আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীকে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ কেন?

মাসকাওয়াথ আহসান  

নানা পেশা ও সেবার মানুষের মধ্যে একমাত্র রাজনীতিকরাই জনগণের সমালোচনা নিতে পারে। অন্যান্য পেশাজীবী ও সেবাগোত্রের মানুষ বিন্দুমাত্র সমালোচনা নিতে পারেনা; সমালোচনার কারণ বুঝতে পারে না; বরং ক্ষিপ্ত হয়। এদের পেশানুভূতি ধর্মীয় অনুভূতির মতই কট্টর। ফলে তাদের উত্তরণের সম্ভাবনা আশংকাজনকভাবে কমতে থাকে।

আমরা ধরেই নিয়েছি যে, সুশাসন বা সুব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠার সব দায়-দায়িত্ব কেবল রাজনীতিকদের। কিন্তু কেবল একটি পেশা বা সেবাগোত্রের মানুষের পক্ষে বিপুল জনসংখ্যার জন্য সুব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা প্রায় অসম্ভব।

অল্পকিছু জনপ্রতিনিধির পারফরমেন্স নিয়ে মিডিয়া ও জনগণ কয়েক যুগ কাটিয়ে দিলো। ফলে অন্যান্য পেশা ও সেবা গোত্রের মানুষেরা তাদের পারফরমেন্স উন্নততর করার তাগিদ অনুভব করেনি। এরা প্রত্যেকেই রয়ে গেছে জবাবদিহির বাইরে।

সরকার যায় সরকার আসে। কিন্তু জনপ্রশাসনের কর্মচারীরা স্থায়ীভাবে রাষ্ট্রের নানা সেবাখাতে দায়িত্ব পালন করে। কালেভদ্রে তাদের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির খবর মিডিয়ায় আসে। কারণ মিডিয়া সব সময় ব্যস্ত রাজনীতিকদের খোঁজ-খবর নিতে। মিডিয়ার সক্রিয়তায় আমরা জনপ্রতিনিধিদের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কথা জানতে পারি। কিন্তু জনপ্রশাসনের সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ পদের লোকেরা কীরকম নৈরাজ্যজনক আচরণ ও দুর্নীতি করে চলেছে; সে চিত্র স্পষ্ট নয় জনমানসে।

পুলিশ-প্রশাসন-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি নানা সেবাখাতের কর্মচারীরা জনগণের সেবা করার জন্য জনগণের উপার্জিত অর্থ থেকেই বেতন-ভাতা পায়। অথচ এর পরিবর্তে জনগণ যথাযথ সেবা তো পায়-ই না; উলটো সরকারি পেশাজীবীরা জনগণের সঙ্গে "প্রভু"-র মতো আচরণ করে। বিষয়টি খুবই আইরনিক্যাল; যে আমাকে বেতন দেয়; আমি তার মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাই। এরকম একটি অবাস্তব ঘটনাই যুগের পর যুগ ঘটে চলেছে কোন প্রতিবিধান ছাড়াই। যার নিয়োগ হচ্ছে জনস্বার্থে; সে যুগের পর যুগ জনস্বার্থ বিরোধী কাজ করছে; এ এক অচিন্তনীয় বাস্তবতা।

সরকারি সেবাখাতে নিশ্চিতভাবে অনেক ইতিবাচক সেবক মননের মানুষ কাজ করেন; কিন্তু নেতিবাচক শাসক মননের লোকেরা সংখ্যায় এতো বেশি ও তাদের সদর্প বিচরণ এতো বেশি দৃশ্যমান; যে জনপ্রশাসনের সমালোচনা করতে গিয়ে অল্পসংখ্যক ইতিবাচক-সেবক মননের মানুষদের প্রতি অনেকটা অবিচার করা হয়ে যায়। তবে জনপ্রশাসনের ভেতরে বসে তারা নিজেরাও নেতিবাচক শাসক মনোবৃত্তির আদিম লোকেদের সতত ঈর্ষা ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের স্বীকার; এটাও নিশ্চিত।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, গোটা পৃথিবীতে একমাত্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সরকারি চাকুরে বা সেবকদের সেবার মান নিকৃষ্ট। উপমহাদেশে যে ব্রিটিশেরা এই জনপ্রশাসনের ধারণা প্রবর্তন করেছিলো; সেই খোদ বৃটেনেই সরকারি চাকুরে বা সেবকদের মনোভঙ্গি একেবারেই বদলে গেছে। যে বৃটিশ সিভিল সার্ভিসের লোকেরা আদিম যুগে প্রত্যাশা করতো, জনগণ তাদের "স্যার" বা "ম্যাডাম" বলবে; সেই বৃটিশ সিভিল সার্ভিসের সদস্যরাই এখন জনগণকে "স্যার" বা "ম্যাডাম" বলে।

অথচ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সিভিল সার্ভেন্ট বা জনসেবকেরা রয়ে গেছে আদিমযুগে। তারা একবিংশ শতকের আধুনিক পৃথিবীতে বসে এখনো প্রত্যাশা করে, জনগণ তাদের "স্যার" বা "ম্যাডাম" বলবে। এতো গেলো কেবল সম্বোধনের দিক; কিন্তু এই সম্বোধনের মনস্তত্বের মাঝেই যে আদিম "প্রভু" দৃশ্যমান; কাজের ক্ষেত্রে তা প্রতিফলিত আরও ভয়াবহ আত্মম্ভরিতায়।

আত্মম্ভরিতার অসুস্থ সংস্কৃতি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রকটভাবে দৃশ্যমান হবার কারণ; সমাজের সুষম বিকাশ না ঘটা। সামন্ত বা জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইটি সামন্ত বা জমিদার সমাজের অংশ হবার অশুভ প্রতিযোগিতায় পরিণত হওয়ায় সমাজ মনোজগতে আধুনিক সাম্যভাবনা বিকশিত হয়নি একেবারেই। কেউ দরিদ্র অবস্থা থেকে সচ্ছল অবস্থায় গেলে আর হাতে সামান্য ক্ষমতা পেলেই দরিদ্রশ্রেণির নিপীড়কে পরিণত হচ্ছে নিয়মিতভাবে। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি সমানুভূতির বোধ অর্জিত হচ্ছে না একেবারেই।

অনেকেই জীবনের যে কোন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মোটিভেশনাল বক্তব্যে বলেন, মাত্র ৪৭ টাকা নিয়ে ঢাকায় এসেছিলাম; আজ আমি "স্লামডগমিলিওনিয়ার"। জনগণ এই বক্তব্যে অশ্রুসিক্ত হয়। কিন্তু এরকম জাদুকরি উত্থানের স্বপ্ন সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর; তা কিছুকাল পরে বুঝতে পারি আমরা। মানুষের জীবনে উন্নতির ধাপে ধাপে একটি ধারাবাহিক গতিশীলতা বজায় থাকাই সুস্থতা। জাদুকরি উন্নতির ধারণাটিই ভুল। জাদুকরি উন্নতির মাঝে অল্প কিছু ক্ষেত্রে সততা ও পরিশ্রমের দৃষ্টান্ত থাকলেও; এই জাদুকরি উন্নতির নেশাটিই সমাজে আত্মম্ভরিতা ও দুর্নীতির ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ