প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ১৪ মে, ২০১৮
প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গে বলেছেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই বলছি যারা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব যারা দিচ্ছে তাদের অধিকাংশই ছাত্র শিবিরের।
সম্প্রতি একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, একটি মাদ্রাসা কমিটিতে জায়গা না পাওয়ায় সংক্ষুব্ধ পক্ষ একজন মাদ্রাসা শিক্ষকের মাথায় মল ঢেলে দিয়েছে। এই ভিডিও দেখে অনেকে বিস্মিত হয়েছে, এরকম আদিম সংস্কৃতি কোত্থেকে এলো! আসলে এটি খুব শেকড় সংলগ্ন ভিলেজ পলিটিক্সের সূত্র। একে বলা হয়, ‘গান্ধা’ কইরা দিলাম সংস্কৃতি।
এই সংস্কৃতির শেকড় যে সমাজের গভীরে প্রোথিত তা বিভিন্ন ঘটনাতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনটি শুরুর পর থেকে ধাপে ধাপে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-ছাত্রীদের গান্ধা করে দিতে অসংখ্য চেষ্টা চোখে পড়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকার সমর্থকেরা আন্দোলনকারীদের নানাভাবে গান্ধা করে দিয়ে আন্দোলন বন্ধের চেষ্টা করেছে। অভিজ্ঞ রাজনীতিক মতিয়া চৌধুরী দাড়ি কমা সেমিকোলন বাদ দিয়ে সংসদে দাঁড়িয়ে এই আন্দোলন সম্পর্কে যে বক্তব্য রেখেছেন, তা দিয়ে একটি হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছেন, "রাজাকারের বাচ্চা"।
অমনি সেটি লুফে নিয়ে একাত্তর টেলিভিশনের টকশোতে আন্দোলনের দু'একজন প্রতিনিধিকে সংযুক্ত করে তাদের ফেসবুক আইডির নানা বক্তব্য দেখিয়ে তাদের "দেশের শত্রু প্রমাণের চেষ্টায় এমবেডেড জার্নালিজম (বিছানাগত সাংবাদিকতা) করা হয়েছে।
এই প্যাটার্ন খুব পরিচিত। ইরাক হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্রের সে সময়ের প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াকার বুশ মুসলমানদের "আল-কায়েদা" তকমা দিয়ে তোতা পাখির মত তা উচ্চারণ করতেন। সিএনএন টেলিভিশন এমবেডেড জার্নালিজম (বিছানাগত সাংবাদিকতা) করে ইরাক তথা মুসলিম বিশ্বকে আল কায়েদার সমার্থক করে তুলতে চেষ্টা করেছে।
সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হিটলারের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ গোয়েবলস উপদেশ দিয়েছিলেন, একটি মিথ্যাকে বার বার উচ্চারণ করলেই তা সত্যে প্রমাণিত হয়। কিন্তু হিটলারের সত্য সভ্যতার সত্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। জর্জ ওয়াকার বুশের সত্যও সভ্যতার সত্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি।
ব্যর্থ যোগাযোগ সূত্র নিয়ে মাঠে নেমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার সত্যকে সভ্যতার সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না; বলাই বাহুল্য।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিস্তার সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে এমন ভাবে ঘটেছে যে, প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিলের ঘোষণা দিতে দেরি করেননি।
কিন্তু সে ঘোষণার একমাস হয়ে গেলেও কোন দপ্তর নির্দেশ জারি হয়নি। সচিব পর্যায়ের লোকেরা এ সম্পর্কে নানারকম কথা-বার্তা বলেছেন। কিন্তু এই একমাসে নানাভাবে আন্দোলনকারীদের "রাজাকারের বাচ্চা" বা "শিবির" প্রমাণের চেষ্টা চলেছে গান্ধা কইরা দেওয়া পদ্ধতিতে।
শাহবাগের গণজাগরণের পরে বিএনপি নেত্রী একে 'ফঞ্চ' বলেছিলেন। বিএনপি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান হাটহাজারিতে গিয়ে হেফাজত গঠনে প্রণোদনা দেন। হেফাজত গণজাগরণ মঞ্চকে "নাস্তিক" বলে তকমা দেয়। জামাত এই গণজাগরণ মঞ্চকে গান্ধা করে দেয়ার প্রকল্পের পেছনে সক্রিয় ছিলো বলাই বাহুল্য। সেসময় আমার দেশ পত্রিকাকে গণজাগরণের তারুণ্যকে "ধর্মের শত্রু" প্রমাণের চেষ্টায় এমবেডেড জার্নালিজম বা বিছানাগত সাংবাদিকতা করতে দেখা গেছে। লক্ষ্য করুন, সেই একই প্যাটার্ন; কোন আন্দোলন নিজেদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই তাকে গান্ধা করে দেয়া।
দুটি আন্দোলনে দুটি বিপরীতধর্মী রাজনীতির বলয় তরুণদের আন্দোলন দমনে যখন একই রকমের নিপীড়নমূলক পদ্ধতি গ্রহণ করে; তখন প্রশ্ন ওঠে এই পেডোফিলিক (শিশু নিপীড়ক) রাজনীতিকদের নিয়ে আমরা কী করবো! বুড়ো ভামেরা যখন তরুণদের চরিত্রহননের চেষ্টা করে; তখন এই বিকৃতিকে কী করে সামাল দেবে সমসাময়িক সমাজ।
গণজাগরণ আন্দোলনকে দমাতে "ধর্মের ব্যবহার" এবং কোটা সংস্কার আন্দোলন দমাতে "মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যবহার" একই আঙ্গিকে করা হয়েছে। নিজেদের স্বার্থে ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপব্যবহার খুবই আশংকাজনক।
ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। ব্যক্তি মানুষের সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সম্পর্কের মাঝে ইসলামভিত্তিক রাজনীতিকদের ঠিকাদারি অনধিকার চর্চা। স্বদেশ মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। ব্যক্তি মানুষের সঙ্গে স্বদেশের সম্পর্কের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক রাজনীতিকদের ঠিকাদারি অনধিকার চর্চা।
যারা এই ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুঁজি করে ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাচ্ছেন; তাদের বয়সও অনেক হলো; কিন্তু আধুনিক ও যৌক্তিক চিন্তা করতে না শিখেই তারা ধীরে ধীরেজীবনের নিয়মে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন; এটা ভাবতেও খারাপ লাগে।
গ্রিক চিন্তক হেরাক্লাইটাস বলেছিলেন, মানুষ একই স্রোতে দুবার সাতার দিতে পারে না। তাই যারা ধর্মের স্রোতে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্রোতে রাজনীতির সাতার কেটেছেন; তাদের অনুধাবন করতে হবে; ধর্ম-মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যক্তিমানুষের একান্ত চর্চার পবিত্র বিষয় হয়ে টিকে থাকবে। কিন্তু রাজনীতির গান্ধা কইরা দেওয়ার কাদাখেলায় ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মত পবিত্র বিষয়কে কাদা মাখানোর অনুমোদন সমসাময়িক ও আগামীর মানুষেরা আর দেবে না।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য