প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আলমগীর শাহরিয়ার | ০৮ এপ্রিল, ২০১৮
“স্যার প্রশ্ন তো ফাঁস হয়নি। তারপর প্রশ্ন অনেক কঠিন হয়েছে। স্যার ফেল তো করবানি। নাম্বারটা একটু বেশি করে দিয়েন। নাম্বার কম দিয়ে কি লাভ! একদিন তো আমরা মরেই যাবো।”- এ বছর এসএইচসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের এক শিক্ষার্থী খাতায় উপরের কথাগুলো লিখেছে। কথাগুলো অনেকের ফেসবুক ওয়ালে-ওয়ালে ঘুরছে।
অনেকে বিষয়টা বিনোদন হিসেবে নিয়েছেন। কিন্তু বিষয়টি মোটেই বিনোদনের নয়। প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার মত করে তরুণদের মনোজগৎ ফাঁস হওয়ার মতোই একটা সিরিয়াস ঘটনা। আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি বা চোখ বন্ধ করে এড়িয়ে যাচ্ছি। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই কী প্রলয় বন্ধ থাকে! না, এসব সে প্রলয়ের একটি ভাষিক পূর্বাভাস।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার প্রায়ই আক্ষেপ করে বলেন সময়টা সৃষ্টিশীল না, অনুর্বর। পাশাপাশি স্মরণ করেন ষাটের দশকে তাদের যৌবনের সময়কে। প্রেম-দ্রোহ-সৃষ্টিতে মুখর তারুণ্য। সেসময় নাকি প্রতি সপ্তাহে একটা সিনেমা মুক্তি পেত যার গান মানুষের মুখে মুখে ফিরত। এখন বছরেও এমন একটা গান শোনা যায় না যেটা মানুষের মুখে মুখে ফিরে। বিনোদনের বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে, মাধ্যম বদলেছে। তবু গান দূরে থাক আজকাল সহসা ভালো একটি সিনেমা তৈরি হয়না। বইমেলায় হাজার হাজার বই বের হয় কিন্তু সময়কে, কালকে আলোড়িত করে এমন লেখা ও লেখক কই? কেবল ফটোসেশন আর আত্মপ্রচারের ঢাকঢোল পেটানো নিষ্ফল উৎসব হয়।
ভোগবাদী সময়ে আমাদের সামনে একটা চরম হতাশ প্রজন্ম বেড়ে উঠছে! এরা কেবল ভোগ জানে, জীবনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে জানে না। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বলেন, ‘ভোগ করে দানব। উপভোগ করা ঈশ্বরের কাজ।’ ভোগে এক সসয় মানুষের ক্লান্তি আসে। পাপ-পুণ্যের বোধ আসে। পরিণামে হতাশা গ্রাস করে। অনেক তরুণদের দেখলে, কথা বললে মনে হয় এদের সুস্পষ্ট কোন লক্ষ্য, স্বপ্ন ও উদ্দেশ্য নেই! যেন জীবন তাদের কাছে এক নিরুদ্দেশ যাত্রা। পড়াশোনা করে লাভ কী, ভাল রেজাল্ট করে লাভ কী, জীবন নিয়ে এত ভাবনার কী- একদিন তো মরেই যাব। ফেসবুকে ফান পোস্ট হিসেবে দিলেও এর মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত সত্য লুকিয়ে আছে। সে সত্য খেলাচ্ছলে তাদের অন্তঃসারশূন্য জীবনদর্শনকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। কোথাও কোন দায়বদ্ধতা নেই। বোধ নেই। এটা একটা চরম হতাশা ও নৈরাশ্যেভরা খেদোক্তি। এ যেন মরে যাবার আগেই মরে যাওয়া একটা প্রজন্মের আর্তনাদ, বিলাপ।
আমাদের এই নতুন প্রজন্মের সৃষ্টিশীল আত্মা কি তবে মরে যাচ্ছে! তাদের শরীরে, বহিরঙ্গে শুধুই চাকচিক্য! ভেতর ফাঁপা। তাদের সৃষ্টিশীল হৃদয় কই! প্রেম ও প্রণয়ের গান কই! এদের মধ্যে এতো হতাশা জমল কবে থেকে! প্রবল জীবন তৃষ্ণার বদলে এদের এমন জীবন বৈরাগ্য ও মনোযাতনা কেন, এর চিকিৎসা কী!
প্রাসঙ্গিক একটি অভিজ্ঞতা বলি। কাজের প্রয়োজনে সুবর্ণচর উপজেলায় এসেছি। পরদিন সন্ধ্যায় চারপাশ একটু ঘুরে দেখা ও হাঁটার জন্য বের হয়েছি। উপজেলার একটা বিশাল কলেজ মাঠের সামনে দিয়ে যাচ্ছি। দেখলাম মাঠ শূন্য। খাঁ খাঁ, বিরান ভূমি। মাঠে একটা কাকপক্ষী নেই। এমন সুন্দর সবুজ দূর্বাঘাসে ঢাকা প্রশস্ত মাঠে বিকেলে কেউ খেলছে না। আমি ভাবতেই পারিনি। একটু এগিয়েই দেখলাম মাঠের এক কোণে ৮-১০টা ছেলে জটলা পাকিয়ে বসে আছে। প্রত্যেকের হাতে স্মার্ট ফোন। সবাই তসবির গোটার মত মুঠোফোন অবিরাম টিপছে। আশ্চর্য কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছেও না। গল্পও করছে না। একসঙ্গে থেকেও কেউ যেন কারোর সঙ্গে নেই। আমি ভাবতে পারিনি এমন সুন্দর একটি বিকেল, একটি মাঠ এমন তারুণ্যের হৈ চৈ আর পদভারে মুখরিত নয়, শূন্য। এই তরুণদের কেউ হয়ত ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখছে, এই বসন্ত বিকেলে খেলাধুলা করে কি করব-একদিন তো মরেই যাব!
এই হতাশার সামগ্রিক চিত্র খুব বিপদজনক, রীতিমতো উদ্বেগ উৎকণ্ঠার। চৈত্রে ধেয়ে আসা কালবোশেখি ঝড়ের মত অশনি কিছুর বারতাও বহন করে। একদিন যখন মরেই যাবে জেনে গেছে তখন মরার আগে এরা বিধ্বংসী কিছু করেও মরে যেতে পারে। এটা একটা সাধারণ এক্সপ্রেশন নয়। একটা প্রজন্মের হতাশার চোরাগলিতে একলা হাঁটার চিৎকার। এই ভাইরাল চিৎকার বেদনার, ভয়জাগানিয়া ও শঙ্কার।
আমেরিকায় হতাশ তরুণরা প্রায়ই রাস্তায়, জনসমাগমে নির্বিচার গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করে। নিজেও আত্মহত্যা করে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের হতাশ প্রজন্মকেও কোন বিশেষ গোষ্ঠী কোন বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিল করতে রিক্রুট করতে পারে এবং মনে হয় না এ প্রচেষ্টা থেমে আছে। দেখা গেছে এদেশে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত সিংহভাগরাই অনলাইনের মাধ্যমে বিভ্রান্ত হয়েছে। এ পথে পা বাড়িয়েছে। বিশেষ করে নগর জীবনে ব্যস্ত বাবা-মার নিঃসঙ্গ সন্তানেরা ঘরে বসে বসে কম্পিউটারে শুধু নেট ব্রাউজিং করেই একদিন আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের জালে জড়িয়ে গেছে। দেখা গেছে এদের মূলধারার জীবনপ্রবাহের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই, বিচ্ছিন্ন। আর এ বিচ্ছিন্নতাই তাদের অপরাধে অনায়াসে যুক্ত করে। বিশ্বায়নের কালে প্রযুক্তির যুক্ত হবার স্লোগান মানুষকে বিযুক্তও করছে দিনকে দিন!
আমাদের তরুণেরা সেরকম বিচ্ছিন্নতায় ডুবে কোন অন্ধকার পথে পা বাড়ানোর আগে- তাদের নিয়ে ভাবা জরুরি। নাকি যারা ভাববেন তারাও নীরবে সুর মেলাচ্ছেন, ভেবে কী লাভ? একদিন ত আমরাও মরে যাব!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য