প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আলমগীর শাহরিয়ার | ১৯ জানুয়ারী, ২০১৮
ঘটনাটি আলোচনায় আসে কিছুদিন আগে। উগ্র হিন্দু মৌলবাদী শিবসেনা কর্মী বলবীরের নতুন নাম এখন মুহম্মদ আমীর।
জানা গেছে, আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে তিনিই অযোধ্যার আলোচিত বাবরি মসজিদের গম্বুজে শাবল চালিয়েছিলেন। সে শাবলের আঘাতে শুধু মসজিদ ভাঙেনি, ভেঙেছিল লাখো-কোটি বিশ্বাসী মানুষের মন । সাম্প্রদায়িক ঘৃণার আগুনে আত্মাহুতি দিয়েছিল সহস্রাধিক মানুষের জীবন।
ভারতের ইতিহাসে অন্যতম সাম্প্রদায়িক কলঙ্ক অযোধ্যার ঘটনার পর বলবীর ঘরে ফেরেন। নিজ এলাকা পানিপথে উগ্রবাদীদের পক্ষ থেকে তুমুল সংবর্ধনাও পান তিনি। কিন্তু গান্ধীর অহিংসার নীতিতে বিশ্বাসী পিতা দৌলতরাম যিনি দেশভাগের সময় আগলে রাখতেন মুসলিম প্রতিবেশীদের বাবরি মসজিদ ভেঙে সম্বর্ধনা পেয়ে ফেরার পরও সন্তান বলরামকে নিজ ঘরে উঠতে দেননি তিনি। ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইংরেজি তিনটি বিষয়ে এমএ ডিগ্রিধারী হয়েও উগ্রবাদী শিবসেনাদের সংস্পর্শে যেয়ে মগজধোলাই হয়ে যাওয়া বলবীরকে পিতা জানিয়েছিলেন হয় বলবীর থাকবে ঘরে না হয় তিনি।
সম্প্রতি ভারতের ‘মুম্বই মিরর’-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলবীর জানিয়েছেন, বাবরি মসজিদ ভাঙায় পিতা যে দুঃখ পেয়েছিলেন সে দুঃখেই নাকি পরলোকগত হয়েছিলেন তিনি। সে সময় খবর নিয়ে আরও জেনেছিলেন হাতুড়ি-শাবল চালানো সঙ্গে থাকা বন্ধু যোগেন্দ্রও ইতোমধ্যে মুসলিম হয়ে গেছেন। জেনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি। অপরাধবোধ, অনুতাপ আর আত্মদহনে ধর্মান্তরিত হয়ে যান বলবীর। ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়ে হয়ে যান পুরোদস্তুর মুসলিম। এখন তিনি নিয়মিত মসজিদে যান। রোজ ভোরে উঠে আজান দেন। ধর্মের ভুল ব্যাখ্যায়, অন্ধ বধির ঘৃণায় যে মসজিদ ভেঙেছিলেন তিনি সে মসজিদেই ফের রোজ ডাকেন বিশ্বাসী মানুষদের। প্রায়শ্চিত্ত করতে নির্মাণ করে চলেছেন মসজিদ।
জনপ্রিয় ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় প্রকাশিত এ প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের সংগীতশিল্পী ও এক্টিভিস্ট শুভ প্রসাদ নন্দী মজুমদার ফেসবুকে তাঁর প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, “গুজরাটের হন্তারক একদিন হৃদয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িকতার সৈনিক হয়েছেন। বলবীর ওরফে আমিরের বাবাই অসাম্প্রদায়িক ভারতের মুখ। ভারতের প্রতিটি পিতা বলবীরের পিতা হয়ে উঠুন।”
সত্যি বলবীরের সহিষ্ণু পিতাই ভারতবর্ষকে প্রতিনিধিত্ব করেন। কেউ কারো মসজিদ, কেউ কারো মন্দির যেন আর না ভাঙে। বরং আগলে রাখে। চলতি মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হবে বিদ্যার দেবী সরস্বতীর পূজা। এ দেশে সবচেয়ে বড় সরস্বতী পূজার আয়োজন জগন্নাথ হলে দেখলাম দেবী সরস্বতীর অসংখ্য সুন্দর প্রতিমা তৈরি করে চলেছেন শিল্পীরা। গত পরশু অক্টোবর ভবনের সামনে সবুজ ঘাসের উপর প্রতিমা শিল্পীদের শিল্পকর্মগুলো মুগ্ধ হয়ে দেখলাম অনেকক্ষণ।
সরস্বতী পূজা এদেশে একটা সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক বিভাগের শিক্ষার্থীদের নিজস্ব আয়োজনে তৈরি মণ্ডপে সব ধর্ম ও মতের মানুষেরা আসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বর্তমান শিক্ষার্থী বন্ধুদের উপচে পড়া ভিড় থাকে। যেন এক মিলনমেলায় রূপ নেয়। সবাইকে আপ্যায়ন করা হয়। ধর্ম যার যার উৎসব সবার– এ পূজায় যেন তার সার্থক রূপায়ন দেখা যায়। এভাবে এ দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যেন সবসময় নির্বিঘ্নে পূজা-অর্চনা করতে পারেন। মুসলমানেরা যেন ভারতে, চীন, রাশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকায় নির্বিঘ্নে মসজিদে যেতে পারেন।
আফগানিস্তানে দেড় হাজার বছরের প্রাচীন ভুবনবিখ্যাত বামিয়ান বৌদ্ধমূর্তির মত উগ্রবাদীদের হাতে যেন আর কোন ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস না হয়। ঘরে গরুর মাংস রাখার অপরাধে ভারতের উত্তরপ্রদেশে দাদরির মুহম্মদ আখলাকের মত যেন নিষ্ঠুর, নির্মমভাবে আর কারোর জীবন দিতে না হয়। ব্যক্তি কি খাবে, পড়বে এটা যেন তার একান্তই নিজস্ব ব্যক্তিগত হয়, যেন আপন বিশ্বাসের কাঁটাতারে ঘেরা না থাকে অন্যের জীবন।
বাংলাদেশে রামু, নাসিরনগর, রংপুরের ঘটনা যেন আর ফিরে না আসে। উত্তর জনপদ লালমনিরহাট ঘুরতে যেয়ে প্রথম দেখেছিলাম একই প্রাঙ্গণে, প্রাচীরহীন উন্মুক্ত স্থানে পাশাপাশি স্থানে রয়েছে মসজিদ-মন্দির। নিজ নিজ ধর্মের মানুষেরা যুগ যুগ ধরে নির্বিবাদে, নির্বিঘ্নে তাদের উপাসনা করেন। আজানের সময় আজান, সন্ধ্যা আহ্নিকের সময় শঙ্খ, ঘণ্টা, শাঁখ, মৃদঙ্গের সুর বাজে। ধর্মীয় উপাসনালয়ের এই অনন্য সহাবস্থানই এই উপমহাদেশের শান্তিপূর্ণ ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে।
ছাত্রলীগের ৭০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে টিএসসি সংলগ্ন এলাকায় দেয়াল লিখনে লক্ষ করলাম লেখা রয়েছে, “আজানের ধ্বনি শাঁখের সুরে যাচ্ছে মিশে/ মৌলবাদ তোমার লালসা মিটবে কিসে/” এ দেশে, এ উপমহাদেশে আজানের পবিত্র ধ্বনি, হিন্দুদের শাঁখ, মৃদঙ্গ, ঢোল-করতালের সুরে মিশে যায়। শান্তিতে, সম্প্রীতিতে ছুঁয়ে যায় বিশ্বাসী মানুষের হৃদয়। পৃথিবীর কোথাও ধর্ম যেন কোন মানুষের, মৌলবাদের হিংস্র লালসা মেটানোর অস্ত্রে পরিণত না হয়।
বলবীর ওরফে মুহম্মদ আমীর তো তার জীবন থেকেই জেনেছেন মানুষের অন্তরেই থাকে মসজিদ, মানুষের অন্তরেই মন্দির।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য