আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

আশির দশকের ঈদ স্মৃতি...

আব্দুল করিম কিম  

আমার ছোটবেলার ঈদ মানে সত্তর দশকের শেষ ও পুরো আশি দশকের সময়কালের ঈদ । 'রোজার ঈদ' ও 'বকরা ঈদ' । এই দুই ঈদের মধ্যে বেশি আনন্দের ছিল 'রোজার ঈদ' । শুধু নতুন জামা কেনার জন্য নয়; ছোটবেলার চেনা গন্ডিতে থাকা সমস্ত মানুষকে হাসিমুখে দেখতে পাওয়ার অন্যরকম এ দিনকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দিন ভাবতাম। এখনো রোজা ঈদ আমাদের চলমান জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন। তবুও ফেলে আসা শৈশবের ঈদ স্মৃতি হৃদয়ে ভাবাবেগ জাগায়।

অগ্রজদের কাছে আমার ছোটবেলার ঈদ স্মৃতি গল্প করার মত কিছু নয় কিন্তু অনুজদের জন্য সে সব গল্প লিখে ফেলাটা জরুরী। নিজের স্মৃতিতে সবকিছু স্পষ্ট থাকতেই লিখে ফেলা উচিত । পেছনে ফিরে তাকালে ছোটবেলার অনেক গল্প মনে পড়ে। নানা মানুষের মুখ চোখে ভাসে। মনে হয় এইতো সেদিনের কথা। বেশি দিন নয়- মাত্র তিন দশক পূর্বে কৈশোরকে বিদায় জানিয়েছি। স্কুলের আঙ্গিনাকে বিদায় জানানোর হয়ে গেছে প্রায় সাতাশ বছর। পেছনে ফিরে তাকালে অন্য অনেক কিছুর মত 'ঈদ উদযাপন'-এর চরিত্রগত পার্থক্যটুকুও অনুধাবন করি। স্বাভাবিক ভাবেই ছোটবেলার ঈদের কথা মনে হলে মন বিষণ্ণ হয়। মানুষের শৈশব স্মৃতি সর্বদাই সুখকর। চলে যাওয়া দিনকেই সবাই ভালো দিন মনে করে। এরমধ্যে শৈশব থেকে কৈশোরের মধ্যবর্তী সময়টুকুর কোন তুলনা চলে না। এ সময়টুকুই জীবনকে সবচেয়ে বেশি নির্মল আনন্দদান করে। নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা উপভোগের সুযোগ করে দেয়। এই সময়ে লেখাপড়ার কোন চাপ থাকে না। পৃথিবীর নানা জটিলতার কোন কিছু নিয়েই দূর্ভাবনা করতে হয় না। উপলক্ষ্য খুঁজে নিলে সব কিছুতেই আনন্দের উপাদান পাওয়া যায়। আর এসব আনন্দের মধ্যে সবচেয়ে বড় আনন্দের উপলক্ষ নিয়ে আসতো রমজান ও ঈদ উল ফিতর। আমাদের ছোটবেলা রমজান ও ঈদ উল ফিতর উপলক্ষে স্কুল কলেজে প্রায় দেড় মাসের ছুটি দেয়া হত। সেই ছুটি নিয়ে থাকতো নানা পরিকল্পনা । কিন্তু রোজা শুরু হতেই খাওয়া, ঘুম ও পড়াশোনার রুটিন যেত আমূল বদলে।

মাঝরাতে ঘুম থেকে ওঠে সেহরী খাওয়া। রোজা রাখার দোহাই দিয়ে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা। রোজা না রাখলে সারাদিন এটা ওটা খেয়ে যাওয়া। পড়াশোনা বিভিন্ন উসিলায় শিকেতে ঝুলে যেত। দিনের বেলা ক্যারেম বোর্ড বা দাবা খেলে রোজার ক্লান্তি কাটাতো। তবে রোজা মাসের দুপুরে হুজুরের কাছে কোরআন শরীফ পড়ার তালিম নেয়া লাগতো। আমরা ছোট তিন ভাই বোনের জন্য আব্বা রমজানে একজন মেছাব (মাওলানা) ঠিক করে রাখতেন।

রমজানে সবচেয়ে উপভোগের ছিল ভাজাপোড়া ইফতারী। সবকিছুই ঘরে বানানো হত। মাঝেমধ্যে জিলাপিটা কিনে খাওয়া হত। ইফাতারের পরে অতিরিক্ত খেয়ে একটা ক্লান্তি আসলেও এশার আজান পড়তেই তারাবীর নামাজ পড়ার অজুহাতে বাসার বাইরে যাওয়ার সুযোগ মিলে যেত। সেই সুযোগেই রাতের আড্ডায় হাতেখড়ি। বালকবেলায় মসজিদের পেছনে বসে আড্ডা চলতো । কৈশোর হতেই আমরা আহলে হাদিস হয়ে যেতাম। আট রাকাত নামাজ পড়েই পাড়াময় ঘুরে বেড়াতাম। আবার বিতরের নামাজকালে মসজিদে ফিরে আসতাম । পাড়াঘোরার কালে কেউ কেউ নিজের বা প্রতিবেশী বাসার ডাব চুরি করে খেয়ে ফেলতো। আমার অবশ্য এই আকামে সম্পৃক্ততা ছিল না ।

রোজার ছুটি খুব দ্রুত ফুঁড়িয়ে আসতো। তবুও মন খারাপ হতো না । অপেক্ষা করতাম কবে রোজা শেষ হয়ে ঈদ আসবে। শবে কদর বা 'সাতাইশা' শেষ হলেই ঈদের আগমনী শুনতে পেতাম আকাশে-বাতাসে। ছাব্বিশ রোজার দিন বিভিন্ন বাসা থেকে মেহদি পাতা সংগ্রহ করার দায়িত্ব ছোটদের উপর চাপানো হত। নির্ধারিত কিছু বাসায় গিয়ে মেহদি পাতা নিয়ে আসতাম। সাতাইশের রাতে বোনেরা মেহদি লাগাতো হাতে। আমার ও নাসিমের ভাগ্যে বোনদের উচ্ছিষ্ট মেহদি বাটা জুটতো। ছেলেদের শুধু নোখে লাগানোর নিয়ম ছিল । আমরা নোখে সে মেহদি বেশি সময় রাখতে পারতাম না। একটু পর পর নখরা করে খুলে দেখতাম কতটা রঙ লেগেছে।

ঈদের চাঁদ দেখার জন্য বিকেল থেকে অসংখ্যবার ছাঁদে উঠতাম। অহেতুক চাঁদ দেখেছি বলে বোনদের বিভ্রান্ত করতাম । আমার বড় চার বোন ও এক ভাই । বড় বোন আসমা যাকে আপামনি, মেজ বোন হাফসা- যাকে মে'জনি, সেজ বোন
শাহানা যাকে দিদিমনি ও আমার ইমিডেট বড় বোন শাহিনা- যাকে ছোটমনি বলে আমরা ডাকি (ছোট তিন ভাইবোন আমি, রুবিনা ও নাসিম) । রুবিনাকে নাসিম রাঙ্গামনি বলে ডাকে । আমাকে রুবিনা ও নাসিম ভাইয়া বলে ডাকে। আর বড় ভাই আবু আট ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। তাঁকে আপামনি ব্যাতিত অন্যরা ভাই বলে ডাকে। আমার শৈশবের ঈদ আনন্দময় হওয়ার পেছনে আমার বোনদের অবদান সবচেয়ে বেশী। এখন বুড়ো হয়ে গেছি । মেজ'নি অকালে জান্নাতবাসী হলেও বাকি তিন বোন আমি, রুবিনা ও নাসিমের ঈদকে আনন্দময় করার জন্য বোনদের এখনো সর্বাত্মক চেষ্টা ও নজরদারী থাকে।

ছোটবেলার ঈদ স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে ঈদের চাঁদ দৃশ্যমান হওয়ার পরেই রেডিওতে 'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ' নজরুল গীতিটি ফুল ভলিউমে বেজে ওঠার অনবদ্য অনুভূতি । ফেরদৌসি রহমানের গলায় 'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ' গানের সুরে আনন্দ দশদিগন্তে উছলে পড়তো। রেডিওতে এই গান বাজানোর গুরু দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন ছোটমনি । ছোটমণি চাঁদ দেখার সংবাদ শোনার জন্য ইফতারের পর থেকেই রেডিওতে কান লাগিয়ে বসে থাকতো। চাঁদ দেখা নিশ্চিত হলে দরগা-ঈ হযরত শাজালাল (রহঃ) ও লাক্কাতড়া চা বাগান থেকে ভেসে আসতো সাইরেনের শব্দ। দরগায় দীর্ঘক্ষন বাজানো হতো নাকাড়া। চাঁদ রাত শুরু হতেই বোনদের ব্যাস্ততা তুমুল হয়ে যেত। যদিও ঈদকে ঘিরে ঘর পরিচ্ছন্নকরণ অভিযান আরও আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত। আপা সেলাইয়ের কাজ করলেও ঘর গোছানো ও নাস্তা বানানোর কাজ মেজমণি ও দিদিমনি করতো।

দিদিমণি ঘরের কোনে কোনে থাকা মাকড়ের সামান্যতম ঝুল থাকলে তা সাফ করে নিতেন। ভাইকে অনুনয় বিনুনয় করে ঘরের সব সিলিং ফ্যানের পাখা খুলিয়ে নামানো হলে তা পরিষ্কার করতেন। ঘরের সমস্ত জানালার গ্রীল ধুয়ে মুছে সাফ ছুতরা করা অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে সম্পন্ন করতেন বোনেরা । আমিও এই কাজে সাহায্য করতাম। আম্মা দরজা-জানালার সমস্ত পর্দা রোজা রেখেই ধুয়ে শুকিয়ে রাখতেন। ঘরের সমস্ত বিছানার চাদর, বালিশ, মশারীও আম্মা না ধুয়ে থাকতে পারতেন না। ছোটমনি সাফাই হওয়া কাপড় বিরক্তি নিয়ে ইস্ত্রি করতো। মেজমনি বাথরুমগুলো ফিনাইল দিয়ে ঝকঝকে করে ফেলতেন। ঈদের দিন ড্রইংরুমের ফুলদানীতে ফুল ও পাতাবাহারের নতুন তোড়া বসানো হত। পুরনো বাল্বের মুখ খুলে পানি ভরে মানিপ্ল্যান্ট লাগাতেও দেখেছি । যা দেয়ালে শোভাবর্ধন করতো।

রোজার ঈদের অন্যতম অনুষঙ্গ নতুন জামা কাপড়। ঈদের জামা-কাপড় আপামনির বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত ঘরেই তৈরি করা হত। গজ কাপড় কিনে এনে নিজস্ব ডিজাইনে আপামনি আমাদের জামা সেলাই করতেন। সেই জামা সেলাই কালে কয়েকবার মাপ দিতাম, গায়ে দিয়ে ট্রায়াল দিতাম । এই ট্রায়াল দেয়াটাও অনেক আনন্দের ছিল । রোজার দিনগুলোতে সেলাই মিশিনের একটানা ঘুটঘুট শব্দ শুনে ঘুম চলে আসতো । আপা একটানা আট ভাইবোনের জন্য জামা সেলাই করে যেতেন । মাঝে মাঝে সেলাই মিশিনের সূঁচে আপা সুতা ভরে দিতে বললে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে গর্ববোধ করতাম।
আব্বা ছিলেন প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার বা কন্ট্রাক্টর । উনার ছিল 'মেসার্স আরকো' নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান । সে প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগে কাজ করতো । প্রায় ঈদেই আব্বা সরকারী এসব প্রতিষ্ঠানের বিল পেতে অনেক ঝামেলা পোহাতেন । রানিং বিল পেতে ইঞ্জিনিয়ারদের পেছনে ধর্না দেয়া, একাউন্ট সেকশনে রোজা রেখে প্যারেড দেয়ার বিষয় বুঝতাম না । প্রায় ঈদেই শেষ মুহুর্তে বিল পাশ হত । ব্যাংক থেকে টাকা হাতে আসতো ঈদের শেষ কর্ম দিবসে । প্রতিবেশী ও বন্ধুদের অনেকের কেনাকাটা ততদিনে প্রায় শেষ । অবশ্য আব্বা যে কয়েকবার ঈদের অনেক আগে বিল পেয়েছেন; সে কয়েকবার ঈদ বাজার খুব ভালো হয়েছে । আব্বার বিল পাওয়া না পাওয়া নিয়ে ঈদের সপ্তাহখানেক আগে থেকে ভাইবোনদের দুশ্চিন্তায় পড়তে হতো । যদি বিল না পাওয়া যায় তবে কি হবে- এই উৎকণ্ঠায় রাতে ঘুম আসতো না । ৮১ বা ৮২ সালের ঘটনা আমার চাহিদা মতো ঈদের জুতো কেনা হয়নি, মন খারাপ । হটাৎ রেডিওতে একটা গান শুনে নিজেকে সান্তনা দেয়ার সুযোগ পেলাম । "নাই হল মা, বসন ভূষণ এই ঈদে আমার / আল্লাহ আমার মাথার মুকুট, রাসুল গলার হার / নামাজ রোজা ওড়না শাড়ি, এতে আমায় মানায় ভারি / কলমা আমার কপালের টিপ / নাই তুলনা যার /" নজরুলের এই গানের ব্যাখ্যা দিদিমনির কাছ থেকে শুনে শিল্পী নওশিন লায়লার জন্য মনটা খারাপ হয়ে যায় । আমারতো ঈদে শার্ট-প্যান্ট হয়েছে শুধু জুতা হয়নি, কিন্তু মেয়েটারতো কিছুই হয়নি । সেই গান আমাকে সবর বা অল্পে তুষ্ট থাকার শিক্ষা দিয়েছিল ।

আমার বেহিসেবি বাবা বিল না পেলেও একই পেশার হিসেবি ছোটচাচা তাঁর বিল ঠিকই পেয়ে যেতেন নতুবা তার জমানো তহবিল থেকে ঈদের আগে বড় বোনদের হাতে কিছু ঈদ শুভেচ্ছা দিয়ে যেতেন । ওটা ছিলো ঈদ বাজেটের বাড়তি সাপোর্ট । বোনরা সেই সাপোর্টের সাথে আম্মার স্টকের টাকা মিলিয়ে কেনাকাটা শুরু করে দিতেন। বিশেষ করে ছোটদের কেনাকাটা নিশ্চিত করতেন । পরবর্তীতে আব্বার টাকা হাতে আসলে নিজেদের পোষাক ও ছোটদের জুতা কেনা হত । প্রায় ঈদেই নতুন জুতা পরে ঘোরাঘুরি করতে যেয়ে পায়ে ফুস্কা উঠতো । আমরা বলতাম 'ঠুসা' ওঠা । সেই 'ঠুসা'র ব্যাথা নিয়েও নতুন জুতা পড়া বন্ধ হতো না ।

১৯৮০ সালে আপার বিয়ে হয়ে গেলে সেলাই করে জামা পরার পর্ব শেষ হয়ে যায় । মেজমনি বা দিদিমনির সেলাই করার অভ্যাস ছিল না । এদের আমলে শুরু হয় মার্কেট থেকে রেডিমেট কাপড় কেনা । সে সময় নতুন জামা-কাপড় কেনা নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ ছিল । এদের সাথে জিন্দাবাজারের সবুজ বিপনী, লন্ডন ম্যানশন, ইদ্রিস মার্কেট, জালালাবাদ মার্কেটে ঘুরে বেড়াতাম । আমার ও নাসিমের কাপড় প্রথমেই কিনে ফেলা হতো । দোকানে দোকানে সারাদিন ঘুরে ঘুরে হাফ প্যান্ট, গেঞ্জি বা শার্ট পছন্দ করা হত । আগেই শর্ত দেয়া থাকতো- কোন ড্রেস পছন্দ হলেও দোকানদারের সামনে সেটা যেন প্রকাশ না করি । ফিক্সড প্রাইসের দোকান সম্ভবত একটাও ছিলো না । বোনদের বার্গেনিং প্রতিভায় মুগ্ধ হতাম । দোকানদার গেঞ্জি ২৫০ টাকা বললে, দিদিমণি বলতো ১০০ টাকা । ছোটদের পান্জাবী তখন অনেক কম,আর অতোটা কারুকার্যময় ছিলোনা আর যেগুলি ছিলো হয়তো দাম বেশী, আবার কেবল মাত্র জামাতেই পান্জাবীর প্রচলন (ছোটদের জন্য) এরপরেই বর্ণীল জামা কাপড় তাই শার্ট-প্যান্ট কেনা হলেও সব ঈদে নতুন পাঞ্জাবী কেনা হতো না । আমার সাশ্রয়ী মা পুরোনো পান্জাবীকেই ধুয়ে/ইস্ত্রী দিয়ে রাখতেন । সেটা গায়ে দিয়েই ঈদের নামাজ সেরে ফেলতাম ।এখনকার বাবুদের মতো দুই তিন সেট পোষাকের বায়না ছিলো না । অল্পতেই আমরা অনেক খুশী থেকেছি । অবশ্য কৈশোর থেকে অল্প অল্প করে চাহিদা বেড়েছে । সে সময় আমাদের ছয় ভাই-বোনের সর্বচ্চ ঈদ বরাদ্ধ ছিল ৫০০০ টাকা । ভাই ৮১ সাল থেকেই আব্বার সাথে কন্ট্রাক্টরি কাজে যুক্ত হয়ে যাওয়ায় নিজের কেনাকাটা নিজেই করে নিতেন । আব্বা-আম্মা দুজনেই নিজের জন্য নতুন কাপড় কেনা পছন্দ করতেন না । অনেক সময় আব্বার জন্য বোনেরা পাঞ্জাবী কিনে আনলেও আব্বা তা দরিদ্র কোন আত্বিয়কে দিয়ে দিতেন । আর আম্মার জন্য প্রায় ঈদেই শাড়ী উপহার আসতো।নিজাম মামা (আম্মার ধর্মভাই) অনেক ঈদে আম্মাকে শাড়ী দিয়েছেন । শ্রীমঙ্গলের মামী অথবা হবিগঞ্জের খালাও শাড়ী পাঠাতেন আম্মাকে ।

ঈদের নামাজ আব্বার সাথে দরগা-ই-হয্রত শাহজালাল (রহ)-এর ঈদগাঁতে পড়তে যেতাম । ঈদের নামাজ শেষ হওয়ার পর খুতবা শোনার জন্য বসে থাকাটা খুব বিরক্তিকর মনে হতো । ভাই ও নাসিম নামাজ পড়ে বাসায় ফিরে গেলেও আমি আব্বার সাথে আটকে যেতাম । নামাজ শেষে আব্বা আমাকে নিয়ে দরগা জেয়ারত; এরপর দাদা-দাদীর কবর জেয়ারত সম্পন্ন করতেন । এরপর দরগার মোতাওয়াল্লী বাড়িতে নিয়ে যেতেন দাদীকে (মরহুম মোতাওয়াল্লী সরেকম এ জেড আব্দুল্লাহ সাহেবের স্ত্রী) সালাম করাতে । এরপর দাদীর ছেলে তৎকালীন মোতাওয়াল্লী সরেকম ইউসুফ আমানুল্লাহ (পুতুল চাচা)'র সাথে আব্বা টঙ্গি ঘরে গল্পে মশগুল হয়ে যেতেন । সেখানে ধীরে ধীরে যোগ দিতেন আলী মাহমুদ খান ( সামুন ভাই/জুন্নুন ভাইয়ের আব্বা), কুয়ারপাড়ের ওয়াকিল চাচা (মুন্না ভাইয়ের আব্বা), দাড়িয়াপাড়ার কমরু চাচা (কুমকুম ভাইয়ের আব্বা ), লামাবাজারের বুলবুল মামা, মাওলানা ছাদেকউল্লাহ, খোঁজারখোলার খলিল চাচা (শহিদুল ভাইয়ের আব্বা), সুবহানীঘাটের ইকবাল চাচা (আরিফ ইকবাল-এর আব্বা), শামসুল আলম চাচা (নাদেল ভাইয়ের আব্বা) প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যাক্তিরা ।

এদের মধ্যে খলিল চাচা ঈদের সালামী দশ টাকার নোট পকেটে গুঁজে দিতেন । আলি মাহমুদ চাচা ও কমরু চাচা সারবেয়ার সাহেবের নাতি বলে আমার গালে হুঙ্গা (চুমা) দিতেন। ওয়াকিল চাচা সুগন্ধি আতর লাগিয়ে দিতেন।

আমি কিছু সময় তাঁদের গল্প শুনলেও একটা সময় উসখুস শুরু করে দিতাম। পুতুল চাচা সেটা খেয়াল করে আব্বাকে বিদায় দিতেন । বাসায় ফিরে দেখতাম অনেক মেহমানের জমায়েত । এরপর পাশেই ছোটচাচার বাসায় যেতাম । চাচাতো ভাই মাসুম আমার বাল্যসঙ্গী । অবশ্য '৮২ সাল পর্যন্ত ঈদের ঘোরাঘুরি বোনদের সাথেই করতে হয়েছে। আশপাশের বাসা থেকে শুরু করে সারা দিনে অন্তত ২০/৩০ টি বাসায় যাওয়া লাগতো।

আমাদের পরিবারে বা পরিচিত কারো বাসাতেই মুরুব্বীদের সালাম করে কোন ঈদি পাওয়ার রেওয়াজ ছিল না। আব্বা বাচ্চাদের টাকা দেয়া একদম পছন্দ করতেন না। পাড়া-প্রতিবেশী প্রায় সব মুরুব্বীকেই পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতাম। বয়স যত বাড়তে থাকে ঈদে বাসা-বাড়িতে যাওয়া কমতে থাকে ।

ঈদের নাস্তায় তেমন একটা ভেরিয়েশন ছিল না। নারকেলের পিঠা ও সেমাই বেশীরভাগ বাসার নাস্তা। চটপটি তৈরির ফ্যাশন সবেমাত্র শুরু হয়েছে । চটপটি দিদিমণি খুব ভালো বানায়। ওর চটপটি আমাদের বাসায় আসা মেহমানদের সবচেয়ে পছন্দের আইটেম । বেড়াতে গিয়ে কেরোসিনের গন্ধযুক্ত লাচ্চা সেমাই কারো বাসায় দেয়া হলেই বিপদে পড়তাম। পুডিং বা কাবাব পেলে ঐ বাসায় যাওয়াটা সার্থক হয়েছে ধরে নিতাম । দিদিমণিরা খাওয়ার চেয়ে বকবক করাকে প্রাধান্য দিত । কতোটা বাসায় গিয়ে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করলো সেটাই তাঁদের প্রধান বিবেচ্য । এরমধ্যে বোনেরা একসাথে বেড়াতে যেতে পারতো না। বাই রোটেশন যেতে হত । কারন আমাদের বাসায় আসা মেহমানকে খাতিরদারী করার জন্য কাউকে স্ট্যান্ডবাই থাকতে হতো। এই ক্ষেত্রে মেজমনিকে বলির পাঁঠা বানানো হত।

১৯৮৫ সালে মেজ'নির বিয়ে হয়ে যায়। আমি অবশ্য '৮৩ সালের রমজানের ছুটিতে গৃহত্যাগ করি। বাসার বাইরে প্রথম রোজার ঈদ উদযাপন করি নীলফামারীতে । আমার বয়স তখন দশ । ভাইবোন, আত্মীয় স্বজনের হট্রগোল থেকে একেবারেই অন্য পরিবেশে ঈদ আসে আমার জীবনে । একই বছরের কোরবানীর ঈদ উদযাপন করি চট্রগ্রামে । ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিন বছরে আমি একটি রোজার ঈদ ও আরও একটি কোরবানীর ঈদ উদযাপন করি চট্রগ্রামে, একটি রোজার ঈদ ও একটি কোরবানীর ঈদ উদযাপন করি বরিশালে। বাসার বাইরের সে সব ঈদের আলাদা গল্প আছে । এখানে আর সে সব গল্প করছি না।

আমাদের ছোটবেলার ঈদ আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল টেলিভিশন। আমার শৈশবের স্মৃতিতে ঈদের নাটক ও ঈদের পরের দিনের পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি দেখাটা ঈদের রাতের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ঘটনা। ঈদের প্রোগ্রাম দেখার সে আনন্দ এখনকার ছেলে মেয়েরা কোন ভাবেই অনুধাবন করতে পারবে না। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ছোটচাচার বাসাই ছিল রোমাঞ্চকর ঘটনা প্রত্যক্ষ করার জন্য আমাদের একমাত্র অবলম্বন । '৮১ সালের পর প্রতিবেশী একাধিক বাসায় টিভি কেনা হয় । ভাগাভাগি করে বিভিন্ন বাসায় ঈদের নাটক, ঈদ আনন্দমেলা ও ঈদের বাংলা সিনেমা দেখে আত্বাকে শান্তি দেয়া শুরু হয় । এতো ত্যাগ স্বীকার করে বিভিন্ন বাসায় টিভি দেখতে যাওয়ার কারন ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত আমাদের বাসায় কোন টিভি ছিলো না।

আমার সংস্কৃতি মনা বাবা বড় বোনদের কে মাষ্টার রেখে গান শেখালেও বাসায় টেলিভিশন কেনার বিরোধী ছিলেন । শিক্ষার্থীদের ঘরে টিভি রাখার ব্যাপারে তাঁর আপত্তি ছিল । তবে যুগের চাহিদায় ১৯৮৫ সালে লক্ষীপাশা ভবনের বসার ঘরে জায়গা করে নেয় ১৭ ইঞ্ছির একটি সাদাকালো টিভি । অবশ্য সে সময় আমি চট্রগ্রামে।

ঈদের দিনের সমস্ত ঘোরাঘুরি শেষ করে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে টিভির সামনে বসে পড়তাম । টিভিতে যাই দেখাতো, তাই হা করে গিলতাম। রাত নটায় একের পর এক ক্লান্তিহীন বিজ্ঞাপন শেষে শুরু হত ঈদের নাটক। শুরু হলেও নাটকের শেষ অংশ দেখতে হতো রাত দশটার ইংরেজী সংবাদের পর। এই ফাঁকে রাতের খাওয়া সবাইকে দ্রুত শেষ করে নাটকের শেষ অংশ দেখা হত। এরপর অনেক বিজ্ঞাপন শেষে শুরু হতো 'ঈদ আনন্দ মেলা' । ঈদ আনন্দমেলা শেষ হওয়ার আগে রাত সাড়ে এগারোটার বাংলা ও ইংরেজী সংবাদ চলে আসতো । এসময়েই চোখে নেমে আসতো রাজ্যের ঘুম ।
ঈদের পরের দিন পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি রাত নয়টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সাড়ে নয়টায় শুরু হত । আর সেই সিনেমা শেষ হতে হতে রাত ২টা বাজতো । নায়ক নায়িকার মিল না হওয়া পর্যন্ত সেদিন অবশ্য জেগে থাকতাম।

ছোটবেলার ঈদের আরেকটি অনুষঙ্গ ছিল ঈদকার্ড আদান-প্রদান । শৈশবে রোজার শুরু থেকেই বোনদের ঈদ কার্ড আসতে থাকতো । পিয়ন প্রতিদিন ঈদ কার্ড নিয়ে আসতো । আপা ও দিদিমনিকে ঈদ কার্ড বানাতে দেখেছি । দিদিমনির কাছে আসতো বেশি ঈদ কার্ড । বোনদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সামাজিকতা রক্ষা করতো দিদিমনি । ১৯৮৭ সাল থেকে আমি নিজেও ঈদ কার্ড দেয়া-নেয়া শুরু করি।

ঈদ উপলক্ষে সাপ্তাহিক রোববার বা সাপ্তাহিক বিচিত্রা ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করতো। সে সব ঈদ সংখ্যায় থাকতো দেশবরেণ্য লেখকদের লেখা । আগে থেকে বুকিং দিয়ে না রাখলে ঈদ সংখ্যা পাওয়া কঠিন ছিল।

শৈশবের ঈদে অনেক বৈচিত্রময় ছিল। সেখানে অনেক প্রাচুর্য ছিল না। যা ছিল সবকিছুই অল্প ছিল । আর তা নিয়েই সবার সন্তুষ্টি ছিল । অল্পটাই সবাইকে পরিতৃপ্ত করতো । এখন সবকিছু বেশুমার । বেশুমার পোষাক । বেশুমার কেকাপ্পা খাবার ম্যানু। বেশুমার টিভি চ্যানেল। বেশুমার ঈদ আয়োজন। কিন্তু এই বেশুমার আ্মাদের তৃপ্ত করতে পারে না।

শৈশবের ঈদের সাথে মাত্র একটা জায়গায় মিল খুঁজে পাই । আর তা হল- ঈদের রাতে বিছানায় শুয়ে মন খারাপের অনুভূতির । ঈদটা দেখতে দেখতে এসে ফুরিয়ে গেলো । ছোটবেলা ঈদের রাতে বিছানায় শুয়ে মন খারাপের কারন ছিল ঈদ ফুরানো মানে রোজা ও ঈদের দির্ঘ ছুটি শেষ । আবারো স্কুল শুরু । সাত সকালে স্কুলে যাওয়া বিরক্তিকর একঘেয়ে জীবন শুরুর ভয় কিন্তু এই বয়সে ঈদ শেষে বিছানায় গিয়ে মন খারাপ হবে কেন ?

আব্দুল করিম কিম, সমন্বয়ক, সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও প্রকৃতি রক্ষা পরিষদ।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ