আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

দিন শেষে আওয়ামী লীগ এশার মতোই একা

জুয়েল রাজ  

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পর থেকে যেদিকে তাকাই শুধু আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ। ডানে আওয়ামী লীগ, বামে আওয়ামী লীগ, সামনে পিছনে, ছাত্রলীগে, যুবলীগে, তাও স্থান সংকুলান না হলে শত শত সংগঠনের নামের সামনে বঙ্গবন্ধু কিংবা পিছনে লীগ শব্দ লাগিয়ে সবাই আওয়ামী লীগ। যেমনটা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে। স্বাধীনতার মাত্র চার বছরে সবাই আওয়ামী লীগ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু দিনশেষে আওয়ামী লীগ বড় একা ছিল। হাতে গোণা পোড় খাওয়া কিছু নেতা ছাড়া, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, ক্ষমতার স্বাদ নিতে আসা সব আওয়ামী লীগ বোল পাল্টে খন্দকার মোশতাক থেকে শুরু করে জিয়াউর রহমান, এরশাদের প্রভুভক্ততে পরিণত হয়েছিলেন। ১৯৭৫ নয় শুধু, একই চিত্র ছিল ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর, পালিয়েছিলেন। কেউ কেউ মুখোশ ছেড়ে বাইরে এসেছিলেন। ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের শাসনামলে ও অনেকেই সংস্কারের নামে বোল পালটেছিলেন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে পক্ষে বিপক্ষে নানা মুনির নানা মত শেষে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অভিমানে ক্ষোভে কিংবা অনুরাগের বশবর্তী হইয়া ও যদি সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন সেটাই মীমাংসিত সিদ্ধান্ত। কারণ সেটি সংসদে দেয়া তাঁর বক্তব্য।

আওয়ামী লীগ, সরকারী দল হিসাবে শুরু থেকেই কোটা সংস্কার নিয়ে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় ছিল। হয়তো আভ্যন্তরীণ ভাবে দলীয় কোন সিদ্ধান্ত ও তাঁদের ছাত্র সংগঠনের প্রতি ছিল। এই আন্দোলনে যোগ দেয়া না দেয়া নিয়ে।

কিন্তু গত ১০ এপ্রিল গভীর রাতে ইফফাত জাহান এশার উপর যে নির্মমতা নেমে এসেছিল শুধুমাত্র ছাত্রলীগের সভাপতি হিসাবেই তাকে এই দায় মেটাতে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে ঘটনাটি হয়তো খুব বিশাল কিছু নয়। বাংলাদেশের অস্থির সমাজ ব্যবস্থায় স্বাভাবিকভাবে ঘটনাটি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে হয়তো। কিন্তু এশার ঘটনাটি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, ছোট করে হলেও এশা আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করে। এশার ঘটনাটি যার কারণে একটি বার্তা দিয়ে যায়।

গত ১০ এপ্রিল মঙ্গলবার গভীর রাতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাওয়ার অপরাধে এক ছাত্রীর পায়ের রগ কাটার গুজব ছড়িয়ে কয়েকশ ছাত্রী হল ছাত্রলীগের সভাপতি এশাকে তার কক্ষে অবরুদ্ধ করে স্লোগান দিতে থাকেন। খবর পেয়ে অন্যান্য হল থেকেও শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে সুফিয়া কামাল হলের সামনে আসেন। এরপর যে ভয়ঙ্কর ঘটনাটি ঘটে। ছাত্রলীগের হল শাখার বর্তমান সভাপতি এশাকে নারকীয়ভাবে নির্যাতন করা হয়। গায়ের কাপড় ছিঁড়ে তার ছবি তোলে রাখা হয়। গলায় পরানো হয় জুতার মালা। রাতের অন্ধকারে বের করে দেয়া হয় হল থেকে।

সেই ভিডিও মুহূর্তের মধ্যেই ভাইরাল করে দেয়া হলো। মুহূর্তেই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি, সংবাদ মাধ্যমে এশাকে বহিস্কারের প্রেস রিলিজ দিয়ে নিজেদের আন্দোলনের পক্ষের শক্তি হিসাবে প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোন ধরনের তদন্ত ছাড়াই বহিস্কারের ঘোষণা দিয়ে দিল।

এশাকে নিপীড়নের সেই ভিডিওটি আমি কয়েকবার দেখেছি। আমি বারবার তার মুখের দিকে তাকিয়েছি। কতোটা অসহায়, কতোটা একলা ছিল এশা। কোটা সংস্কার আন্দোলনের যে শত শত আন্দোলনকারী সেইরাতে এশার উপর চড়াও হয়েছিলেন, সেখানে ছাত্রলীগের সমর্থনকারীদের সংখ্যা না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রলীগের একটি কমিটি ছিল। ভাইয়ের জন্য ভাইয়ের, বন্ধুর জন্য বন্ধুর প্রাণ দেয়ার বহু ঘটনা আছে। কিন্তু এশার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিল না। একটা প্রাণি সেই দুঃসময়ে তার পাশে দাঁড়ায়নি। প্রতিবাদ না করুক মধ্যস্থতাকারী হিসাবেও কেউ দাঁড়ায়নি। একটা মানুষ পাওয়া যায়নি প্রতিবাদের। ছাত্রলীগের পুরাতন কিছু নেতাকর্মী প্রথম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং এশার পাশে দাঁড়ান।

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি দুধে ধোয়া তুলসি পাতা নয়। ছাত্রলীগও বাংলাদেশের রাজনীতির ধারাবাহিকতার বাইরে নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতার একটা দাপট থাকে। এটা সব দলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। হলের মেয়েদের আন্দোলনে যেতে বাঁধা দেয়ার যে অডিও টেপটি অনলাইনে ছাড়া হয়েছে, অনেকেই এশাকে দায়ী করছেন তার দাপটের জন্য। কিন্তু এশার জায়গায় যে কেউ থাকলে একই ঘটনা ঘটতো। এশা তাঁর নিজ সংগঠনের প্রতি তার দায়িত্ব পালন করেছে। হল শাখার সভাপতি হিসাবে তার ঠিক কাজটাই করেছিল এশা। যা এক সপ্তাহ পরে এসে সঠিক প্রমাণ হয়েছে। জামায়াত, বিএনপির একটি পরিকল্পিত আন্দোলন ছিল এই কোটা সংস্কার আন্দোলন। সংবাদ মাধ্যমে সেইসব চিত্র উঠে আসছে একে একে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে, শেখ কামালের বিরুদ্ধে, শেখ মনি সহ আত্মীয় স্বজনের বিরুদ্ধে শুধু মিথ্যাচার আর গুজবের ছড়াছড়ি ছিল। এবং সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের ঘৃণার উদ্রেক তাঁরা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা অনেকাংশেই সেদিন সফল হয়েছিল।

আমি এশার ঘটনাটিকে যার জন্য এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ দেখিনা। সেই একই মিথ্যাচার, গুজব ছড়িয়ে হলের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর মানুষটিকে মুহূর্তে মানসিকভাবে খুন করে ফেলে। এশার সব মিথ্যা অপরাধ স্বীকার করে নিলে, এশাকে চাইলেই তারা বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারতো। অবরুদ্ধ এশাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারত। চাইলে পিটিয়ে মেরেও ফেলতে পারতো। কিন্তু জুতার মালা গলায় দেয়ার মতো ভাবনাটা কেমন করে আসলো। সেই মালাটাই কে হাতে নিয়ে বসেছিল?

এশার এই নির্যাতিত অপমানিত হওয়ার মধ্য দিয়ে একটি বার্তা কিন্তু দিয়ে গেছে আওয়ামী লীগের জন্য। ১৯৭৫ সালে যেমন কেউ পাশে দাঁড়ায়নি ২০১৮ কিংবা ২০৩১ কিংবা ২০৪১ সালেও একই ঘটনা ঘটবে। ডান বাম আর সুযোগ সন্ধানী আওয়ামী লীগের কেউ পাশে এসে দাঁড়াবে না। জুতার মালা গলায় নিয়ে রাতের আঁধারে হারিয়ে যাবে এশার মতো দায়িত্বশীল একনিষ্ঠ নেতা কর্মীরা।

মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ কেউই দেখাতে পারেনি। এক শেখ হাসিনার পাহাড় সমান জনপ্রিয়তা আর কর্মের উপর সওয়ার হয়েছে পুরো আওয়ামী লীগ। কোটা সংস্কারের নামে আন্দোলন করে, মিথ্যাচার করে, গুজব ছড়িয়ে দীর্ঘ মেয়াদী একটি ফসল ঘরে তুলেছে আন্দোলনকারীদের পৃষ্ঠপোষকগণ। যার প্রথমটি মুক্তিযুদ্ধকে তরুণ প্রজন্মের কাছে বিতর্কিত করা। দ্বিতীয় ফসলটি হলো তরুণদের একটি বিশাল অংশকে আওয়ামী লীগের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন করে তোলা। কারণ বাংলাদেশ এখন তরুণদের দেশ ৪৯ শতাংশ মানুষের বয়স নাকি ২৪ বছর বা তার নীচে। আর কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১০ কোটির উপরে। ২০৩০ সালে বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১৩ কোটিতে। যা মোট জনসংখ্যার ৭০শতাংশ। আজকের তরুণরাই আগামী নির্বাচনে ভোট দিবে। ২০৩০ সালে দেশকে নেতৃত্ব দিবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে বৃহৎ একটা অংশ যারা আওয়ামী রাজনীতির বাইরে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। কিংবা দিনশেষে তার ভোটটি নৌকায় ছিল। সেই বৃহৎ তরুণ অংশকে নৌকা বিমুখের পরিকল্পনার অংশই আন্দোলন, মিথ্যাচার। কারণ আন্দোলনে কারা নেতৃত্ব দিয়েছে সেই বিষয়টি এখন দিনের আলোর মতো পরিস্কার। বিশেষ করে, ২৫৭ ধরণের কোটার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়েই তাঁদের সবচেয়ে বেশি আপত্তি ছিল। ছাত্রলীগের ও একটি অংশ সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। আর ভয়টা এখানেই সবচেয়ে বেশী। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ না করে যে তরুণ বা তরুণী ছাত্রলীগের রাজনীতি করে, আবার ব্যক্তিস্বার্থে সংগঠনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, এদের হাতেই আগামী দিনের নেতৃত্ব।

ফিনিক্সের মতো শেখ হাসিনাই ৭৫ পরবর্তী আওয়ামী লীগকে একলা বয়ে নিয়ে আজকের জায়গায় দাঁড় করিয়েছেন। সব দেখে শুনে মনে হয় আওয়ামী লীগ আসলেই একা। ১৯৭৫ সালে যেমন একা ছিলেন বঙ্গবন্ধু।

জুয়েল রাজ, সম্পাদক, ব্রিকলেন; যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি, দৈনিক কালেরকন্ঠ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ