আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

প্রশ্ন ফাঁসের অলীক কুনাট্য রঙ্গে!

আলমগীর শাহরিয়ার  

সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, ‘প্রশ্ন ফাঁস যুগ যুগ ধরে হচ্ছে। আগে এত বেশি প্রচারণা হতো না, এখন গণমাধ্যম বেড়ে যাওয়ায় তা সর্বস্তরে প্রচার হয়ে যাচ্ছে।’ একই সঙ্গে তিনি আরও অভিযোগ করে বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁসের মূল হোতা আমাদের শিক্ষকরা। সরকারকে বিপদে ফেলতে পাবলিক পরীক্ষার দিন সকালে শিক্ষকরা প্রশ্ন পেয়েই ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তা ফাঁস করে দিচ্ছেন।’

যারা এ দেশে বাম রাজনীতি করতেন তাদের পড়াশোনার সুনাম ছিল। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী এক সময় বাম রাজনীতি করতেন। তাই তাঁর পড়াশোনায় অগাধ আস্থা রেখেই প্রশ্ন ফাঁসের প্রাসঙ্গিক একটি গল্প মনে পড়ছে।

বাঙালি প্রথম সমাজ বিদ্রোহী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের অন্যতম প্রধান জীবনীকারক প্রাবন্ধিক গোলাম মুরশিদ। গোলাম মুরশিদের লেখা মাইকেলের মধুসূদন দত্তের জীবনী ‘আশার ছলনে ভুলি’-এর 'মধুচক্র–গৌড়জনে যাহে' অধ্যায়ে পড়েছিলাম, মাইকেল তখন দূর মাদ্রাজের এক বিচিত্র জীবন চুকিয়ে ফিরেছেন কলকাতায়। সেখানে পুলিশ কোর্টে সহায়ক কর্মচারী হিসেবে চাকরি নিয়েছেন এক বন্ধুর বদান্যতায়। কায়ক্লেশের জীবন তাঁর। ১২৫ টাকা বেতনের চাকরি করে রাজনারায়ণের সুযোগ্য পুত্র দুঃখ করতেন অযোগ্য, অর্ধশিক্ষিত সহকর্মীদের তুলনায় বেতন কম পান বলে। নিজের আয় নিয়ে খুব অসন্তুষ্ট ছিলেন। অন্যদের যোগ্যতার সঙ্গে নিজের যোগ্যতা ও আয়ের তুলনা করে তিনি অসুখী বোধ করতেন। করাই স্বাভাবিক। তার চেয়ে কম যোগ্যরাও কোর্টে আইন পেশায় ভালোই কামাই রোজগার করছেন। সে খেদেই নতুন পেশায় ভাগ্য ফেরাবেন এমন এক ভাবনা থেকেই আইন পরীক্ষায় বসবেন বলে নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলেন।

জানা যায়, সে বার আইন পরীক্ষা দেবার জন্য আবেদন করেছিলেন প্রায় ছশো প্রার্থী। নির্ধারিত দিন টাউন হল কেন্দ্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা কমিটি খবর পেলেন ওইদিন সকালে ভবানীপুর অঞ্চলে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেখা গেছে। প্রশ্ন ফাঁসের এমন অভিযোগে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। কবিও ভাগ্যকে দোষারোপ করে সে দফায় জীবনের নতুন স্বপ্নোদয় ও সম্ভাবনার ইস্তফা দেন।

শিক্ষামন্ত্রীর প্রশ্ন ফাঁসের একাল সেকালের দোষারোপ শুনে গল্পটা মনে পড়ে গেল। শিক্ষামন্ত্রী বোধহয় মাইকেলের জীবন থেকে নেয়া এগল্প পড়েছেন এবং যথার্থই বলেছেন প্রশ্ন আগেও ফাঁস হত কিন্তু গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না বলে এতো হৈচৈ হতো না। তবে মন্ত্রী মহোদয় মনে হয় ভুলে গেছেন সেকালে এরকম ঘটনাকে দুর্লভ হিসেবে চিহ্নিত করে তড়িৎ কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকার কোন কার্পণ্য ও কসুর করত না।

আজকাল আমাদের প্রাইমারি, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, প্রকৌশল, বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি জালিয়াতির মহা কেলেঙ্কারি, সরকারি চাকরি-বাকরি সর্বত্র প্রশ্ন ফাঁসের এমন মহামারি সেকালে ছিল কল্পনাতীত। সেকালে নিশ্চয়ই আজকের মত এত এত প্রতিষ্ঠানও ছিল না, কিন্তু যে কয়টা ছিল সেগুলোর মান নিয়ে কারো কোন প্রশ্ন ছিল না।

ব্রিটিশ ভারত থাক। আজকের বিশ্বে আর কোন দেশে প্রশ্ন ফাঁসের এমন সর্বনাশা খেলার দ্বিতীয় নজির আছে কিনা জানা নেই। আর প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে আজকাল সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে খোদ সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীসহ আরও অনেক রাঘববোয়ালদের। সামাজিক মূল্যবোধের এমন অবক্ষয় ও বিপর্যয় এর আগে এঅঞ্চলে এতো ভয়াবহভাবে দেখা যায় নি। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযুক্ত অনেকেই নানা সময় গ্রেপ্তার করলেও অভিযুক্তরা আখেরে আইনের ফাঁকফোকরে পার পেয়ে যাচ্ছে ঠিকই।

সততা ও মূল্যবোধের এমন সর্বগ্রাসী অবক্ষয় আমাদের গ্রাস করল কবে? আমাদের সমাজ জীবন একটি ট্রানজিশনাল পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পরিবর্তনশীল একটি সমাজে এমন ঘটনার কার্যকারণ অনুসন্ধান করলে অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে।

এ প্রসঙ্গে জার্মান সমাজবিজ্ঞানী উইলিয়াম এফ অগবার্ন-এর ‘সাংস্কৃতিক ব্যবধান (Cultural Lag) থিওরিটির কথা মনে পড়ছে। অগবার্ন ১৯২২ সালে তাঁর প্রকাশিত 'Social Change' নামক গ্রন্থে এতত্ত্বটি তুলে ধরেন। তিনি তাঁর তত্ত্বে মূলত বলেছেন, বস্তুগত সংস্কৃতি যে গতি ও হারে এগোয় অবস্তুগত সংস্কৃতি সে তুলনায় অনেক ধীরে এগোতে থাকে। ফলে উভয় ধরনের সংস্কৃতির মধ্যে একটি ব্যবধান তৈরি হয়। এ ব্যবধান চূড়ান্তরূপে একটি সমাজ বা কালে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও খাপ ছাড়া আচরণেও মানুষকে প্রলুব্ধ করে। যা সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধকে হেয় করে।

প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের পরিচয় খুব সাম্প্রতিক কালের। অপরাধ সংগঠনের পুরনো মাধ্যম পরিবর্তন হয়ে এই প্রক্রিয়ারও ডিজিটালিজেশন শুরু হয়েছে। সে হুমকি মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি খুবই অপ্রতুল।

তাছাড়া, এই সময়ে শিক্ষক বা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থীর যে মানের পড়াশোনা, উন্নত মূল্যবোধ, ব্যক্তিত্ব ও মানস গঠন থাকার কথা আমাদের সমাজ ও সময়ে তার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। যার ফলে এমন নিচু স্তরের অপরাধ প্রবণতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে তাদের বিবেক বাধছে না। তাছাড়া, প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের যে নয়া পরিচয় তার সদ্ব্যবহার না করে প্রায় ক্ষেত্রেই আমরা এর অপব্যবহার ঘটতে দেখছি। উপরন্তু পুঁজিবাদী সময় ও সমাজে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য ও রাতারাতি প্রচুর অর্থলাভের আকাঙ্ক্ষা তাদের অপরাধ সংগঠনে প্রলুব্ধ করছে। এক শ্রেণির অভিভাবকেরাও নিজ সন্তানকে সব ধরনের বিবেক, নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অসাধু পথ অবলম্বনে পিছপা হচ্ছেন না। যা আমাদের সামাজিক ও শিক্ষার সামগ্রিক দৈন্য দশার হতাশাজনক চিত্রকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে।

চলতি বছর জুলাই ও আগস্ট দুই মাসে কাজের সুবাদে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শতাধিক মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসা পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছিল। পরিদর্শনের সময় শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। সে সুযোগে মাধ্যমিক পর্যায়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার হালচাল নিয়ে খুব ভালো একটা ধারণা পেয়েছিলাম। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও শিক্ষার সর্বোপরি মানোন্নয়ন নিয়ে অনেক মৌলিক প্রশ্নের উত্তর এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এক দুই দশক আগেও যেখানে দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই জীর্ণ ও ভগ্নদশায় ছিল সেখানে এখন অনেক নতুন ভবন উঠেছে। অবকাঠামোগত পরিবর্তন দৃশ্যমান। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন নতুন ভবন নির্মাণ করলেই শিক্ষার মানোন্নয়ন নিশ্চিত হয় না। আরও অনেক আনুষঙ্গিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি।

শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নে, তাদের সুপ্ত প্রতিভা ও মেধা বিকাশে প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলিতে আমাদের সৃজনশীল কোন উদ্যোগ নেই বললেই চলে। যেনতেনভাবে বছর বছর শ্রেণি পাশ করিয়ে দেয়াই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব প্রতিকূলতা পেরিয়ে যারা বের হয়ে আসে তারা নিজগুণেই তা করেন। তাছাড়া, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে সবচেয়ে মেধাবীরা যেখানে শিক্ষা পেশায় যান আমাদের এখানে ঘটে তার উল্টো। অনাগ্রহী, শিক্ষাজীবনে তুলনামূলক মেধাহীন লোকজনই এই পেশায় অনেকটা অনন্যোপায় হয়ে যান। ফলে তাদের এই অনিচ্ছুক সেবার খেসারত দিতে হয় শিক্ষার্থীদের। কর্মক্ষেত্র কারোর যদি আগ্রহ ও ভালো লাগার না হয় তাহলে তিনি কখনোই সেখানে তার সামর্থ্যের সর্বোচ্চটুকু দিতে পারেন না।

আজকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক নাজুক অবস্থা ও বেহাল দশা দূরবীন দিয়ে খোঁজার কিছু নেই। গভীর ক্ষতগুলো আমাদের চারপাশে দগদগে, দৃশ্যমান। ডায়াগনোসিস করে দাওয়াই দেয়া জরুরি হয়ে গেছে। না হলে পুরো জাতিকে এর মাশুল দিতে হবে।

একটি জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেলে কোন উন্নয়নই তার বিপর্যয়কে রোধ করতে পারে না। শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের সব আয়োজন অদৃশ্য অসুর শক্তিরা করেই চলেছে। এদের দৌরাত্ম্য যেকোনো মূল্যে থামাতে হবে।

আলমগীর শাহরিয়ার, কবি ও প্রাবন্ধিক। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ