আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

অটিজম: অন্য আলোয় দেখা ভুবন

সঙ্গীতা ইয়াসমিন  

আজকাল গিফটেড চাইল্ড, স্পেশ্যাল নিড চাইল্ড, অটিস্টিক চাইল্ড শব্দগুলো আগের মতো অতোটা অপরিচিত নয়।তবুও আমাদের ছন্দবদ্ধ জীবনে কিছু কিছু শব্দ অনাকাঙ্ক্ষিত অনুভবের জন্ম দেয়। সমাজের প্রচলিত বিশ্বাস ও ধারণামতে আমরা কিছু শব্দ তৈরি করেছি, যার মধ্যে কিছু বিষয়কে আমরা স্বাভাবিক আর কিছু বিষয়কে অস্বাভাবিক বলে চিহ্নিত করি। এর কারণও রয়েছে- প্রথমত. হাজার বছরের চর্চায় যা যেভাবে চলে এসেছে তা দেখতে দেখতে আমাদের মনন ও মস্তিষ্ক অভ্যস্ত হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত.কার্যকারিতার ভিত্তিতে কোনো বিষয় বা বস্তুর যা করার কথা কিংবা যেভাবে করার কথা সে অনুযায়ী প্রত্যাশিত ফল না পেলেই আমরা তাকে অস্বাভাবিক বলে অভিহিত করি। আর এই অস্বাভাবিকতারও স্থান-কাল-পাত্র ভেদ আছে। নির্দিষ্ট কোনো সমাজ ও সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা সংস্কৃতি, দেশ ও সময়ের পরিক্রমায় ভিন্ন ভিন্ন হয়। এক সমাজের যা বুলি অন্য সমাজে তা গালি হিসেবেও বিবেচিত হয়। যখন কোনো সমাজ ও সংস্কৃতি কোনো বিষয়কে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে তা যত মন্দই হোক সেই সমাজের প্রেক্ষাপটে সেটি যথার্থ।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমাজব্যবস্থায়, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও রীতি-নীতিতে অনেক বৈপরীত্য রয়েছে, তথাপিও প্রত্যেকের নিজ নিজ সমাজের ক্ষেত্রে সেসব যুক্তিসঙ্গত ও চলনসই। তেমনি আমাদের সমাজের প্রচলিত বিশ্বাসে ও চর্চায় প্রতিবন্ধিতা একধরনের অভিশাপ। প্রতিবন্ধীদের সমাজ খুব সহজভাবে গ্রহণ করে না। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ তথা রাষ্ট্রের কোথাও খুব সম্মানের সাথে তাঁদের বিশেষ ভূমিকা রাখার সুযোগ নেহায়েতই সীমিত। যদিও বাংলাদেশে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিবন্ধীদের কিছু কার্যক্রম রয়েছে, সেগুলো প্রাতিষ্ঠানিক তো বটেই এবং নিতান্তই অপ্রতুল। আর বলা বাহুল্য, সেসব কার্যক্রম সরকারি চৌহদ্দির বাইরে এসে সমাজ মানসকে স্পর্শ করতে পারেনি। সমাজে তাই আজও অস্বাভাবিক বা প্রতিবন্ধী শিশুরা অবহেলিত। অস্বাভাবিক শিশুর জন্মদানকারী পিতা-মাতাও নিজেদেরকে লজ্জার আবরণে লুকিয়ে রাখে, যেনো এমন সন্তান জন্ম দিয়ে তাঁরাই অপরাধ করেছেন।

মাতৃত্ব যেহেতু নারীজীবনের পরম পরিতৃপ্তির এক মহার্ঘ বস্তু, সেই নারীকেই তাই শিশুর প্রতিবন্ধীতা, অস্বাভাবিকতার দায় নিতে হয় সর্বাধিক। শারীরিক, মানসিক, আবেগিক ও পারিপার্শ্বিক সকল চাপ সয়ে একজন মাই তাঁর অস্বাভাবিক শিশুটির বেড়ে ওঠার দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের খুব কমই সমানুভূতি আর ভালোবাসা নিয়ে পাশে থাকতে দেখা যায়। কোনো বৈবাহিক সম্পর্কে সন্তান উৎপাদন না হলে কোনোরকম চিকিৎসা ছাড়াই আজও আমাদের সমাজে নারীটিকে বন্ধ্যা বলে দোষারোপ করা হয়ে থাকে। একইভাবে প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্ম হলেও এখনও অনেক পরিবারে নারীর ওপরই দায় চাপানো হয়।

আমার জানামতে, কয়েকটি পরিবারের শাশুড়ি মা ছেলেকে দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পর পর দুটি অটিস্টিক সন্তান জন্মদানের অপরাধে। অথচ, সেই অটিস্টিক সন্তান জন্ম দিয়ে মা নিজেই যে যন্ত্রণার পাথর বুকে চেপে বেড়াচ্ছেন তার সাথী হবার জন্য তিনি কাউকেই পাশে পাননি। পরিবারের সদস্যদের উচিৎ ছিল মা ও শিশুর দুজনের জন্যই সমানুভূতি-ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ ও পরিবেশ নিশ্চিত করা।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের মধ্যে বর্তমানে বহুল আলোচিত অটিজম। অটিজম নিয়ে জন্মগ্রহণকারী শিশুদেরকে আপাতদৃষ্টিতে অনেকাংশেই অন্যদশজন শিশুর মতো স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। বিশেষজ্ঞ ছাড়া অন্য সকলের পক্ষে এই সমস্যাটি নির্ধারণ করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি এটি এমন কোনো রোগও নয় যে বিশেষজ্ঞ দেখিয়ে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে রাতারাতি এ সমস্যায় আক্রান্ত শিশুটিকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব।

অটিজম মূলত একধরণের নিউরোলোজিক্যাল ডিস-অর্ডার, যার ফলে মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারগুলো যথাযথভাবে নির্গমন ও সঞ্চালন হয় না, ফলত এর স্বাভাবিক কার্যাবলী ব্যাহত হয়। যা শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক, মানসিক ও আবেগিক বিকাশের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে ওঠে। অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা সামাজিক দক্ষতা, যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে দুর্বল হয়, অনেক ক্ষেত্রেই তারা অন্তর্মুখী স্বভাবের হয়। একা একা নিজের জগতে থাকতে ভালোবাসে। বাস্তব জীবনের অনেক বিষয়কেই তারা স্বাভাবিক আর দশটি শিশুর মতো দেখতে বা বুঝতে শেখে না। সাধারণত মস্তিষ্কের যে অংশ লজিক্যাল বুদ্ধির জন্য কাজ করে তাদের ক্ষেত্রে সেই অংশটি সঠিকভাবে কাজ করে না। সেকারণেই বয়স অনুযায়ী সাধারণ শিশুরা যেসব সামাজিক দক্ষতা অর্জন করে পারিপার্শ্বিকতা থেকে তারা সেসকল সামাজিক দক্ষতায় পিছিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে দরকার হয় বাড়তি সাহায্যের, ধৈর্যসহকারে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প আর প্রচেষ্টার। তবে অন্যান্য অস্বাভাবিকতার চেয়ে অটিজমের একটি বিশেষ দিক আছে, তা হল, শিশুর সাইন ও সিম্পটম দেখে আর্লি ডায়াগনোসিস হলে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে অনেকের পক্ষেই স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব।

অটিজমে আক্রান্তদেরকে কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের ছকে ফেলে একটি স্কেল দিয়ে পরিমাপ করা হয়। যদিও প্রত্যেক শিশুই ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী আবার প্রত্যেকেই কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে অভিন্ন। অটিজম স্কেলে স্বল্প, মধ্যম ও উচ্চমাত্রা রয়েছে; এই স্কেলই মূলত নির্ধারণ করে দেয় কোন শিশু স্বল্পমাত্রায়, কোন শিশু মধ্যম আর কারা উচ্চমাত্রায় অটিজমে আক্রান্ত। আশার কথা হল, স্বল্প আর মধ্যমমাত্রায় আক্রান্ত শিশুরা পরবর্তী জীবনে কেবল স্বাভাবিক জীবনযাপনই করে না, সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদানও রাখতে পারে। আমাদের পৃথিবীতে এমন বিখ্যাত অনেক ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যারা তাঁদের শৈশবে অটিজমে আক্রান্ত ছিলেন।

গ্রীক শব্দ “autos” থেকেই “autism” এর উৎপত্তি, আত্মনিমগ্নতাই এর মর্মার্থ, আগেই উল্লেখ করেছি এরা নিজেদের মতো আপন জগতে বিচরণ করতে ভালোবাসে। একজন সুইস সাইকেয়াট্রিস্ট সিজিওফ্রেনিক রোগীর বৈশিষ্ট্য নিরূপণে সর্বপ্রথম এই টার্মটি ব্যবহার করেছিলেন ১৯০৮ সালে। পরবর্তীতে মার্কিন গবেষকগণ শিশুর সামাজিক ও আবেগিক দক্ষতার বৃদ্ধিজনিত সমস্যার ক্ষেত্রে এই টার্ম ব্যবহার করেন।

জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির গবেষক ড. লিও কার্নার ১৯৪২ সালে ক্লাসিক অটিজমের ওপর প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে সামগ্রিক রূপদান করেন। গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি দশজন অটিস্টিক শিশুর মধ্যে একজন অসামান্য প্রতিভার অধিকারী। অতীতে সিজিওফ্রেনিক, কিংবা চাইল্ড সাইকোসিস নামে একে অভিহিত করা হলেও এর অস্তিত্ব যে ২০ শতকের অনেক আগেও আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছিল এবং তা সত্ত্বেও শিশুরা তাদের ভবিষ্যত জীবনে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদানই নয়, বিশেষভাবে খ্যাত হয়েছেন যা আমরা নীচের নামগুলির দিকে এক ঝলক তাকালেই বিশ্বাস করব।
Charles Darwin – Naturalist, Geologist, and Biologist
Bill Gates – Co-founder of the Microsoft Corporation
Steve Jobs – Former CEO of Apple
William Butler Yeats – Poet
Sir Isaac Newton – Mathematician, Astronomer, & Physicist
Albert Einstein – Scientist & Mathematician
Emily Dickinson – Poet
Lewis Carroll – Author of “Alice in Wonderland”
সুতরাং, স্বল্পমাত্রার ও মাঝারি মাত্রার অটিস্টিক শিশুরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা, কাউন্সেলিং ও জীবন দক্ষতার প্রশিক্ষণ পেলে নিজেদের জীবনে তথা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান রাখতে পারে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। শুধু তাই নয়, যেহেতু বাস্তবের সাথে খুবই স্বল্প সম্পর্কিত বুদ্ধি নিয়ে তারা জন্মায়, সেক্ষেত্রে হিংসে-দ্বেষ, হানাহানি, যুদ্ধবিগ্রহসহ সমাজের অন্যসকল কুটিলতাও এসব শিশুদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সহজে লক্ষ্য করা যায় না। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তারা খুব কোমলমতি, সহজ-সরল হয়, স্নেহ ভালোবাসার প্রতি দুর্বল থাকে। আর একটুখানি ভালোবাসা পেলেই তারা ভরসা করতে পারে নিজের ওপরে, তৈরি হয় আত্মমর্যদাবোধ।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উন্নত বিশ্বে এখনও অটিজমের সঠিক কারণ নির্ণয়ের জন্য গবেষকগণ নিরলস গবেষণা করে যাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে আমরা তো পিছিয়ে আছি হাজার বছরেরও ওপাড়ে। যদিও প্রাথমিক কারণ হিসেবে এখন পর্যন্ত যেসকল গবেষণা ফলাফল রয়েছে তাতে দেখা যায়, এই কারণকে গবেষকগণ মোটাদাগে দুটো ভাগে ভাগ করেছেন, যথা- জেনেটিক ও পরিবেশগত। জেনেটিক কারণ শতকরা ৬৮ ভাগ আর পরিবেশগত কারণ ৩৮ ভাগ। যেহেতু জেনেটিক কারণের ওপর আমাদের কোনো হাত নেই, তাই পরিবেশগত কারণের ওপর জোর দেওয়াই সমীচীন বলে মনে করি আমি। সেক্ষেত্রে, শিশুর দুই বছর বয়সের মধ্যেই আটিজম নির্ণয় করা সম্ভব হলে এবং তৎক্ষণাৎ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য কর্মসূচি নেয়া সম্ভব হলে শিশুর জীবনের দূর্বিসহ অবস্থার মাত্রা লাঘব করা সহজতর হয়। বয়স সাত/আট পেরিয়ে যাবার পরে কার্যক্রম শুরু করলে ফললাভের মাত্রা ও গতি শ্লথ হয়।

শিশুর অটিজম রয়েছে কিনা সেটি বোঝার জন্য সবচেয়ে জরুরী দরকার হল, নিবিড় পর্যবেক্ষণ। আর এ কাজটি শিশুর প্রাথমিক পরিচর্যাদানকারী; তিনি মা, ঠাকুমা/দিদিমা, কিংবা নানী যিনিই হোন না কেন কিছু লক্ষণ দেখেই অস্বাভাবিকতা আঁচ করতে পারেন। আর তখনই সরাসরি শিশু বিশেষজ্ঞ কিংবা শিশুমনোবিজ্ঞানীদের সাহায্য নিতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অটিজম বিষয়ে সচেতনতার জন্য প্রতিবছর নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে সরকারি-বেসরকারি ও সংশ্লিষ্ট প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানসমূহ নানাবিধ কর্মসূচির আয়োজন করে থাকে এপ্রিলের ২ তারিখে।

আমাদের চিকিৎসকেরাও এ বিষয়ে অনেক বেশি তথ্যসমৃদ্ধ, গণমাধ্যমও পিছিয়ে নেই তথ্য সরবরাহে। আর ইন্টারনেটের এই যুগে ‘গুগল’ নিঃসন্দেহে আমাদের বড় বন্ধু; হাতের কাছে মাউসটি নিয়ে সার্চে ক্লিক! ব্যস, পৃথিবীর সকল তথ্য এনে আপনার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়বে আলাদীনের চেরাগের মতো।

উন্নত বিশ্বে শিশুর অটিজম কোনো আলাদা বিষয় নয়, শিশুবিকাশেরই একটি পর্যায় ও পদক্ষেপমাত্র! ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালের ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি দশ হাজারজন শিশুর মধ্যে জাপানে ১৬১ জন, ইউকেতে ৯৪, সুইডেনে ৭২, ডেনমার্কে ৬৮, ইউএসএতে ৬৬, কানাডায় ৬৫, অস্ট্রেলিয়ায় ৪৫, ব্রাজিলে ২৭, হংকংয়ে ১৭ এবং এই তালিকায় সবচেয়ে নিচে রয়েছে পর্তুগাল, যাদের হার ৯.২।

গ্লোবাল অটিজম মুভমেন্ট অ্যান্ড বাংলাদেশের তথ্য অনুসারে ঢাকা শহরে সমগ্র জনসংখ্যার শতকরা ৩ জন এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এর হার অতি নগণ্য। যদিও, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই তথ্য কতোটা নির্ভরযোগ্য বলা মুশকিল(!) তবে এর মাত্রা ও হার যে দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা গ্লোবাল ট্রেন্ড দেখেই খুব সহজে অনুমেয়।

উন্নত বিশ্বের স্কুলেই এসব শিশুদের জন্য নানাবিধ কর্মসূচি রয়েছে, রয়েছে কমিউনিটিভিত্তিক কর্মসূচিও। রাষ্ট্রই শিশুর দায়িত্ব নেয়, শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর পরে তাদের সামর্থ্য ও যোগ্যতা বিবেচনায় সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্তির জন্য সরকারের বরাদ্দ, সম্পদ ও সুযোগের রয়েছে অবারিত দ্বার। বয়স অনুযায়ী, শ্রেণিভেদ ও ক্যাটাগরি অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি তহবিল-অনুদান রয়েছে এসব শিশুদের জন্য। যারা উচ্চমাত্রার অটিজম হিসেবে চিহ্নিত তাদের সারাজীবনের দায়িত্বও সেখানে গ্রহণ করে রাষ্ট্র। সেখানকার মানুষের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীও অতি সহজ, সাদামাটা এবং অতিমাত্রায় সংবেদনশীল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এই জনগোষ্ঠীর প্রতি। কারণ, তাঁরা বিশ্বাস করেন, প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মানোটা কোনো অপরাধ নয়, যদি রাষ্ট্র-সমাজ সেই প্রতিবন্ধীতাকে গ্রহণ করতে তৈরি না থাকে, সেই রাষ্ট্রই প্রতিবন্ধক, সেই দায় রাষ্ট্রের! সমাজের কিংবা মানুষের নয়।

কিন্তু আমাদের মতো জটিল সমস্যাসংবলিত, রাজনীতির নোংরা পঙ্কিলে আবৃত, কুসংস্কারের অন্ধকূপে নিমজ্জিত একটি দেশের জন্য অটিজমের এই সামান্য মাত্রাও অতিশয় উৎকণ্ঠার কারণ। কেননা, আমাদের সন্তানদের ভালোমন্দের দায় আমাদেরকেই নিতে হয়। সুতরাং, আমাদের সন্তানেরা যারা অটিজমকে সাথে নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছে তাদের জন্য আমরা আরও বেশি সংবেদনশীল হই,আরও বেশী তথ্যসমৃদ্ধ হই। অটিজমকে ভয় না করে সহজ সত্যকে গ্রহণ করি। বিশ্বাস করতে শিখি, অটিজম কোনো অভিশাপের ফসল নয়। ভালোবাসা দিয়ে আপনার সন্তানের পাশে থাকুন। সে আপনার জন্য জিপিএ ফাইভ নিয়ে আসবে না হয়তো, তবে একজন সফল মানুষ হয়ে বেড়ে উঠতে পারে, যা আপনি ভাবেনওনি কখনও। ওর ভাবনার জগতকে প্রস্ফুটিত হতে দিন, ওর না-বলা বেদনাগুলো বুঝতে চেষ্টা করুন, ওর ভেতরটা পড়তে চেষ্টা করুন, ওর সাথে থাকুন বন্ধু হয়ে, ওর একান্ত জগতকে ছুঁয়ে দিতে পারেন আপনিই।

অটিজম কোনো রোগ নয়, অটিজম আপনার ভাবনার জগতকে প্রশস্ত করে, অন্য আলোয় জীবন ও জগতকে চিনতে শেখায়। অটিজম এক সংগ্রামের নাম। নারী হয়ে জন্ম নিলে যেমন সমস্ত পৃথিবীই তাঁর যুদ্ধক্ষেত্র, নারীকে প্রমাণ দিতে হয় সর্বক্ষেত্রেই ‘তিনিও পারেন’! তেমনি অটিস্টিক শিশুর মাকেও একইরকম যুদ্ধে নামতে হয়। তবে, যুদ্ধটা যখন কেবল নিজের সাথে, সেই লড়াইটা বড় যন্ত্রণার, বড় কষ্টের! নিষ্ঠুর সেই লড়াইটা বড়ই সঙ্গীবিহীন! তবুও বলব, শেষতক মায়েরা হার মানে না, ভালোবাসাই যেখানে বড় অস্ত্র, সে যুদ্ধে জয় হবেই।

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসের এই প্রাক্কালে সকলকে আহ্বান জানাই আসুন-আমাদের “গিফটেড” এই শিশুদেরকে সমাজের কাছে সত্যিকারের “গিফট” হিসেবে উপস্থাপন করি।খুঁজে বের করি ওদের সত্যিকারের সামর্থ্য কোথায়, আর সেখানেই কাজ আমার-আপনার।দরকার শুধু সচেতনতা, সদিচ্ছা আর ভালোবাসা। আজকের দিনে সকল অটিস্টিক শিশু ও মায়েদের জন্য গভীর শ্রদ্ধা অন্তরের অন্তস্থল থেকে আর পরম মমতামাখানো ভালোবাসা।আপনারা এই যুদ্ধে জয়ী হোন, একটি সুস্থ, সুন্দর আগামীর বাংলাদেশ গঠনে আমাদের শিশুরা ভূমিকা রাখবে সেই আশাবাদ রইল সকলের জন্য।
(তথ্যসূত্রঃ অটিজম কানাডা-২০১৫, গ্লোবাল অটিজম মুভমেন্ট অ্যাণ্ড বাংলাদেশ-২০১৩, ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্ল্যাল-২০১৭, এবং ওয়েবসাইট-অ্যাপ্লাইড বিহ্যাভিয়ার অ্যানালাইসিস প্রোগ্রাম।)

সঙ্গীতা ইয়াসমিন, কানাডা প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ