্রতিককালে যুক্তরাজ্যের “প্রাইস-ওয়াটার” ফার্ম বিশ্বের ৩টি রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে সবচেয়ে “impressive’’ বা সম্ভাবনাময় বলে চিত্রিত করেছে এবং এর মধ্যে বাংলাদেশ হচ্ছে “দ্বিতীয়’’ অবস্থানে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যখন অর্থনৈতিক মন্দার করাল গ্রাসে মানুষ অস্থিরতায় ভুগছে, তখন বাংলাদেশের অর্থনীতি শুধু সচল বা “vibrant” নয়; অত্যন্ত অগ্রগামী ছিল যেখানে গেল ৯ বছরে বার্ষিক জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৬.৫% শতাংশ এবং এ বছরে তা ৭.২৮% পৌঁছেছে। যদি দেশে দুর্নীতি কমানো যায় এবং আমলাতন্ত্রকে আরও সচল করা যায়, তাহলে তা দুই ডিজিটে পৌঁছতে সময় লাগবে না।

 শিশু মৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, দারিদ্র নিরসন ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহকে হার মানিয়েছে। তবে আমরা কি সত্যি সত্যি ‘মুক্ত’ হতে পেরেছি? আমাদের সামাজিক জীবনে ধর্মান্ধতা, ভূমিদস্যুদের কারণে বিশেষত: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর জ্বালানো, প্রবাসীদের বাড়িঘর, জায়গা-জমি আত্মসাৎ ও লুট, বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে, নগরে বন্দরে নারী নির্যাতন ও নারী সম্ভ্রম লুট বা অনুরূপ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা উদ্বুদ্ধ মুজিব-প্রেমিক তাদের কাছে বেখাপ্পা ঠেকায়। বস্তুত; বঙ্গবন্ধুর  “এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম’’ এতে আমাদের আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। সোনার বাংলার জন্যে বঙ্গবন্ধুর সোনার মানুষ গড়ে তুলতে হবে।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন “সোনার বাংলা’’ এমন একটি দেশ হবে যেখানে ধনী-দরিদ্রের ফারাক আকাশসম হবে না, সকলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হবে, মানুষের উপর নির্যাতন, অত্যাচার বা হয়রানি বন্ধ থাকবে--- বাংলাদেশ হবে একটি সমৃদ্ধশীল, উন্নত,অসাম্প্রদায়িক, স্থিতিশীল অর্থনীতি। বঙ্গবন্ধুর কন্যার কারণে আমরা সেই পথে অগ্রসর হচ্ছি সত্য, তবে মানুষের হয়রানি ও নির্যাতন কমেনি। প্রতি পদে পদে সাধারণ জনগণকে হয়রানির স্বীকার হতে হয়, এবং অহেতুক আইনের বেড়াজালে সাধারণ জনগণকে নাস্তানাবুদ হতে হয়। তাছাড়া আমলাতন্ত্রের জটিলতায় উন্নয়নের মহাসড়কের যাত্রাপথ বার বার বিঘ্নিত হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষকে পদে পদে বকশিস দিতে বাধ্য করা হচ্ছে এমনকি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ও নাকি টাকা দিতে হয়। সরকার উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট টাকা ছাড় দিচ্ছেন সত্য তবে তার যথার্থ প্রয়োগ অনেক অনেক ক্ষেত্রে জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক করছে।

বিজয়ের মাসে আজ আমাদের প্রয়োজন এসব জটিলতা, এসব মন-মানসিকতা পরিবর্তন করে “বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা’’ বিনির্মাণে সবাইকে একাগ্রে কাজ করতে হবে। দেশের উন্নয়ন হলে, দেশের সম্মান বৃদ্ধি হলে, দেশের বিরাট সংখ্যক যুবক-যুবতী গুণগত শিক্ষায় শিক্ষিত হলে, উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং যুগোপযোগী প্রযুক্তি বিদ্যায় পারদর্শী হলে তাদের জীবিকার জন্য তদবিরের প্রয়োজন হবে না। বিদেশে যাওয়ার জন্যে পদে পদে হয়রানি বা ধিক্কার খেতে হবে না।

বিজয়ের মাসে আমরা সেই দিনের আশায় আছি যখন দেশের গোটা জনগোষ্ঠী সুখে-শান্তিতে থাকবে, পুলিশ বা অন্যবিধ নিরাপত্তা বাহিনীকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করবে, সরকারি আমলাকে নিতান্ত আপনজন হিসাবে ভাববে এবং একটি কাজের জন্য তাকে দশ জায়গায় দশদিন অহেতুক আসা যাওয়ার প্রয়োজন হবে না ও তদবির করতে হবে না এবং ঘুষ না দিয়েও তার ন্যায্য অধিকার ও প্রাপ্তি আদায় বা চাকরি পাওয়া সম্ভব হবে। আমরা সেই দিনের প্রত্যাশায় আছি যখন বাংলাদেশ হবে দারিদ্রমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত একটি উন্নত দেশ যেখানে সত্যিকার আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং যানজটের বেড়াজালে আর অদক্ষ ট্রাফিক পুলিশের অপরিণামদর্শিতায় নাগরিকের জীবনের একটি বৃহৎ অংশ রাস্তায় যানজটে কাটাতে হবে না।

যানজট নিরসনের জন্যে সরকার একাধিক প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন । অনেকগুলো ফ্লাইওভার তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে, মেট্রো ট্রেন আসছে। ভবিষ্যতে পাতাল ট্রেন ও হয়তো আসবে। এজন্যে সরকারকে সাধুবাদ জানাই ।  তবে বর্তমানে ঢাকার যানজটের সমস্যা নিরসনের জন্যে কয়েকটি সহজ উপায় রয়েছে।

যেমন প্রথমত: যে সমস্ত সরকারি বা আধা-সরকারি দপ্তররে রাজধানীতে থাকার আবশ্যকতা নেই, সেগুলোকে ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দেয়া।

দ্বিতীয়ত: প্রাইভেট স্কুলগুলোকে নিজেদের ছাত্র-ছাত্রীদের নিজস্ব বাসে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা এবং একই এলাকার সরকারি স্কুলগুলোতে ঐ এলাকার ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি বাধ্যতামূলক করা।

তৃতীয়ত: ঢাকার রাস্তাগুলো যথেষ্ট বড় তবে দখলদারির কারণে চলাচলের পথ ক্ষীণ। সুতরাং রাস্তাগুলোকে দখলদারিমুক্ত ও আবর্জনামুক্ত করে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা এবং অফ স্ট্রিট পাকিং এর জন্যে যথেষ্ট ব্যবস্থা করা দরকার বোধ করি। এগুলো অতি সহজে করা সম্ভব এবং এগুলোর জন্য কোটি কোটি টাকার অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন আন্তরিকতার ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তের।

দেশরত্ন শেখ হাসিনার সরকার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন “সোনার বাংলা’’ বিনির্মাণের জন্য যথাযথভাবে প্রথমত: অবকাঠামো নির্মাণের জন্যে অনেকগুলো বড় বড় মেগা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন এবং এজন্যে সরকারকে অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে হয়। তবে এসব অবকাঠামো নির্মাণে যে সমস্ত ঠিকাদার নিযুক্ত হয় তাদের অনেকেই সময়মত কাজটি শেষ করে না এবং কাজটি শুরু করার পর পর বাজেট বাড়তেই থাকে। দ্বিতীয়ত: কাজের মান উন্নত না হওয়ায় কাজটি শেষ হওয়ার পর পরই কাজটি নিয়ে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এসব ব্যাপারে সরকারকে মনোযোগী হতে হবে বৈকি। তাছাড়া যে জিনিসটি অধিকতর প্রয়োজন তা হচ্ছে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, দায়বদ্ধতা নির্দিষ্টকরণ এবং তা না হলে সরকারের অনেক অনেক বড় বড় অর্জন শুধু ধীর গতি সম্পন্ন হবে না, অহেতুক খরচের বোঝা ছাড়াও জনগণের হয়রানি লাঘবে যথোপযুক্ত নাও হতে পারে।

লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে জনগণের মঙ্গল হয়, হয়রানি কমে এবং সম্পদের যথার্থ প্রয়োগ হয়। জনগণের হয়রানি কমানোর জন্যে যথাশীঘ্র দেশের আমলাতন্ত্রের জটিলতা এবং বিকেন্দ্রীকরণ বড্ড প্রয়োজন।

বস্তুত বিজয়ের মাসে যে জিনিসটির উপর সবচেয়ে বেশী জোর দিতে হবে তা হচ্ছে “সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ”। দেশের সকল কাজ-কর্মের সিদ্ধান্তের জন্যে জনগণকে রাজধানী ঢাকায় অবশ্যই আসতে হয়- ধর্না দিতে হয়। দিনের পর দিন কাটাতে হয় বিভিন্ন দপ্তরে বা সচিবালয়ে-এ অবস্থার পরিবর্তন অত্যন্ত প্রয়োজন। আগামী নির্বাচনের অঙ্গিকার হওয়া উচিত যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে জেলায় জেলায় “জেলা সরকার ব্যবস্থা’’ প্রবর্তন করা। এর অর্থ হচ্ছে প্রতিটি জেলায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অত্র জেলার সকল উন্নয়নমূলক, আইন-শৃঙ্খলা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য বিষয়ক ইত্যাদি সকল সিদ্ধান্তের অধিকারী হবেন এবং তদারকি করবনে। তাহলে বৃষ্টির কারণে রাস্তায় খানাখন্দের মেরামতের জন্যে বা স্থানীয় শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্যে বা নিয়োগের জন্য রাজধানীতে ভিড় করতে হবে না।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ চাকরিতে কোনো ’ট্রান্সফার’ বা বদলির ব্যবস্থা নেই। পুলিশও স্থানীয়ভাবে নিয়োজিত হয়। যে যে স্টেটে বা জেলায় কাজ করে সে সেখানেই সারা জীবন কাজ করেন এবং তিনি যদি সেই জেলা থেকে অন্য কোথাও যেতে চান,তাহলে তাকে এ জেলার কাজ থেকে ইস্তফা দিয়ে অন্য জেলায় নতুন করে চাকরির দরখাস্ত করে চাকরি যোগাড় করতে হয়। এই ব্যবস্থায় ‘ট্রান্সফারের ঝকমারি’ নেই। তবে নির্দিষ্ট কয়েকটি কেন্দ্রীয় চাকরির ক্ষেত্রে যেমন : ফেডারেল আর্মি, কেন্দ্রীয় আয়কর বা ইমেগ্রেশন কর্মচারীর ক্ষেত্রে বদলির ব্যবস্থা রয়েছে।

মোদ্দাকথা, আজ বিজয়ের মাসে আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে, সময় এসেছে এদেশের বিরাট সংখ্যক যুবক-যুবতীকে দেশ গঠনে সত্যিকারভাবে কাজে লাগানোর।

দেশের এই বিরাট যুব সমাজকে কাজে লাগাতে হলে এবং এদের চাকরির ব্যবস্থাকরণ একান্ত প্রয়োজন। সেজন্য অনেক অনেক কল-কারখানা, ইন্ডাস্ট্রিজ তৈরি প্রয়োজন। এগুলো স্থাপনের জন্যে উদ্যোক্তাদের মাসের পর মাস এই অফিস, ঐ অফিস ঘুরে ঘুরে জুতার তলা ধ্বংস করতে হয়;-এ অবস্থান থেকে মুক্তি প্রয়োজন। তাহলে কলকারখানা বাড়বে, চাকরির সুযোগ তৈরি হবে।

বিভিন্ন তথ্যমতে দেখা গেছে যে, “ব্যবসা করা বা Doing business”এবং ’’ফিনানসিয়াল ও বাজেটরি ম্যানেজমেন্ট বা ব্যবস্থাপনার’’ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে দুর্বলতা আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো থেকে অনেক বেশী যার ফলে বিদেশীরা এই দেশে বিনিয়োগ করতে বার বার বাধাপ্রাপ্ত হয়। আমাদের বিরাট বাজার থাকায় অর্থাৎ প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশ হওয়ায় অনেকেই আকৃষ্ট হয়, তবে প্রস্তাব তৈরি করার পর আর অগ্রসর হয় না যার জন্য বিনিয়োগ-এ আগ্রহ থাকলেও বিনিয়োগ কার্যকর হয় না।  এ কারণে ‘নিবন্ধিত বিনিয়োগ এবং আসল আসল বিনিয়োগের মধ্যে বিরাট ফারাক।

নিম্নে কয়েকটি দেশের অবস্থান পর্যালোচনা করলে আমরা যে পিছিয়ে আছি তা অনুমেয়। আমাদের লেবার খরচ কম বটে তবে সর্বনিম্ন নয়। আমাদের লেবার খরচ মাসিক ৬৮ ডলার, কিরগিস্থানে ২৪ ডলার, মিয়ানমারে ৬০ ডলার এবং ইথিওপিয়ায় ২১ ডলার মাত্র। তবে লেবার খরচের চেয়ে বিনিয়োগকারীরা যেখানে বাধা পায় তা হচ্ছে সিদ্ধান্তের ধীর গতি,অনিশ্চয়তা,অহেতুক ডকুমেন্টেশনের ঝকমারি এবং হয়রানি।

নিম্নের টেবিলে কয়েকটি দেশের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হলো:   

সহজে ব্যবসা করা এবং আর্থিক ও বাজেটরি ব্যবস্থাপনার তুলনামূলক নির্দেশক

তথ্যসূত্র: ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট ইনডিকেটরস, সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সুতরাং, উপরোক্ত টেবিল থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের ব্যবস্থাপনায় আরও জোর দিতে হবে এবং এজন্যেই বিশেষত  “অদৃশ্য বা ইনটেনজিবল অবকাঠামো’’ যার অর্থ হচ্ছে আইন-কানুন, রীতি-নীতি,প্রসেস-প্রসিডিউর ইত্যাদির আমূল সংস্কার ও উৎকর্ষের জন্যে অধিকতর জোর দিতে হবে। এ কাজটি টাকা ঢাললেই হবে না, শুধুমাত্র আমলাদের সাথে বৈঠক করে হবে না। এর উৎকর্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন যারা সেবাদান করে এবং যারা সেবা গ্রহণ করে তাদের উভয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় আন্তরিকতার সাথে নতুন নতুন নীতি প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা।

আজকে বিজয়ের মাসে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে সফল করতে হলে এ সব বিষয়ে জোর দিতে হয় এবং তাহলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন “সোনার বাংলা’’ সফল হবে।

ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন, মন্ত্রী, পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ