প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আলমগীর শাহরিয়ার | ০১ জুলাই, ২০১৮
খেলা কী খুব সিরিয়াস কিছু? না, অতো সিরিয়াস কিছু না। আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু আছে। তাহলে এটা নিয়ে এতো হৈ-হুল্লোড়, মাতামাতি কেন? এর চটজলদি উত্তর আমার ঠিক জানা নেই। আমার কাছে খেলা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বিনোদনের সর্বজনীন একটি সেরা মাধ্যম।
প্রাচীন কালে খেলার আসরেই প্রথম সসম্মানে আফ্রিকার কালো দাসের উত্তরপুরুষ ইউরোপের দাস মালিক সাদা সন্তানের সংস্পর্শে গেছে, প্রাচ্যের হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন গেছে আরব বেদুঈন মুসলমানের কাছে, ঘৃণার আগুনে ছাই ঢেলে খৃস্টান ফের গেছে ইহুদির কাছে। পৃথিবীর কোনো ধর্মের কোনো তীর্থস্থানে সকল মানুষ এভাবে এক সঙ্গে এত আবেগ নিয়ে মিলতে পারেনি। বাণিজ্য আর ধর্মপ্রচারের বাইরে মানুষে-মানুষে, দেশে-দেশে, সংস্কৃতিতে-সংস্কৃতিতে খেলাধুলাই সেতুবন্ধনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
খেলা নিয়ে এই যে অন্তহীন আবেগ, উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা-এই সকলই আমি উপভোগ করি। পৃথিবীর প্রত্যেক জাতি হয়ত আমাদের মত না। তারা আরও ডিসিপ্লিন, ক্যালকুলেটিভ, ভোগবাদী সমাজের জন্য হাইলি ইনোভেটিভ।
কিন্তু এখানে মানুষের জীবন নিস্তরঙ্গ (তবে নির্বিরোধ নয়)। নিস্তরঙ্গ আটপৌরে জীবনে বিশেষ করে চার বছর পরপর অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপ কী শহর, নগর, বন্দর, গ্রাম নাড়িয়ে দিয়ে যায়। দেশ-বিদেশের বর্ণিল পতাকা উড়ে এদেশের হাওয়ায়, রাস্তায়। এই উদযাপন আমরা উপভোগ করি। এদেশের মানুষের আন্তর্জাতিক উদার মননের একটি বহিঃপ্রকাশ বলে ধারণা করি।
এই যে ঊনসত্তর বছর বয়সী মাগুরার কৃষক আমজাদ হোসেন নিজের চাষের একখণ্ড জমি বিক্রি করে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের জার্মানির পতাকা বানালেন- আমি এই ভালোবাসা বা উন্মাদনাকে একেবারে ফালতু বলে উড়িয়ে দিতে পারি না। কিংবা নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লার লালপুরের জয়নাল আবেদীন টুটুল যে নিজেদের বাড়িটি ব্রাজিলের পতাকার আদলে রঙ করেছেন। আপনি একমত না হতে পারেন তবু তাঁদের এই ভালো লাগা ও উন্মাদনার একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, ধর্ম আছে। মনে রাখা উচিত তারা কারোর পেটে লাথি মারেননি, অন্যের খাবার লুট করেনি, কাউকে খুন করেনি। একটি দেশের দলকে, খেলাকে কেবল ভালোবেসেছেন।
ভালোবেসে প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ কত কি-নাই করেছে। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের অনেক নির্মমতার সাক্ষী ভালোবাসার তাজমহলে কারো ক্ষুধা মেটে না। তবু প্রতিবছর পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ এটি দেখতে ছুটে যায়। আর বিশ্বকাপ উন্মাদনায় যে মানুষটি ইলেকট্রিক পোলে পতাকা লাগাতে গিয়ে মারা গেছে, কিংবা রঙ্গরসের বদহজমে মারামারি, খুনোখুনি করেছে-এর দায় কেউ নেবে না। ওই লোক এভাবে না হোক অন্যভাবে তার জীবনের এইসব অনতিক্রম্য ঝামেলা পোহাবেই। এর দায়ভার খেলার উৎসবের উপর চাপিয়ে লাভ কি মশাই!
জীবন কখনো কখনো কিংবদন্তি গল্পের। এখানে মানুষ কিংবদন্তি ভালোবাসে। কিংবদন্তির পেছনে ছুটে। কিংবদন্তির নাম শেরেবাংলা, ভাসানি, বঙ্গবন্ধু, পেলে, ম্যারাডোনা, রোনালদো, জিদান, মেসি, নেইমার। এখানে আমাদের রোজকার যাপিত জীবন দুঃখের, বেদনার আর কষ্টের। এসবের মধ্যেই মানুষ পরাজয়ের বেদনায় কাঁদে, এক-আধবার জিতবার উল্লাসে ফেটে পড়ে। বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে হাসে। মানুষের এই আবেগকে উপভোগ করতে জানা জরুরি। তবে ক্রিয়েটিভ ক্রিটিক হতে না পেরে বেসামাল ভাষিক আক্রমণ কেবল নিজেকে ছোট করে।
জগতকে সবাই প্রচলিত দার্শনিক বা বুদ্ধিজীবী বা ইশ্বরের নির্মোহ চোখ দিয়ে দেখে না। গর্ভধারিণী মাও সব সন্তানকে সমান চোখে দেখেন না। বাৎসল্য বিলানোয় তফাৎ করেন। এমনকি স্বয়ং ইশ্বরও ভালোবাসার পক্ষপাতে দোষী। জগত সংসার এমন অসংখ্য বৈচিত্র্যের ওপার সৌন্দর্যে ভরপুর। কেবল দেখার দিব্যদৃষ্টি থাকা দরকার। জীবন যাপনের একটি প্রচ্ছন্ন মোহ সকলেরই নিজস্ব অভিধানে আছে। দিনশেষে তো জীবনও একটি খেলা। সবাই সে খেলার প্রস্তুতি নেয়। কেউ বিজয়ী হয়, কেউ কেউ পরাজিত বোধ করে। আপনি নিশ্চয়ই গোল এ পৃথিবীর বিশাল খেলার মাঠে কেবল দর্শক নন অংশগ্রহণকারীও। খেলা তাই কেবল খেলা নয়। তারচেয়ে বেশি কিছু। জীবন যাপনেরই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। খেলা নিয়ে এই যে আবেগ, উন্মাদনা-একে একেবারে ফালতু বলে উড়িয়ে দেবার কোন অবকাশ নেই। উত্তেজনা উপভোগ করাই শ্রেয়।
শেষ করি ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ও লেখক হোরেস ওয়ালপোলের বিখ্যাত একটি কথা দিয়ে। "যারা অনুভব করে দুনিয়া তাদের জন্য ট্র্যাজেডি, যারা উপভোগ করে তাদের জন্য রসিকতা।" জীবন খেলার বিশ্বকাপে আমি বরাবরই শেষ দলের সাপোর্টার।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য