প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭
অমলের ভীষণ বেড়াতে যেতে ইচ্ছা করে। ভালো লাগে না এই একঘেয়ে রৌদ্র না লাগা কিউবিক্যাল জীবন। কিন্তু কে ছুটি দেবে এই মধ্যবিত্তের ঘেষটে চলা জীবনে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে থিতু জীবন; চোখ দুটো যেন মৃত প্রজাপতির মতো আটকে আছে। দুপুর মানেই বার্তা সম্পাদকের অকস্মাৎ অফিসে ঢুকে হৈ চৈ। এক সঙ্গে পাঁচটা কপি ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত নিউজগুলো ছাড়ার তাগিদ।
অমলের বরং ইচ্ছা করে কোথাও বেড়াতে যেতে; শ্যামলী নদীর ধারে, পাঁচমুড়া পাহাড়ের ওপারে। মাকে ফোন করে, মা আমি এই চাকরিটা না করে যদি তোমার কাছে চলে আসি; তুমি আমাকে তিন বেলা খাওয়াতে পারবে না। আমি বরং একটা ছোট্ট স্কুলে পড়াবো; টাকা জমিয়ে গ্রীষ্মের ছুটিতে কোথাও বেড়াতে যাবো।
মা শুনে হাসেন। অমলের এই স্বপ্নটার মধ্যে মা হাসির কী পান খুঁজে। বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করলেই কী হাতি-ঘোড়া মেরে বেড়াতে হবে; হতে পারে না একটা ইচ্ছাজীবন; যেখানে কিউবিক্যালে বসে অসংখ্য ভুলে ভরা কপি নিয়ে ধস্ত হতে হবে না; কপি সম্পাদনার পর ভুল থেকে গেলে বার্তা সম্পাদকের উন্নাসিক কথায় তিক্ত হয়ে উঠবে না বিকেল উপচে সাঁঝ; তারপর কখন মধ্যরাত এসে পড়া। বন্ধুরা টিএসসি থেকে ফোন করে বলে, এসে পড়; কী এতো কাজ করিস; ঐ তো কপি-পেস্ট সাংবাদিকতা। বাদ দে এসব।
অনিচ্ছায় কিউবিক্যালে ফিরে খবরের সমুদ্রে ডুব দিয়ে হারিয়ে ফেলা বিকেল-সন্ধ্যাগুলো। আর খবরগুলোও আরও মন খারাপের। বাঘের হরিণ শিকারের গল্প; হাতির দাঁতের সুউচ্চ প্রাসাদ গড়ার গল্প, ললিতলোভনকান্তি মাংসের কারবার, টাকশালের সিন্দুক ডানা মেলে উড়ে যাওয়ার গল্প, অনুভূতির হ্যাশকেক বিক্রির খবর, নানা জায়গায় সারমেয় আক্রমণে জলাতঙ্কে আক্রান্ত জনপদের বেদনাগাথা; আর মানুষের বেড়াতে যাওয়ার গল্প।
এর মধ্যে ফোন করে এক কবি বন্ধু। একটা নতুন কবিতা লিখেছে সে; এক্ষুণি পড়ে শোনাতে চায়। সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন বার্তাসম্পাদক।
--বুঝলে অমল আমার মনে হয় স্বৈরশাসনের সঙ্গে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির গভীর যোগাযোগ। পাকিস্তানের জিয়াউল হক বলো আর তুরস্কের এরদোয়ান বলো; এরা ধর্মটাকে ব্যবহার করেছে স্বৈরশাসনকে পাকাপোক্ত করতে। এই দুই সিনড্রোমের গভীর যোগাযোগ আছে; স্বৈরাচার আর ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি।
বার্তা সম্পাদক গল্পের মুডে আছেন মনে হচ্ছে। কবি বন্ধুকে অনুনয় বিনয় করে কবিতাটা ফেসবুকের ইনবক্সে দিয়ে দিতে অনুরোধ করে অমল। তারপর একটু নির্ভার হয়ে বসে।
ফোন আসে শ্রেয়ার। কলটা কেটে দেয় । বার্তা সম্পাদক বলেন, ধরো ধরো ফোনটা ধরো। আমরা পারসোনাল লাইফটাকে অবহেলা করে মিডিয়ায় জীবন দিয়ে কী আর পেলাম বলো! টিভির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলেন, ঐ যে দেখো সংবাদ সম্মেলন চলছে; ঐ দিকে একটু খেয়াল রেখো।
শ্রেয়াকে কল ব্যাক করে বলে, একটা সংবাদ সম্মেলনের খবর ছাড়তে হবে; আর হাতের কাজগুলো গুছিয়ে নিয়েই তোমাকেই ফোন দিচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলন দেখে অমল বিস্মিত হয়। একটাও জরুরী প্রশ্ন নেই; শুধু খুশী করার চেষ্টা। অনেকটা বিরক্ত হয়েই অমল ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়ে দেয়, তেলের শিশি উলটে ফেলে সংবাদ সম্মেলন মাটি।
বন্ধুরা হাহা হাসির ইমোটিকন দিলেও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত একজন ক্রোধের ইমোটিকন দিয়ে যায়।
কাজ শেষ করে অফিস থেকে বের হতেই এক লোক এগিয়ে এসে বলে, অমল আমি দইওয়ালা; তোমাকে শ্যামলী নদীর ধারে বেড়াতে নিয়ে যাবো; পাঁচমুড়া পাহাড় দেখাবো।
অমলের অবাক লাগে। লোকটা তার মনের কথা জানলো কী করে! দইওয়ালা আর তার বন্ধুরা অমলকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়। দইওয়ালা বলে, তোমাকে অখণ্ড শান্তি পেতে গেলে নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যেতে হবে। মোবাইল ফোনটা আমাকে দাও; এখন বেড়ানোর আনন্দে ভাসো। তোমার চোখটা বেঁধে দিই; শ্যামলী নদীর ধারে গিয়ে চোখ খুলে দিলে তুমি যে আনন্দ পাবে তার তুলনা মেলা ভার।
মা অমলের ফোনে বার বার কল করে পাননা। শ্রেয়া অসংখ্যবার ডেকে অমলের ফোন বন্ধ পায়। বন্ধুরা ফেসবুকে অমলের সাড়াশব্দ পায়না। কবি বন্ধু অপেক্ষা করে কখন অমল কবিতাটা পড়ে ফিডব্যাক দেয়। বার্তা সম্পাদক অনেক কষ্টে কান্না চেপে এখানে ওখানে ফোন করেন।
অমল হারিয়ে গেছে এই খবরটাকে কেন্দ্র করে কেউ হাহুতাশ-কেউ কটাক্ষ করে। কটাক্ষকারীরা অমলের মায়ের কান্নার গভীরতা টের পায়না। শ্রেয়ার কষ্টের তীব্রতা অনুভব করতে পারে না। অমলের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে সোচ্চারদের "গুমখোর"-এরা একটা ইস্যু পাইছে বলে ক্রুর হাসি হাসে। বিজয়ীর হাসি। পরাজিতের অশ্রুর সঙ্গে বিজয়ীর হাসিরও একটা গভীর সম্পর্ক আছে এটা অনুভব করেন বার্তা সম্পাদক। অমলের খোঁজখবর করতে গিয়ে এই ব্যাপারটা খুব ভাবিয়েছে তাকে।
অমল শ্যামলী নদী দেখে; পাঁচমুড়া পাহাড় দেখে। দইওয়ালা বলে, সবাই ভাবছে তুমি মারা গেছো; আর ফিরবে না; তুমি তো এ যুগের গৌতম বুদ্ধ হয়ে গেলে অমল। আমিই মনে করো তোমার বোধিবৃক্ষ; আমি লোকটা তো বৃক্ষের মতোই।
দইওয়ালা খ্যাসখেসে গলায় গেয়ে ওঠে, খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়.....
অনেক অপেক্ষার অবসান ঘটে যখন শোনা যায় অমল ফিরে এসেছে। অমল যেহেতু হারিয়ে গেলেও পরাজিত; ফিরে এলেও পরাজিত। তাই বিজয়ীরা অমলের ফিরে আসাতে আরও বড় করে হাসে।
"গুমখোরেরা একটা ইস্যু হারালো"
অমলের রক্ত মাংসের শরীর; তার হারিয়ে যাওয়া; তার মায়ের অযুত পলের বিনিদ্র রাতগুলো; গলা দিয়ে খাবার না নামা; অমলের ছোট বেলার প্রজাপতি আঁকা লাল সোয়েটার হাতে বসে থাকা; গন্ধ নেয়া; এসবই বিজয়ীদের কাছে নেহাত একটা ইস্যু।
মা অমল ফিরে এলে কিছু জিজ্ঞেস করতে যান।
অমল মাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, বেড়াতে গেছিলাম মা।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য