আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

হেরে যাচ্ছি!

ইমতিয়াজ মাহমুদ  

আমার বড় হওয়ার সময়টা একটা অস্থির সময় ছিল। জিয়াউর রহমান তখন ক্ষমতা গুছিয়ে বসেছেন বটে, কিন্তু সেটা কেবল মিলিটারির বন্দুকের জোরে। মিলিটারির মধ্যে জিয়াউর রহমান তার বিপক্ষের লোকদের হত্যা করে বা চাকরী থেকে বের করে দিয়ে পুরো শক্তিটাকে কার্যত নিজের পক্ষে এনে ফেলেছেন প্রায়। এটা করতে গিয়ে যেসব মিলিটারি অফিসারকে জিয়াউর রহমানের সময় হত্যা করা হয়েছে এদের বেশিরভাগই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া অফিসাররা। এদেরকে হত্যা করার পাশাপাশি আরেকটা কাজ ওরা করেছে সেসময়; পাকিস্তান আর্মিতে যেসব অফিসার আমাদের বিপক্ষে পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করেছে, ওদেরকে পুনর্বাসন করা।

পাকিস্তানে বন্দিদশা থেকে যারা ফিরেছে ওদেরকে তো আর্মিতে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সরকারই। জেনারেল এরশাদ এরকম একজন। জিয়াউর রহমান যেটা বাড়তি করেছেন সেটা হচ্ছে আমাদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়া লোকদেরকে বেসামরিক বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা। এদের মধ্যে আছেন মেজর মান্নান- এখন বিশাল ব্যবসায়ী, একসময় বিএনপির এমপি-মন্ত্রী ছিলেন, পরে বিকল্প ধারায় যোগ দিয়েছিলেন। জেনারেল আমজাদ, প্রাণ ব্র্যান্ডের মালিক। আরেকজন আছেন রকিবুল হুদা। রকিবুল হুদা সহ বেশ কিছু মিলিটারির লোককে জিয়া পুলিশে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এই লোক, রকিবুল হুদা, এরশাদের সময় চট্টগ্রামের শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনার সভায় মিছিলে প্রকাশ্যে গুলি করে মানুষ মেরেছিল। উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত শেখ হাসিনাকে হত্যা করা।

এগুলো তো ছিল জিয়াউর রহমানের আর্মি পুলিশ আর প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কায়দা। এরচেয়েও ভয়ংকর এবং নিচ যে কাজটা জিয়াউর রহমান করেছিলেন সেটা হচ্ছে আমাদের চেতনা থেকে স্বাধীনতা মুছে ফেলা আর বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার চেষ্টা। জিয়াউর রহমান এই কাজটা করতে চেয়েছেন ধর্ম নিরপেক্ষতা বা মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাটা মুছে ফেলার মাধ্যমে। জিয়াউর রহমান আর তার উপদেষ্টারা বুদ্ধিমান ছিলেন। ওরা ঠিকই চিহ্নিত করেছে, ঠিক কোন জায়গাটা আমাদের স্বাধীনতার মুল ভিত্তি আর হাত দিয়েছিল ঠিক সেই জায়গাটিতেই।

আজকে আফসোস করে বলতেই হচ্ছে, জিয়াউর রহমান বহুলাংশেই সফল। দশ জানুয়ারি তারিখে, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে আমাকে বলতেই হচ্ছে, এমনকি বঙ্গবন্ধুর নিজের দিল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও আজকে জিয়াউর রহমানের আদর্শিক হামলায় ঘায়েল হয়েছে- খোদ আওয়ামী লীগই আজকে ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে সরে এসেছে।


ধর্ম নিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদায়িকতা ছাড়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মেরও প্রয়োজন ছিল না এবং অসাম্প্রদায়িকতা ছাড়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বেরও কোন যুক্তি নাই। এই কথাটা আগে একটু বলে নিই, এরপর জিয়াউর রহমানের কাণ্ডকৌশল বলছি।

আমরা আমাদের স্বাধীনতার কথা বলতে গেলে ৫২ থেকে শুরু করি আর ৭০এর নির্বাচন হয়ে ৭১এ যুদ্ধে এসে শেষ করি। এটা কমবেশি সকলেই করি। রাজনৈতিক নেতারা, আওয়ামী লীগ বলেন আর সিপিবি বলেন- মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যারা তারা সবাই, দেখবেন বক্তৃতা দিতে গেলে এক দমে এই বছরগুলোর কথা বলবেনই। ৫২র ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ইত্যাদি। এইসব আন্দোলনের কথা সকলেই কেন বলেন?

আর একদল লোক দেখবেন স্বাধীনতার ইতিহাসটা কেবল ৭০এর নির্বাচন আর ৭১এর যুদ্ধের মধ্যে সীমিত করে ফেলতে চায়। এইসব মতলববাজরা কেন আগের আন্দোলনগুলো এড়াতে চায়?

৫২তে কী হয়েছে? ভাষা আন্দোলন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা বা না করা নিয়ে এইরকম যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থা কেন হয়ে গেল? কেন পাকিস্তানের একটা প্রদেশের গোটা জনগোষ্ঠী এইরকম একটা ফরমাল বা টেকনিক্যাল ইস্যু নিয়ে ক্ষেপে উঠলো। ভাবেন। বাংলা যদি সেসময় রাষ্ট্রভাষা না হয় তাইলে আমাদের কী ক্ষতি হতো? ঢাকায় বাংলা চর্চা নিষিদ্ধ হয়ে যেত? না। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বাংলা ভাষা ব্যাবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা চেপে বসতো? না। রাষ্ট্রভাষা যদি কেবল উর্দু হতো তাইলে সরকারি কাজকর্ম ইংরেজিতে আর উর্দুতে হতো। প্র্যাক্টিক্যালি বাংলা চর্চার উপর কোন বাধা থাকতো না।

তাইলে আমরা ক্ষেপে গেলাম কেন? কারণ আমরা ভাষার উপর এই আক্রমণটা আমরা দেখেছি আমাদের বাঙালি পরিচয়ের উপর হামলা হিসেবে। আক্রমণ কেন বলছি? কারণ সেসময়ের পাকিস্তানের সংখ্যালঘু মানুষের ভাষা হিসেবে বাংলাই ছিল রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে একমাত্র যৌক্তিক পছন্দ। কিন্তু অবাঙালি নেতা যারা ছিল ওরা আর কিছু সংখ্যক বাঙালি নেতাও মনে করলো যে বাংলা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হলেও এটা ঠিক পুরোপুরি মুসলমানের ভাষা না, এটা অনেকটা হিন্দুদের ভাষা। আর পাকিস্তান যেহেতু মুসলমানদের দেশ, মুসলিম রাষ্ট্র, এখানে হিন্দুদের ভাষা চলবে না, এখানে চলবে মুসলমানের ভাষা উর্দু।

ওটাই ছিল আমাদের ক্রোধের কারণ, ক্ষোভের কারণ। যে না, হিন্দু মুসলমান টানবি কেন? আমরা বাঙালি, আমাদের ভাষা বাংলা, আমরা আমাদের নিজের ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা চাই। হিন্দু মুসলিম এইসব প্রশ্ন রেখেও আমাদের নিজেদের বাঙালি পরিচয়টা আমাদের কাছে যে গুরুত্বপূর্ণ সেটা তখন আমরা বুঝতে পেরেছি।


তাহলে পশ্চিম পাকিস্তান ও মুসলিম লীগের সাথে আমাদের ঝগড়াটা কি? মুসলিম লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তান চাচ্ছিল ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানি নামক একটি জাতি গঠন করতে, আর আমরা বললাম যে না, কাভি নেহি, ঐটা আমরা চাই না, আমরা বাঙালি আমরা আমাদের বাঙালি পরিচয় মুছে যেতে দেব না। এইটাই পাকিস্তানের ঐক্যের জন্যে বড় বাধা ছিল এবং এই ঝগড়াটার জন্যেই আমরা আলাদা হয়েছি।

মুসলিম লীগ আর পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা ওরা ছিল ক্ষমতায়। ওরাও ব্যাপারটা বুঝেছে। ওরা তখন কি করেছে? রা চেষ্টা করেছে বাঙালিরা যেন ক্ষমতায় আসতে না পারে। যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল বাঙালি, সে দেশে ওরা নানান কায়দায় বাঙালিকে ক্ষমতার বাইরে রাখবে। কেন? কারণ ওরা দেখেছে বাঙালি ঠিক ওদের মতো মুসলমান না। বাঙালি মুসলমানদেরও একটা অংশ হিন্দুদের সাথে মেলামেশা করে, বাঙালি হিন্দু কবির গান করে, বাঙালি মুসলমান কবি হিন্দুয়ানি ভাষায় গান কবিতা লেখে এইরকম নানান কিছু। এদের হাতে পাকিস্তান তুলে দিলে এড়া পাকিস্তানকে পাকিস্তান রাখবে না।

তাইলে কি করতে হবে? ওরা তখন বাংলা ভাষাকে মুসলমানি করতে চাইলো। পাকিস্তান সরকার নানাপ্রকার উদ্যোগ নিল যাতে করে মুসলমানদের বাংলা ভাষাকে হিন্দুর ভাষা থেকে আলাদা করা যায়। একটা উদ্যোগ ছিল আরবি হরফে বাংলা লেখা। কেউ কেউ বললো যে না, রোমান হরফে বাংলা লিখতে হবে (এখন আমরা যেটাকে মুরাদ টাকলা বলি)। এইসব উদ্যোগে একজন বাঙালি মন্ত্রীর মুখ্য ভূমিকা ছিল- আমাদের সালমান এফ রহমানের পিতা ফজলুর রহমান। তিনি তখন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। তিনি বাংলাকে মুসলমানি করার উদ্যোক্তাদের একজন।

ওরা আরেকটা কাজ করলো। রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করতে চাইলো আর নজরুলকে মুসলমানি করার চেষ্টা করলো।

বাঙালি সেটা মানল না। কেন? কেন মানবে। আমরা বাঙালিরা মুসলমান হই বা হিন্দু হই বা খ্রিস্টান হই- আমাদের বাঙালি জাতীয় পরিচয় তো আমাদের মুখ্য। এটা মুছে ফেলতে চাইবেন তাইলে কেমনে হবে? বাঙালি যেন আরও বেশি করে বাঙালি হওয়ার জন্যে উঠে পরে লাগলো। দেখবেন ষাটের দশকের গোড়াতে এসে বাঙালি কবি সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক কর্মী রাজনীতিবিদ সকলেই কেমন যেন আরও বেশী করে বাঙালি হওয়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে।


বাঙালি কবি তখন মুসলমান পরিচয়ের ঊর্ধ্বে বাঙালি পরিচয় নিয়ে বিশ্বের সাথে মিলতে চাইছে। বাঙালি সিনেমা যারা বানাচ্ছিল সেসময় ওরা সিনেমাতে বাঙালি মেয়েদের পোশাক আশাক সাজ ইত্যাদিতে বাঙালিয়ানা যেন আরও বেশি করে দেখাচ্ছিল। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরাও বাঙালিয়ানা দেখানোতে এগিয়ে আসতে থাকলো। এবং এই যে বাঙালিয়ানা- এটা যে শুদ্ধ মুসলিম সংস্কৃতি না সেটা জেনেই ওরা এটা করতো। এইসময় ছায়ানটের বর্ষবরণ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

তখনো কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ ঠিক পাকিস্তান ভাঙবো, নিজের আলাদা দেশ বানাবো সেকথা ঠিক ভাবেনি। রাজনৈতিক দল ও নেতাদের অনেকেই ভেবে থাকতে পারেন, কিন্তু সাধারণ মানুষ পাকিস্তান রাষ্ট্র রেখেই নিজের বাঙালি পরিচয়টা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে চাইতো। এইরকম একটা সময়েই ১৯৬৫ সনে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ বেধে গেল।

১৯৬৫ সনের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে দেখা গেল যুদ্ধে বাঙালি সৈন্য, বাঙালি অফিসার, বাঙালি বৈমানিকেরা বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, কিন্তু এই পুরো যুদ্ধের সময়ই সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। পুরো সামরিক শক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানকে বাঁচানোর জন্যে। তাসখন্দ চুক্তি দিয়ে যুদ্ধটা থামানো হয়েছিল বটে, কিন্তু যুদ্ধ থামার আগে ইন্ডিয়া পাকিস্তানের বিশাল ভূমি দখল করে নিয়েছিল। এদিকে লাহোরের একদম কাছে চলে গিয়েছিল আর ওদিকে কাশ্মীরের একটা বড় অংশ ইন্ডিয়া দখল করে নিয়েছিল।

এই যুদ্ধটা যেন বাঙালি চোখ খুলে দিয়েছিল। যুদ্ধের পর আমাদের নেতারা প্রশ্ন তুললেন, এইটা কি করে ভাই, আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমাদের তাকায় দেশ চলে আর আমাদেরকে কিনা অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হতে হয় আর সেই সাথে আমাদের সুরক্ষাও এই রাষ্ট্রের কাছে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না? এইটা কি করে হয়? এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। এই যে বললাম যে 'আমরা' এই আমরাটা কারা আর ওরা কারা? আমরা হলাম বাঙালি আর ওরা হলো অবাঙালি।

তাইলে ঝগড়াটা কি দাঁড়ালো? বাঙালি বনাম অবাঙালির মধ্যে ঝগড়া। এইখানে বিভ্রান্তির কোন সুযোগ নাই। শোষণ বলেন, বঞ্চনা বলেন, বৈষম্য বলেন সবকিছুই হয়েছে বাঙালিদের প্রতি অবাঙালিদের দ্বারা।


সেই সময়েই বঙ্গবন্ধু ৬ দফা নিয়ে এলেন।

সময়টা লক্ষ্য করবেন। বাঙালি তখন ফুঁসছে। বাঙালি। হিন্দু নয় মুসলমান নয়। বাঙালি। এই পরিচয়টাই আমাদের সাথে পাকিস্তানের অন্যদের বিরোধের কারণ। আর আপনি যখন বলছেন বাঙালি তখন তো সেখানে আপনি হিন্দু মুসলমান ভাগ করতে পারেন না। যারা আপনার শত্রু ওরাও কিন্তু আপনি বাঙালি বলেই আপনাকে শত্রু মনে করছে- মুসলমান বলে নয় বা হিন্দু বলে নয়। বঙ্গবন্ধু তখন বললেন, তাইলে আমাদের বাঙালির প্রদেশটি আমরা নিজেরাই শাসন করবো- পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চাই। কিরকম স্বায়ত্তশাসন? ছয় দফা পড়ে দেখেন।

বঙ্গবন্ধু বললেন আমাদের ভিন্ন কারেন্সি চাই, ভিন্ন পুলিশ, ভিন্ন মিলিটারি, ভিন্ন সবকিছু। কেবল ফরেইন পলিসি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের হাতে। আমাদের শাসন আমাদের তোমাদের শাসন তোমাদের। আমাদের আর তোমাদের মানে? বাঙালি আর অবাঙালির। এই দাবীটা নিয়ে বঙ্গবন্ধু সারা বাংলায় ছুটতে লাগলেন। সরকার তাঁকে জেলে নিয়ে যায়, যেখানে তিনি যান সেখানেই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। সরকার তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে প্রচার চালায়। সেসময় আওয়ামী লীগে তাঁর চেয়েও অনেক বড় বড় নেতা ছিল। অনেক সিনিয়র লোক ছিল। সকলকে ছাপিয়ে মানুষ বঙ্গবন্ধুর কথা শুনল।

ছয় দফা নামে মাত্র থাকলো বটে, কিন্তু আটষট্টি উনসত্তরে মানুষ স্লোগান দিচ্ছে 'তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি', 'তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা' এইরকম সব শ্লোগান। এইসবে মানে কি? কথাটা হচ্ছে যে সত্তরের নির্বাচনের আগে বাঙালি বাঙালি হিসাবে তাঁর নিজের অধিকারের জন্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ঐটা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান- পাকিস্তান ধারনার বিরুদ্ধে বা 'ভারত উপমহাদেশের মুসলমানরা একটি জাতি' এই কথাটি নাকচ করে দিয়ে এই উত্থান। কারণ আপনি যখনই বলবেন বাঙালি জাতি- সাথে সাথেই আপনি অসাম্প্রদায়িক একটি ধারনার কথা বলছেন।

সত্তরের নির্বাচন হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। সেই নির্বাচনে ইস্যুটা ফয়সালা হয়নি বলেই আমাদের যুদ্ধে যেতে হয়েছে। যুদ্ধটা হচ্ছে আমাদের এই দীর্ঘ সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্ব- কিন্তু এই দীর্ঘ সংগ্রামেরই একটা অংশ মাত্র। হঠাৎ করে যুদ্ধ হয়নি, আর এটা কোন অরাজনৈতিক যুদ্ধও ছিল না। যুদ্ধে বিজয়টা আমাদের রাজনৈতিক বিজয়ও বটে। আমাদের বিজয় মানে? বাঙালির বিজয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয়।


জিয়াউর রহমান কি করলেন এবার সেটা দেখেন।

জিয়াউর রহমান প্রথমেই যেটা করলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ তুলে দিলেন। এরপর বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে করলেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। তাইলে আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলেন আর স্বাধীনতার চেতনা বলেন তার আর কি থাকলো? কিছুই না। আমাদের স্বাধীনতার আর কি অর্থ থাকলো ঘোড়ার ডিম? কিছুই না। কারণ আমরা স্বাধীন হয়েছি বাঙালি হিসাবেই, আমরা আমাদের বাঙালি জাতীয় পরিচয়ই যদি প্রতিষ্ঠা করতে না চাইতাম তাইলে কিন্তু স্বাধীনতার দরকারই ছিল না। মনে রাখবেন, অর্থনৈতিক দেন দরবার বা দাবী দাওয়ার জন্যে স্বাধীনতার দরকার ছিল না। স্বাধীনতার দরকার ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্যে।

কিন্তু আমাদের দেশের একদল লোক ছিল যারা আমাদের এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশটা মানত না। ওদের মুল বক্তব্যটা ছিল যে মুসলমান বাঙালি আর হিন্দু বাঙালি এক না। হিন্দু বাঙালী আর ইন্ডিয়ার বাঙালি এদের সাথে আমাদের ধর্মীয় পার্থক্য আছে এটা ওদের কাছে মুখ্য বিষয় ছিল। আমাদের আবুল মনসুর আহমেদও ছিলেন এদের একজন। এরা বলতেন যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ভাল কথা, কিন্তু এইটা মুসলমান বাঙালির দেশ, মানে একটা পাকিস্তান ভেঙে আমরা দুইটা পাকিস্তান বানিয়েছি। জিয়াউর রহমান এই জিনিসটাই নিলেন এবং আমাদের দেশটাকে দ্বিতীয় পাকিস্তান বানানোর সকল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন।

জিয়াউর রহমানের বিস্তারিত সেইসব পদক্ষেপের কথা আপনারা জানেন। সেইসব পদক্ষেপের মুল কথা কি ছিল? মুল কথাটা ছিল যে এটা মুসলমানের দেশ, বাঙালির দেশ নয়। আর এই কাজে জিয়াউর রহমানের মুল হাতিয়ার ছিল সাম্প্রদায়িকতা- মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা। জিয়াউর রহমান ঠিকই চিহ্নিত করেছিল, বাঙালির কাঁধ থেকে বাঙালিয়ানার ভুত তাড়াতে হলে বাঙালিকে আগে মুসলমান বানাতে হবে।

সেই যে শুরুতেই পাকিস্তানিদের কর্মকাণ্ডের কথা বলেছি- আমাদের ভাষা থেকে শুরু করে আমাদের যা কিছু বাঙালিয়ানা সবকিছুকেই আক্রমণ করা- জিয়াউর রহমান তাই করলেন। কিছু করলেন তিনি নিজে, সরকারিভাবে ও তার দলের মাধ্যমে, আর কিছু কিছু করালেন রাজাকার-আলবদর এদেরকে কবর থেকে তুলে এনে রাজনীতিতে পুনঃস্থাপন করে।


জিয়াউর রহমান যখন এই অশুভ মিশনটা শুরু করে তখন আমি কিশোর। স্কুলে কলেজে পড়ার সময় আমরা সেটা প্রত্যক্ষ করেছি, চেষ্টা করেছি মোকাবেলা করার। একটা প্রতিরোধ সেসময় যে ছিল না তা নয়। আমাদেরকে তখন বলা হতো 'রুশ ভারতের দালাল'। কারা এই দালালরা? সিপিবি, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ এইরকম কয়েকটা দল। আর আমাদের বিরোধিতা কারা করেছে? জিয়াউর রহমান আর রাজাকারগুলো ওরা তো ছিলই, সাথে যোগ দিয়েছিল চীনপন্থি বামরা আর জাসদ।

সেই লড়াইটাতে আমরা যে একদম হেরেছি সে কথা বলতে পারছি না। আমরা কিন্তু জিয়াউর রহমানের বুনে দেওয়া সাম্প্রদায়িকতা ও পাকিস্তান পন্থা থেকে মানুষকে ফেরাতে পেরেছিলাম অনেকটাই। এর ফল দেখবেন নব্বইয়ের পর রাজাকারদের বিচার চেয়ে আন্দোলন, জাসদ এদের সুর বদল এইরকম নানা পরিবর্তন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটা আবহ যেন জেগে উঠেছিল আবার। আওয়ামী লীগও ইলেকশনে জিতে ক্ষমতায় এসেছিল ছিয়ানব্বইতে। ৯১ আর ২০০১এ নির্বাচনে হারলে ভোটের হিসাবে আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিল ভালো।

আজ এসে আফসোস, মনে হচ্ছে আবার যেন জিয়াউর রহমানের কাছে হেরে যাচ্ছি। না, এবার বিএনপি না বা মিলিটারি জেনারেলরা না, স্বয়ং আওয়ামী লীগই যেন ধর্মনিরপেক্ষতা আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছুড়ে ফেলেছে। আমি সংবিধানের বিধি বিধানের কথা বলছি না, বলছি রাজনৈতিক সংস্কৃতি, আদর্শিক লাইন আর কর্মকাণ্ডের কথা। আওয়ামী লীগ কি আসলেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ- ধর্মনিরপেক্ষতা আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের লাইনে আছে?

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ এর দশ জানুয়ারিতে দেশে ফিরেছিলেন। তাঁর শারীরিক মৃত্যু হয়েছে অনেক আগে, তবুও আমার মনে হতো তিনি আছেন, তিনি আছেন। এখন আর সেকম মনে করার কোন সুযোগ কি আপনারা রেখেছেন? বঙ্গবন্ধুর নাম আছে, মূর্তি আছে, বঙ্গবন্ধু নেই।

ইমতিয়াজ মাহমুদ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ