প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আশিক শাওন | ০৩ জুন, ২০১৮
সাধারণভাবে এদেশে যেকোন ঘটনায় 'ভিকটিম ব্লেমিং' করাটা একটি প্রচলিত রেওয়াজে পরিণত হয়েছে এবং দিনে দিনে তা প্রকট হয়ে উঠছে। বিশেষত কোন নারী নিগৃহীত হলে তার পোশাক এবং চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে ঘটনাটিকে লঘু করে তোলা একশ্রেণির লোকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে মিশে গিয়েছে যে, তাদের কথা শুনলে আপনি নিজেই আইন-আদালত-সভ্যতা সম্পর্কিত আধুনিক ধ্যান ধারণার যুগে কতটা পশ্চাৎপদ ব্যক্তির সাথে আলোচনায় লিপ্ত হয়েছেন তা ভেবে মরমে মরে যাবেন।
প্রতিটি ব্যক্তিই যে তার নিজের ইচ্ছা-রুচি-সামর্থ্য অনুযায়ী যেকোন কাজ-সাজ-পোশাক-পেশা গ্রহণ করতে পারে তা এদের ধারনারও অতীত এবং এদের সাথে আলোচনায় গেলে আপনি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করবেন যে, এসব কিছু করায় তাদেরকে অত্যাচার এমনকি হত্যা কারটাও সঠিকই হয়েছে। এই আলোচনায় অবধারিতভাবেই একদল লোক প্রমাণ করে দেবে যে, যা কিছুই ঘটেছে তার দায় নিপীড়িতের; নিপীড়ক কেবল বাধ্য হয়ে কাজটি করেছে এবং সে যথেষ্ট মানবিকতার সাথেই এটি করেছে। আইন-আদালত বা মানবাধিকার বলে যে একটি বিষয় আছে এবং সেটি যে যেকারো জন্যই প্রযোজ্য তা তারা মানতে রাজি নন; বরং নির্যাতিত আরও কী কী শাস্তি পাওয়া উচিত তার তালিকা করে তারা আপনাকেও সেই অন্যায়ে সঙ্গী হতে প্ররোচিত করতে থাকবে।
২.
দেশ-জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ ভেদে এই দোষারোপের সবচেয়ে বড় উদাহরণগুলো আমরা দেখেছি ২০১৩ সালে শাহবাগকেন্দ্রিক গণজাগরণের পর কতিপয় ব্যক্তিকে “নাস্তিক” আখ্যা দিয়ে হত্যা করার সময়। সেসময় প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর নিহত ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন, ধর্মীয় অবস্থান ও লেখালেখিকে সামনে এনে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, এই মৃত্যু দায় কেবল নিহতেরই– তার উচিত হয়নি এধরণের বিষয় নিয়ে লেখালেখি করা বা আলোচনা করা। এমনকি দেশের শাসক দলের কর্তাব্যক্তিগণ ও তাদের সাথে সাথে জাতির বিবেক বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবীগণের এক বিশাল অংশ সুর মিলিয়ে ছিলেন এই হত্যার বৈধতার পক্ষেই।
অভিজিৎ রায়ের মতো লেখক বা দীপনের মতো প্রকাশকও তাদের ব্যক্তিগত জীবনাচারের জন্য “নিহত হয়েছেন এবং এটি সঠিক ছিলো” এই মন্তব্যই কেবল নয়– এর স্বপক্ষে যুক্তি নিয়েও হাজির হয়েছেন শিক্ষিত সমাজেরই একটি অংশ। কারো জীবনাচার দিয়ে যদি অন্যের ব্যক্তিজীবনকে বাধাগ্রস্ত নাকরা হয় এবং তাতে যদি কোনো সামাজিক সমস্যার উদ্ভব না ঘটে তাহলে যে সে বিষয়ে কারো কিছু বলার থাকে না – এই বোধটিই যে সমাজের নেই সেই সমাজে শিক্ষা বা মনুষ্যত্ব নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু আছে বলেই তো বোধ হয় না।
৩.
এইতো সেদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছ থেকে ফল পাড়া ও সেই ফল পাড়ার কারণ নিয়ে তর্ক করায় পুলিশের হাতে তুলে দেন তারই প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্তা ব্যক্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষায় জড়িত শিক্ষাগুরুগণ! একজন শিক্ষার্থী ক্ষুধার তাড়নায় নিজের প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরস্থ গাছ থেকে কয়েকটি ফল পেড়ে খেলে পুরো প্রতিষ্ঠানের কতটুকু আর্থিক ক্ষতি হতে পারে তা নিয়ে কখনো আলোচনা হওয়ার মতো কিছু সেদিন দেখিনি; বরং এসব প্রতিষ্ঠানের গাছগুলো লিজ দিয়ে প্রতিষ্ঠান যে আয় করছে তার কতটুকু শিক্ষার্থীরা পায় সেটিও চেপে রাখা হয়েছে। তবে, "পোষাকই ধর্ষণের কারণ" তত্ত্বে বিশ্বাসীরা এই ঘটনায় নিগৃহ শিক্ষার্থীকেই দোষারোপ করতে থাকলো "কিভাবে সে আম খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে – কাজেই না খেয়ে আছে এটি একটি গালগপ্প"/ "আম পাড়ার মতো এমন একটি অপরাধ করেও কেন তর্কে জড়ালো" বলে; অথচ একজন শিক্ষার্থীকে রক্ষা না করে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া, তাও আম পাড়ার মতো অপরাধের জন্য- সেটিও তাদের নিকট খুব স্বাভাবিক মনে হলো!
এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কত শত শিক্ষার্থী একবেলা খেয়ে টিকে আছে তা নিয়ে এদের সাথে তর্ক করারও রুচি উঠে যাবে আপনার এদের এমন সব মন্তব্য শোনার বা দেখার পর।
৪.
একজন মানুষ চোর-ডাকাত-খুনি-ধর্ষক যাই হোক না-কেন তার বিচার পাওয়ার অধিকার আছে অবশ্যই এবং তা প্রচলিত আইনেই। দেশের আইন-আদালত বা বিচার ব্যবস্থা চালুই রাখা হয়েছে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। তারচেয়েও বড় কথা, একজন অপরাধীকে, সে যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, আপনি তার সবচেয়ে আপনজনদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে শাস্তি দিতে পারেন না; হত্যা তো নয়ই। পৃথিবীর কোথাও এধরণের কোনো আইন নেই যে, আপনজনদের সামনে শাস্তি প্রয়োগ করা হবে– কেবল কিছু বর্বর প্রথায়ই এটি চালু আছে। অথচ, একদল অন্ধ অনুসরণকারী পাবেন যারা এমন ব্যক্তিকেও এভাবে হত্যার বিষয়েও সমর্থন করে যাচ্ছেন। যেকোন অন্যায় অপরাধকে যখন আরেকটি অন্যায় দিয়ে মোকাবেলা করা হয় তখন সেটটি আর সভ্য সমাজের অংশ থাকে না - হয়ে ওঠে বর্বরদের আখড়া। তুলনামূলক তত্ত্ব দিয়ে আপনা কেবল সাময়িক একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবেন; কিন্তু বৃহত্তর পরিসরে এটি সমাজকেই ধসিয়ে দেবে অন্যায়ের চর্চার কারণে।
বলতে দ্বিধা নেই, বর্তমানে আমাদের এই দেশে আমরা আজ বর্বরদের এই প্রথারই অনুসরণ করছি; বেঁচে আছি এটি নিয়েই- বেঁচে যে আছি সেটিও অবশ্য এক বড় আশ্চর্যজনক বিষয়, মৃত্যুটাই এখানে সত্য হয়ে উঠেছে বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে।
৫.
এই যে যেকোনো ঘটনায় নিগৃহীতকে দায়ী করা এই বিষয়টা কেবল ব্যক্তি বিশেষের সমস্যা হলে তা কাটিয়ে উঠা সম্ভবপর হতো, কিন্তু যখন দেখবেন তা শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকল বয়স-ধর্ম-পেশার লোকের মধ্যে বিস্তৃত তখন এ জাতির বিচার-বিবেচনা নিয়ে আপনি শঙ্কিত না হয়ে পারবেন না। যেকোন ঘটনা-দুর্ঘটনায় এমনটি ঘটাই এখন এদেশের একটি সহজাত চিত্র হয়ে উঠেছে যে, নিহতের ব্যক্তিজীবন ঘেঁটে প্রমাণ করা হয় যা ঘটেছে তা সঠিকই হয়েছে– ঘাতকদের কোনো দায় নেই, বরং তারা বাধ্য হয়েছে। বিচারহীনতা আর বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা জাতিকে তাই করে তুলছে ধীরে ধীরে অসহিষ্ণু আর নীতিহীন। আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার কারণে তারা নিজের চারপাশকেই কেবল নিরাপদ দেখতে আগ্রহী, বৃহৎ পরিসরে স্বদেশ বা স্বজাতির জন্য সমতা নিয়ে তাই তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।
এ সমাজকে এখন তাই অসভ্যদের সমাজ বলতে পারেন- আপনি-আমি সবাই যার অংশ এবং অংশীদার। এখানে অতি সাধারণ মানুষ হিসাবে আমাদের অবস্থান অপেক্ষা কেবল মরা বা মারার- প্রথমটি সহজ ও অবশ্যম্ভাবী; আর, দ্বিতীয়টির জন্য প্রস্তুতই নয় আমাদের কেউ! অথচ এই অবস্থা থেকে উত্তরণ আবশ্যক! কিন্তু এক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং এর পরিচালকদের দিকেই যখন অঙুলির নির্দেশ উঠে তখন আপনার আমার করনীয় কি তা কি কেউ আমরা বলতে পারি; কিংবা, আমাদের বা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কি হতে যাচ্ছে তা কি কেউ স্বাভাবিক বোধ দিয়ে ভাবতে পারছি?
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য