প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ০১ জুলাই, ২০১৮
সম্প্রতি ঢাকার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী ভর্তির সময় কিছু ছাত্রীকে ‘গেরাইম্মা’ বলে ভর্তি করতে রাজি না হওয়ার ও দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বোধসম্পন্ন আধুনিক মানুষেরা এতে আহত হয়েছেন। প্রাথমিক ক্ষোভ বর্ষিত হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির প্রতি। কিন্তু এটি আমার কাছে কেবল ঢাকার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়; বরং পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নগর সভ্যতার জন্য অপ্রস্তুত মেট্রোপলিটন নগরগুলোর ভারতীয় উপমহাদেশীয় জীনগত মনোবৈকল্য বলে মনে হয়।
মেট্রোপলিটন বা কসমোপলিটান নগরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে মানুষ খুব ব্যস্ত জীবন কাটায়, অন্য একটি মানুষের দিকে তাকিয়ে তাকে মাপামাপি বা জাজ করার সময় কারো হাতে থাকে না। নতুন একজন মানুষকে দেখলেই ট্যারা চোখে তাকিয়ে লোকটাকে মাপামাপি করার যে প্রবণতা এটা গ্রামে দেখা যায়। কারণ গ্রামের মানুষের হাতে অফুরন্ত সময়। নদীর ঘাটে বাঁশের মাচায় বসে এ গ্রাম-ও গ্রাম ছাড়িয়ে সাতগ্রামের কাসুন্দি ঘেঁটে নিজের গ্রামটিকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের অজস্র সময় তাদের।
আবার ভারতীয় উপমহাদেশের গ্রামীণ জীবন ধারায় রয়েছে প্রতিবেশীর সঙ্গে তুলনামূলক জীবন যাপনের মনোবিকৃতি। কে কার চেয়ে শ্রেয়তর এই দুশ্চিন্তায় জীবন তেতো করে ফেলা স্বভাবের মানুষ দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে অন্য কোথাও চোখে পড়ে না। খুব সম্ভব সমাজে শ্রেণি প্রথার গভীর শেকড় থাকায়; ভারতীয় উপমহাদেশ পৃথিবীর একমাত্র শ্রেণি সচেতন অঞ্চল।
বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনকালেই বিপুল সংখ্যক নারী গোয়েন্দা ছিলো যাদের কাজ ছিলো অন্যের বাড়িতে ফুচকি দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে এসে অন্যের বাড়ি নিয়ে কাসুন্দি ঘেঁটে রগড় করা। কে লম্বা, কে বেঁটে, কে ফর্সা, কে কালো এ এক বিরাট মাপামাপির ব্যাপার তাদের। নারীরা অন্য বাড়ির তথ্য নিয়ে এলে তা নিয়ে পুরুষেরাও সেসব গুপন (গোপন) তথ্য উপভোগ করতো বেশ দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে।
তো সেইসব মাপামাপির জীনগত সংস্কৃতি রক্তপ্রবাহে নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বেশ কিছু মেট্রোপলিটন শহর বিনির্মাণের চেষ্টা করা হলেও যথারীতি তা সম্ভব হয়নি। আধা খ্যাচড়া গ্রাম আর আধা খ্যাচড়া শহর সংস্কৃতির মিশেলে তৈরি হয়েছে মহানগরী। এসব মহানগরীর নিও এলিট আড্ডা দেখলে মনে পড়ে যায় বৃটিশ আমলের ধর্মান্তরিত খৃস্টানদের কথা; যারা রবিবারগুলোতে বেশ কোট টাই পরে চার্চে যেতো।
মাপামাপির বদঅভ্যাস হচ্ছে আমাদের দক্ষিণ এশীয়দের মজ্জাগত রোগ। সেরকম একটি বদ অভ্যাস প্রতিমুহূর্তে প্রকাশ পেয়ে যায় এদের আচরণে। একটি মেয়ে যোগ্যতা বলে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পাবার পরেও তাকে মাপামাপি করে 'গেরাইম্মা' বলার ঘটনা কেবল দক্ষিণ এশিয়াতেই সম্ভব। আমরা দক্ষিণ এশিয়ার বিজন গ্রামের মানুষ পৃথিবীর অনেক দেশের মেট্রোপলিটনে যাই; মানুষের সঙ্গে মিশি। কই কেউ কোনদিন গেরাইম্মা তো বললো না। বরং তাদের শহরে নতুন বলে উষ্ণ স্বাগত জানায়। সেটাই যে কসমোপলিটান শহরের বৈচিত্র্য; নানা রকম মানুষের উপস্থিতিই যে তাকে আরও সুন্দর করে তোলে।
বাংলাদেশিদের দেখেছি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চেহারা নিয়ে আচরণ নিয়ে এমনকি অধিক সন্তান হওয়া নিয়ে মাপামাপি করে এমন সব বর্ণবাদি মন্তব্য পাবলিকলি করে; যেন তাদের নিজের চেহারা-আচরণ-সন্তান জন্ম দেয়ার হার অত্যন্ত পরিমিত। ভারতীয়দের দেখেছি নিজের দেশের মধ্যেই এক রাজ্যের মানুষ আরেক রাজ্যের মানুষের চেহারা-আচরণ ও সংস্কৃতি মাপামাপি করে এমন বর্ণবাদি মন্তব্য করে; যেন তাদের নিজের চেহারা-আচরণ-সংস্কৃতি অত্যন্ত পরিমিত। আর পাকিস্তানিদের মধ্যেও ভারতের মানুষের মতোই নিজেদের এক প্রদেশের মানুষ অন্য প্রদেশের মানুষকে ছোট করার প্রবণতা অত্যন্ত প্রকট। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশের মানুষের চেহারা-আচরণ-সংস্কৃতি নিয়ে অত্যন্ত বর্ণবাদী মন্তব্য করেছিলো বিশেষত: পাঞ্জাবীরা।
পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মেট্রোপলিটনগুলো মূলত: গ্রামের অধিক গ্রামে পরিণত হয়েছে। কারণ তিনটি দেশের গ্রাম থেকে গিয়ে সবচেয়ে চতুর, নিম্নরুচির জটিল লোকগুলোই গড়েছে জটিলতর গ্রাম; নাম দিয়েছে মহানগর। এরা নিজেদের গ্রাম্যতা ঢাকতেই অন্যকে গেরাইম্মা বলে সার্টিফিকেট দেয় বলে মনে হয়। ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স বা হীনমন্যতাই এরকম সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স বা উচ্চমন্যতার রোগ তৈরি করে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য