আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ফেব্রুয়ারি: বসন্ত, দ্রোহ ও ভালোবাসার সম্মিলন

সহুল আহমদ  

ফেব্রুয়ারি – আমাদের দ্রোহের মাস, আমাদের ভালোবাসার মাস। ফেব্রুয়ারি আমাদের সন্ধান দেয় নতুন পথের, নতুন কণ্ঠের, নতুন সুরের, নতুন দিনের। ভালোবাসা যদি সমষ্টিগত হয়ে থাকে, তাহলে এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে ত্যাগের নিদর্শন; সেই নিদর্শনের সাক্ষাৎ পাই আমরা ফেব্রুয়ারিতে। নিজের ভাষার প্রতি মানুষের প্রেম তুলনাহীন, কেননা, ভাষার সাথে জড়িয়ে থাকে আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। তাই, শাসকেরা ভাষার প্রতি এই ভালোবাসাকে ভয় পায়, আর শাসক যদি উপনিবেশিক ধারার হয় তাহলে ভাষার উপরে দিয়েই বয়ে যায় সর্বাধিক ঝড়-ঝাপটা। ব্রিটিশের পর পাকিস্তান আমলে আমরা যে উপনিবেশিক ধারার শাসনে আবারও শাসিত হই, তার অনেকগুলো প্রমাণের একটা হচ্ছে, একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের বিরাট জনগোষ্ঠী যে ভাষায় কথা বলে সে ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি না দিয়ে ভিনদেশি এক ভাষাকে সে ভূখণ্ডের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া। আর, তাই ফেব্রুয়ারি হচ্ছে এর বিরুদ্ধে আমাদের প্রথম বিদ্রোহ। ফেব্রুয়ারিতে আমরা যে আগুন জ্বালিয়েছিলাম তার দাবানলে যেমন শাসকগোষ্ঠী পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল, শাসকের মুখোশ খসে পড়েছিল, তেমনি আমাদের শরীরে লেগে থাকা সাম্প্রদায়িকতার খোলসও ঝরে পড়তে শুরু করেছিল।

ফেব্রুয়ারি, তাই, আমাদেরকে দিয়েছিল নতুন জীবন। ফেব্রুয়ারিতেই আমরা আইন ভেঙ্গেছিলাম;  প্রমাণ করেছিলাম, রাষ্ট্রীয় আইন শ্বাশ্বত কিংবা অলঙ্ঘনীয় কিছু নয়। আইন যদি অলঙ্ঘনীয়ই হতো, তাহলে এদেশের বুকে একুশ আসতো না, ফেব্রুয়ারির জন্ম হত না। একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে এক আলোচনায় সেলিম রেজা নিউটন গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা সিদ্ধান্ত তুলে ধরেছিলেন; তাঁর মতে, একুশ ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিপরীতে সমাজের  অবস্থান গ্রহণ। এই বিদ্রোহের পর থেকেই শুরু হয়েছিল আমাদের নতুন করে পথচলা। সে পথচলায় ফেব্রুয়ারি বারেবারে ফিরে এসেছিল নব প্রেরণায়, নব উদ্যমে এবং নব ঝংকারে। যতবারই কেউ চেপে বসেছে আমাদের বুকের ওপরে, হাঁসফাঁস করছিলাম মুক্তির জন্যে, ততবারই ফেব্রুয়ারি আমাদেরকে আলো দেখিয়েছে, সুসংগঠিত করেছে, শক্তি যুগিয়েছে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ গানের সুরে সুর মিলিয়ে আমরা বারেবারে শাসকগোষ্ঠীর গদিতে আগুন দিয়েছি।  



বাংলা ভাষাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকেরা, তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। যেহেতু, উপনিবেশিক শাসকের কোলেই এই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা, সেহেতু তাদের শাসনের ধরণেও অভিন্নতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ব্রিটিশ আমলে উপনিবেশিত বুদ্ধিজীবীরা বাংলাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিলেন সংস্কৃতের দিকে, আর পাকিস্তানবাদী বুদ্ধিজীবীরা বাংলাকে জোর করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ‘আরবি-ফারসি’র দিকে। দুই ক্ষেত্রেই বাংলার সাথে বিচ্যুতি ঘটেছিল তার মাটির, তার মানুষের। বাঙালিরা আবিষ্কার করলো, এক কুয়ো থেকে উদ্ধার পেয়ে আরেক কুয়োতে এসে পড়েছে। এক উপনিবেশিক শাসকের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে  আরেক উপনিবেশিকের খপ্পরে পড়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে, বাঙালি মুসলমান- যারা এই পাকিস্তানের জন্যেই জান-প্রাণ দিয়ে লড়েছিল - পাকিস্তান সৃষ্টির কিছুদিনের মধ্যেই প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সেই বিক্ষোভ যদিও শুরু হয়েছিল বুদ্ধিজীবী-ছাত্রদের দ্বারা, পরবর্তীতে তৎকালীন পূর্ববাংলার সকল শ্রেণির মানুষই এতে অংশগ্রহণ করেছিল। অন্যায় আইনকে অমান্য করেছিল নির্দ্বিধায়। বাংলার বিপক্ষে কথা বলতে গিয়ে শাসকগোষ্ঠী যেভাবে সাম্প্রদায়িক চর্চায় মেতে উঠেছিলেন, সেখানে অবাক করার মতো বিষয় হল, বাংলার সাধারণ মানুষ পাকিস্তানিদের এমন ধর্মীয় প্রচার পুরোপুরি উপেক্ষা করেছিল। অবাক করার মতো বিষয় বললাম এই কারণে যে, দেশভাগের ভয়াবহ হিন্দু-মুসলমান  দাঙ্গার ক্ষত তখনো শুকায় নি, সেই দুঃসহ স্মৃতি তখনো অটুট। এমতাবস্থায়, ভাষার প্রশ্নে বাংলার মানুষজন যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার জন্ম দিয়েছিল তার গুরুত্ব অপরিসীম। বাহাত্তরের সংবিধানে যে ধর্মনিরপেক্ষতা আমরা পাই, তার পথচলা শুরু হয়েছিল ভাষাকে কেন্দ্র করেই।

নিজের ভাষার জন্যে আত্মদানের স্বীকৃতিস্বরুপ জাতিসংঘ একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। এটা আমাদের জন্যে গৌরবের নিঃসন্দেহে। কিন্তু, এখানে যে সত্য আড়ালে পড়ে যাচ্ছে তা হল, আমরা তো মাতৃভাষার জন্যে আন্দোলন করি নাই; বরং, আমরা আন্দোলন করেছিলাম মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে। এই আড়ালে পড়ে যাওয়ারও রাজনীতি আছে, কেননা, এই সত্য আড়ালে চলে যাওয়ার কারণে আরেকটা প্রশ্ন আমাদের মনে জাগছে না। এত রক্ত ঝরল যে ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে, সেই ভাষা কি আদৌ রাষ্ট্রভাষা হতে পেরেছে? এমনকি, ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র গঠন করার পরও কি বাংলা ভাষা  ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে? উল্টো আমাদের জাতীয়তাবাদী প্রকল্প উর্দু ভাষার প্রতি ঘৃণা তৈরি করে দিচ্ছে। অথচ, কোন ভাষার প্রতি ঘৃণা বোধ তৈরি করা ফেব্রুয়ারির শিক্ষা হতে পারে না। জহির রায়হানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ রচনায় দেখা যায় একজন চরিত্র বলছে, ‘উর্দুর সঙ্গে আমাদের কোন বিরোধ নেই। আমরা উর্দু-বাংলা দুটোকেই সমানভাবে চাই’। এই যে শ্রদ্ধাবোধ সেটা নির্দিষ্ট কোন ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সেটা পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের মাতৃভাষার প্রতি সমান সম্মানপ্রদর্শন এবং সেই সাথে যে কোন মাতৃভাষার ওপর আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ।

বাংলাভাষা কেন রাষ্ট্রভাষা হতে পারছে না, কে তার সবচেয়ে বড় শত্রু এ নিয়ে আহমদ ছফার আলাপটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ; এবং, সেটা ১৯৭৫’র পূর্বে লিখিত হলেও এর প্রাসঙ্গিকতা এখনো পুরোপুরি বিদ্যমান। ছফাও চান সর্বস্তরেই বাংলা ভাষা প্রচলন করা হোক, কিন্তু, আমাদের এখানে যারা এটা চালু করার ধ্বনি তুলছেন তাদেরও তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তিনি প্রথমেই বলে দিচ্ছেন যে, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যে অসুবিধা ছিল তা এখন দূরীভূত। ইংরেজি ও উর্দু - কেউই এখন শত্রুর তালিকায় নাই। তাহলে বাংলাভাষা কেন রাষ্ট্রভাষা হিসেবে নিজের অধিকার নিতে পারছে না? আহমদ ছফা জনগণকে ‘ভাষা ও সংস্কৃতিগত’ দিক থেকে দুইভাগে ভাগ করেছেন। একভাগে আছেন ঔপনিবেশিক শাসনের লাঞ্ছিতজনেরা এবং, অন্যভাগে আছেন ঔপনিবেশিক শাসনের ফায়দালুটেরা। বাংলাদেশে যাদের হাতে রাজনৈতিক, সংস্কৃতি ও সামাজিক নেতৃত্ব, ছফার মতে, ‘তাদের স্থিতি ব্রিটিশ সৃষ্ট ঔপনিবেশিক সমাজের পাটাতনে’। এই আলোকেই তিনি বাংলাভাষার প্রধান শত্রুর সন্ধান করেছেন। তার মতে, আমাদের ‘ঔপনিবেশিক মানসিকতাই বাংলাভাষার সর্বপ্রধান শত্রু’। আহমদ ছফা বলেন, ‘ইংরেজরা যে শ্রেণীটি তৈরি করে দিয়ে গেছে সেই শ্রেণীটি এখনো দেশের প্রাণশক্তিকে বুকে পা দিয়ে দাবিয়ে রেখেছে’।  

আহমদ ছফার মতে, শুধু জোরে জোরে আওয়াজ তুললেই বাংলাকে সর্বক্ষেত্রে প্রচলন করা সম্ভব না। যেহেতু, ‘ভাষা একটা সামাজিক শক্তি’, সেহেতু, বাংলাভাষার প্রচলনের জন্যে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রয়োজন তার ‘পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন’। ছফা বলেন,‘সামাজিক জীবনের উন্নতির চেষ্টা না করে শুধুমাত্র ভাষাকে মাজা-ঘষা করে উন্নত করার প্রচেষ্টা পর্যাপ্ত খাবার এবং ব্যায়ামের বদলে রুজ-পাউডার ইত্যাদি মেখে শরীরের লাবণ্য বৃদ্ধির অপচেষ্টার মত অর্থহীন’।  ভাষা প্রশ্নে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে শ্রেণী-প্রশ্ন। বাংলাভাষা নিয়ে এ আলোচনায় ছফা শ্রেণী বৈষম্যের কথাও বলেন। ছফার মতে, শ্রেণী বিভক্ত সমাজ দাঁড়িয়ে থাকে অজ্ঞানতার উপরে। এটা বলার পরে ছফা যা বলেন, সেটা বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছফা বলেন, ‘শ্রেণীবিভক্ত সমাজে ব্যাপক হারে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চল হলেও সেই জ্ঞান-বিজ্ঞান শ্রমিক-কৃষককে শোষণের হাতিয়ারে পরিণত করে।’ ছফা আলোচনা শেষ করেছেন ‘বাংলাভাষা’কে হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করে। যে হাতিয়ার দিয়ে ঔপনিবেশিক মানসিকতা এবং তার অর্থনৈতিক ভিত্তি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে হবে।

তবেই মুক্তি ঘটবে আমাদের!  



ফেব্রুয়ারি দ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছিল স্বাধীনতার পূর্বে; একবার নয়,  বারেবারে। স্বাধীনতার পর আবারো এই ফেব্রুয়ারি আগুন জ্বালায়। ১৯৮৩ সাল; স্বৈরাচারী এরশাদ তখন ক্ষমতায়, প্রণীত হয় কুখ্যাত ‘মজিদ খান শিক্ষানীতি’; নামের সাথে ‘শিক্ষানীতি’ থাকলেও এখানে ‘নীতি’ শতভাগ অনুপস্থিত ছিল। শিক্ষাকে বাণিজ্যীকরণ এবং সাম্প্রদায়িকরণ করার প্রস্তাব দেয়া হয় সে নীতিতে। বলা হয় যে, শিক্ষার বেতনের ৫০ ভাগ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হবে, এবং, রেজাল্ট খারাপ হলেও ৫০ শতাংশ বেতন দিলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়া হবে।

ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধরে রেখে ছাত্ররা বরাবরের মতো রুখে দাঁড়াল, আন্দোলনের বিপরীতে শাসকগোষ্ঠী তাদের লাঠিয়াল বাহিনীকে রাস্তায় ছেড়ে দিল। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্ররা পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী মিছিল বের করলে পুলিশ গুলি ছুঁড়ে। জাফর-জয়নাল-দিপালী সহ অনেকেই মারা যান। যদিও সরকারী প্রেসনোট বলেছিলে মৃতের সংখ্যা ১ জন, কিন্তু মোট ১১ জনের মৃত্যুর সংখ্যা পাওয়া যায়। একজন বলেছিলেন সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা, ‘১৪ ফেব্রুয়ারি আমরা শুধু জয়নালের লাশ পাই। দিপালী সাহার লাশ গুম করে ফেলে। তার লাশ আমরা পাইনি। ১৫ ফেব্রুয়ারি কাঞ্চন চট্টগ্রাম শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আরও অনেকে নিখোঁজ হন। তাদের জীবিত বা মৃত কোনও অবস্থায়ই পাওয়া যায়নি।’ সেই সাথে চলতে থাকে গণহারে গ্রেফতার। তীব্র আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী শাসকের শিক্ষানীতি বাতিল হয়। একসময় স্বৈরাচারী শাসকেরও পতন ঘটে, যদিও তিনি এখনও রাজনীতিতে সক্রিয়। যারা আন্দোলন করে তার পতন ঘটিয়েছিল, তারাই আজ ঘর বেঁধেছে তার সাথে! এই নির্মম পরিহাস মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নাই।

১৪ ফেব্রুয়ারি এককালে ছিল ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’, ভালোবাসা আর রক্তে রাঙানো ছিল দিনটা। এককালে নাকি ঢাবিতে জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দিপালী সাহাদের নামে শ্লোগান দেয়া হতো। এখন আর সেদিন নাই। রক্তে রাঙানো ‘ভালোবাসা’ হারিয়ে গিয়েছে ‘ভোগবাদী’ ভালোবাসার আড়ালে। ‘আমি-তুমি’ ভালোবাসার রাজনীতিতে হারিয়ে গিয়েছে জয়নাল-জাফরদের ‘সমষ্টিগত’ ভালোবাসা। এখনও গোলাপের রঙে লাল হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি, তবে সেটা সীমিত ‘আমার-তোমার’ এর মধ্যে, সেখানে ‘সবাই’ অনুপস্থিত! মুক্তবাজার অর্থনীতি যে বিচ্ছিনতার কথা বলে, সেখানে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এখন আমরা সবাই পণ্য। এক বন্ধু বলেছিল, এই যুগে কোন দিবসের সাথে ‘পণ্যের’ যোগসাজশ না থাকলে সে দিবসকে টিকিয়ে রাখা যায় না। ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ এর সাথে কোন পণ্য জড়িত না, কিন্তু আমাদের ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’তে কেনাকাটার তালিকা তালিকা বহুত লম্বা। তাই, স্বাভাবিকভাবেই হারিয়ে যায় দীপালীরা, জয়নালরা।  

শাসকগোষ্ঠী ছাত্র আন্দোলন ভয় পায়। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে – যেখানে ছাত্র আন্দোলনের ঝলমলে ইতিহাস বিদ্যমান – ছাত্র আন্দোলন শাসকদের জন্যে রীতিমত ভয়ংকর ব্যাপার! যে/যারা এককালে ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন দেয়, তারাই যখন শাসক হয়ে ওঠে, তখন তারাও ছাত্র আন্দোলনকে দমন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই, শাসকগোষ্ঠী কখনো চাইবে না জয়নাল-দিপালীদের নাম আমরা মনে রাখি, তাদের থেকে অনুপ্রেরণা নেই! এর চেয়ে শাসকগোষ্ঠী চাইবে ছাত্ররা ডুবে থাকুক ‘আমি-তুমি’ ভালোবাসায়। চুলোয় যাক রাজনীতি। আমরাও তাই আওড়াই ‘আই হেট পলিটিক্স!’

শুরুতেই বলেছিলাম, ফেব্রুয়ারি ভালোবাসার মাস! বলতে পারেন, চৌদ্দ ফেব্রুয়ারি মহা ধুমধামে যে ‘ভালোবাসা দিবস’ উদযাপন করা হয় এখানে কি তার কথাই বলা হচ্ছে? সরাসরি উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করা উচিৎ, কোন ভালোবাসা অথবা সুখ আমাদের কাছে মুখ্য, ব্যক্তিগত নাকি সমষ্টিগত! কোন সুখের সন্ধানে আমরা দৌড়াব? ব্যক্তির সুখ? নাকি সমষ্টির সুখ? যদি সমষ্টিগত সুখের কথা বলি, তাইলে ১৪ ফেব্রুয়ারি আক্ষরিক অর্থেই ‘ভালোবাসা দিবস’, অন্তত আমাদের জন্যে হলেও। গুটিকয়েক লোক আত্মত্যাগ করেছে সমষ্টির স্বার্থে, এর চেয়ে অধিক ‘ভালোবাসা’ আর কি হতে পারে!


১৯৫২ সাল থেকে ২০১৮ এর দূরত্ব কতটুকু? এক অর্থে খুব বেশি না, অন্যভাবে যোজন যোজন দূরত্ব! যেমন, সেলিম রেজা নিউটনই তাঁর পূর্বোক্ত আলোচনায় বলেছিলেন, একুশ কোন সরকারী আমলাতান্ত্রিক অনুষ্ঠান ছিল না। মঞ্চ, আলো ফটোগ্রাফি, সরকারী আয়োজন, প্রচুর আনুষ্ঠানিকতা - এই ব্যাপারগুলোর সঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারির খানিকটা দূরত্ব আছে। এই দূরত্বের একটা বড়  প্রমাণ হচ্ছে আমাদের  বর্তমান মানসিকতা! এবং, মানসিকভাবে আমরা যে কতটা দেউলিয়া হয়ে গিয়েছি সেটার প্রমাণ হচ্ছে শহিদ দিবসে 'উৎসব'র আয়োজন করা। একুশের যে চেতনার কথা বলা হয়ে থাকে সেগুলো এখন আশ্রয় নিয়েছে পত্রিকার 'ফ্যাশন' পাতায় এবং 'রান্না'র পাতায় যেখানে কেকের উপর আঁকা হয় একুশ। সহজ কথা হচ্ছে, চেতনা দিয়ে কাজ হয় না, বরং একে কেন্দ্র করে ব্যবসা গড়ে তুলতে হবে। এবং এটাই হচ্ছে 'মুক্তবাজার অর্থনীতি'। তবু এসব মুক্তবাজার অর্থনীতির জিকীর  তুলে আমাদের দেউলিয়াপনা ঘুচবেনা। কোন দিনটা আনন্দের এবং কোনটা কান্নার সেটাই আমাদের এখন আর মস্তিষ্কে ধরে না। আজ একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'আনন্দ উৎসব' বানানো হচ্ছে; কাল পঁচিশে মার্চের 'কালো রাত' কে ঘিরে তৈরি হবে কেক, শাড়ি, কনসার্ট!

যে দূরত্বের কথা বলেছিলাম সেটা শুধু সময়ের প্রেক্ষিতেই না, বরং সেটা অন্যান্য ক্ষেত্রেও সত্য। ফাগুনের আগুন একসময় দ্রোহের আগুন জ্বালাত, সেই তাপে শাসকগোষ্ঠী নড়ে চড়ে বসতে বাধ্য হত। ফেব্রুয়ারি শুধু ভাষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না, বরং ফেব্রুয়ারি যে নানা রঙে নানা চেহারায় শাসকদের বারবার চ্যালেঞ্জ করে তার প্রমাণ সাখাওয়াত হোসেনের কিছু ছবি। ১৯৬৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে শহিদ মিনারের আশেপাশের এলাকা থেকে তিনি ছবিগুলো তুলেছিলেন। সে ছবিগুলোতে দেখা যায় যে দেয়ালজুড়ে বিভিন্ন শ্লোগান ও ছবি সম্বলিত হাতে আকা অনেকগুলো পোস্টার। খুব মনোযোগ দিয়ে ছবির শ্লোগানগুলো পড়লাম। একটাতে লেখা আছে, ‘মৌনীবাবা কথা বলে না, কানে শোনে না কিন্তু যখের মত পাহারা দেয় পুঁজিপতির পুঁজি।’ অন্য জায়গায় বলা আছে, ‘সহস্র জনতা বারবার প্রতিহত করেছে সাম্রাজ্যবাদের অশুভ প্রচেষ্টা। কিন্তু ঈগলের রক্তনখ উদ্যত প্রতিক্ষণে।’ আরেকটা ছবিতে আঁকা ছিল: কাঁটাতারের মধ্যে আটকে আছেন রবীন্দ্রনাথ, বাংলা অক্ষর এবং গণতন্ত্র! সাথে চোখে ও মুখে কাপড় দিয়ে অন্ধ ও বোবা করে রাখা দুজন মানুষের ছবি। সেই সাথে নিচে শ্লোগান লেখা, ‘চারদিকে নিষেধের বেড়াজাল, জুজুর মিথ্যা ভয়।’  অস্ত্রের মুখে ঔষধ খাওয়ানোর ছবি একে নিচে শ্লোগান লেখা হয়, ‘আর মিথ্যে নয়, আর ভয় নয়। কোন ঔষধেই ঘুম আর আসবে না। এখন নতুন শিশুর জেগে ওঠার পালা’।  আরেকটা ছবিতে লেখা আছে, ‘নতুন সড়কে চলতে হবে নতুন চেতনায় কিন্তু আমাদের জীবন শকট হাজার বোঝার ভারে এখন অচল।’  আরেকটাতে লেখা হয়েছে, ‘ঠিক মরীচিকার মতই শত শত আশ্বাস আমাদের নিয়ে চলেছে - কোন মুল্লুকে? মরূদ্যানের সন্ধান কি পাবোনা এই মুল্লুকেই?’

প্রশ্ন হচ্ছে, ফেব্রুয়ারি কি এখনো তার শাসকগোষ্ঠীকে চাপে ফেলতে পারবে? সে প্রশ্নের উত্তর ফেব্রুয়ারি দিবে না, দিতে হবে ফেব্রুয়ারিকে যারা উদযাপন করবে তাদেরকেই।

দেখা যাচ্ছে, একুশের চেতনা ও দাবিদাওয়া সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু যে স্থানে এসে সকল সময় এক বিন্দুতে মিলিত হয়ে যায় সেটা হচ্ছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং অন্যায়ের সামনে মাথা নত না করা।  দু হাজার আঠারো সালে এসে আমরা যে সকল রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের শিকার হচ্ছি তা বায়ান্নের মতো না হলেও তার তালিকা অনেক লম্বা। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড বলে চেঁচানো জাতি পরিকল্পিত প্রশ্ন ফাঁসের চক্করে ফেঁসে গিয়েছে; খোদ প্রধানমন্ত্রীও প্রশ্ন ফাঁসের  পক্ষে অবস্থান নেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিণত হয়েছে দলীয় সন্ত্রাসের আখড়ায়। পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে ব্যাংকিং খাতের তছনছ রূপ। উন্নয়নের মহাসড়কে চলছে একের পর এক দেশ ও পরিবেশবিনাশী প্রকল্প। সেই সাথে চলছে গুম, খুন, ধর্ষণ। সেটা যেমন সমতলে, তেমনি পাহাড়ে। পাহাড়কে রীতিমত বর্গা নিয়েছে সেনাবাহিনী। আমাদের জাতীয়তাবাদী উগ্রতা ও সেনাবাহিনী-প্রীতি সবই আজ এক সুতোয় গাঁথা পড়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ছিল পাকিস্তান জাতীয়তাবাদীর প্রতীক, এর প্রভাব আমরা দেখেছি। এখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীকও সামরিক বাহিনী হয়ে গেছে, যার প্রভাব পাহাড়ে বসবাসরত মানুষগুলো ভালোভাবেই টের পাচ্ছে। ২০১৮ সালে এসে, তাই,  ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রেরণা দিবে রুখে দাঁড়াতে, এই রাষ্ট্রীয় শোষণের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে।  এই দ্রোহের মধ্যেই নিহিত আছে ভালোবাসা। সেটাই হচ্ছে সমষ্টির প্রতি ভালোবাসা।

সূত্র:
১) বাংলাভাষা: রাজনীতির আলোকে – আহমদ ছফা
২) অচেনা দাগ সম্পর্ক স্বাধীনতা সংগঠন – সেলিম রেজা নিউটন
৩) সাখাওয়াত হোসেনের ছবি - মুক্তিযুদ্ধ ই আর্কাইভ ট্রাস্ট

সহুল আহমদ, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ