আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ক্রিকেট: যাকে এক রূপে ব্যাখ্যা করা যায় না

ইমতিয়াজ মাহমুদ  

হুমায়ুন আজাদ স্যার তাঁর নিজের জাতিকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে কথা বলতেন বলে আমি মনে মনে একটু রাগ করতাম। স্যারের সাথে দেখাই হয়েছে কয়েকবার। সন্ধ্যায় পিজির ঐখানে গিয়ে বসেছি। প্রায় প্রতিবারই সাথে আমার বন্ধু আবদুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন। তাঁর লেখার মতো সামনাসামনি আলাপেও তিনি আমাদের জাতীয় বুদ্ধিমত্তার গড় মান নিয়ে ঐ তীব্রভাবেই কথা বলতেন। তখন মাঝে মাঝে একটু বিরক্ত হতাম। এটা কীরে ভাই! বিশেষ করে তিনি যখন তাঁর চারপাশে মূর্খ দেখতেন তখন মনে মনে ভাবতাম, যাহ্‌, এইটা কেমন কথা! সকলেই মূর্খ আর তিনি একাই কেবল জ্ঞানী?

স্যার তো আর এখন নেই, কিন্তু ওঁর কথাগুলি তো রয়েই গেছে। আমার এখন যতই বয়স বাড়ছে ততোই যেন মনে হচ্ছে স্যার আসলে ঠিকই বলতেন। আমাদের দেশের গড় বুদ্ধিমত্তার মান আসলেই খুব নিচু। এবং আমাদের চারপাশে সব মূর্খের দল। গিজ গিজ করছে মূর্খ, সর্বত্র মূর্খ। বিশেষ করে যেখানে যত চেয়ার দেখবেন, চেয়ারগুলিতে বসে আছে সব একেকজন ভোমা ভোমা ডাঁসা ডাঁসা মূর্খ। রাজনীতিতে, প্রশাসনে সর্বত্র। বিশ্ববিদ্যালয় আর জজ আদালতের কথা কিছু বললাম না। আপনারা নিজেরা জানেন।

নিজের জাতিকে নিজের মানুষকে এইভাবে তীব্র ভাষায় কেন আক্রমণ করতেন তিনি? সেটার ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন এক সাক্ষাৎকারে। কার সাথে সাক্ষাৎকারটা ছিল সে ভুলে গেছি। কিন্তু কথাগুলি মোটামুটি মনে আছে।

কিন্তু এই লেখাটা হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে নয় বা আমাদের বুদ্ধিজীবী বা রাজনীতিবিদ বা শিক্ষক বা উকিল সাহেব বা জজ সাহেবদের নিয়ে নয়। এই লেখাটা ক্রিকেট খেলা নিয়ে আমার দুইটা কথা বলার জন্যে একটা সবিনয় পোস্ট। (সবিনয় বলা ঠিক হচ্ছে কিনা সেটা অবশ্য বুঝতে পারছি না। সেটা আপনারাই বিবেচনা করেন।)


ক্রিকেট খেলার সাথে অন্য অনেক খেলার কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে। বড় পার্থক্যটা হচ্ছে ক্রিকেট কেবল মাত্র শারীরিক দক্ষতা বা নৈপুণ্য বা স্কিলের খেলা না। ক্রিকেট হচ্ছে একটা ইনটেলিজেন্ট খেলা। বিশেষ করে পেশাদার ক্রিকেট। পেশাদার ক্রিকেটে ভাল করতে হলে খেলোয়াড়দের নিজেদের নৈপুণ্যের সাথে সাথে একটু বুদ্ধিমত্তা থাকতে হয় আর থাকতে হয় পেশাদারিত্ব। আর দলীয়ভাবেও পুরো দলটির পেশাদারী দৃষ্টিভঙ্গি থাকার পাশাপাশি থাকতে একটু ইন্টেলেকচুয়াল ক্যাপাসিটি।

কিন্তু আপনি ইন্টেলেকচুয়াল ক্যাপাসিটি পাবেন কোথায়? আমাদের দেশের যে সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক মান খেলোয়াড়দের বেশিরভাগই তো সেই মাপেরই বুদ্ধিমান হবে। নাকি? আপনি দলে এগারোজন সুপার-বাঙালি পাবেন না। একজন দুইজন হয়তো পাবেন অন্যদের চেয়ে একটু অগ্রসর, কিন্তু গোটা দল তো আর দেশের সাধারণ মানের চেয়ে উপরে হবে না! ফলাফল যা হবার তাই। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ভাল দক্ষতা ও নৈপুণ্য নিয়ে খেলা শুরুর পরেও দেখা যায় যে আমাদের খেলোয়াড়রা একটা মানের চেয়ে খুব একটা উপরে উঠতে পারছে না।

এটা যে শুধু খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সেটা কিন্তু নয়। আপনি ক্রীড়া সাংবাদিক, ক্রীড়া লেখক, ধারাভাষ্যকার বিশেষজ্ঞ এইধরনের যারা যারা আছেন, যাদেরকে আপনি মাঝে মাঝে টেলিভিশনে দেখেন বা যাদের খবরের কাগজে পড়েন, এদের দিকে তাকিয়ে দেখেন। একেকজন ক্রিকেটের কমেন্ট্রি করেন এরা, ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে রিপোর্ট লেখেন, টেলিভিশনে রিপোর্ট লেখেন- ক্রিকেটটা ঠিকমত আলোচনা করেন না, নানাপ্রকার বিশেষণ, ক্রিয়াবিশেষণ আর এলেবেলে ধরনের কথা লিখে বা বলে খবরের কাগজের পাতা ভরে ফেলেন আর টেলিভিশনের ফুটেজ খেতে থাকেন।


আপনি যদি ক্রিকেটই লেখেন, তাইলে ঠিকঠাকমতো ক্রিকেটটা তো লিখবেন। আর ক্রিকেট লেখার জন্যে বিশেষ্য ব্যবহার করবেন, ক্রিয়াপদ ব্যবহার করবেন, অন্যান্য পদও ব্যবহার করবেন। কিন্তু ভাই খেলায় কী ঘটেছে সেটাই যদি ঠিকঠাক মতো না বলেন তাইলে কী করে হবে। এই যে এই টেস্টে আমাদের তাইজুল এগারো উইকেট পেয়েছে, সেটা নিয়ে তাইজুলের প্রশংসা তো করবেনই, কিন্তু আগে তো বলবেন যে সে কী করে উইকেটগুলি পেয়েছে, কোনটা কী বল ছিল, ব্যাটসম্যান কি খেলতে গিয়ে কিভাবে আউট হয়েছে ইত্যাদি এইগুলি তো বলবেন, নাকি? আপনি আমাদের যে কোন একটা বড় খবরের কাগজ খুলে দেখেন, কী মানের বর্ণনা রয়েছে সেখানে।

কমেন্ট্রি নিয়েও বলতে পারেন। ঢাকা শহরের ট্রাফিকের কল্যাণে আমাকে রেডিওর কমেন্ট্রি শুনতে হয় মাঝে মাঝে। আমি কিনা একসময় বিবিসির আর এবিসির ক্রিকেট কমেন্ট্রিও শুনেছি। তুলনা করার ভাষা আমার নাই, তুলনা করলাম না। কিন্তু আবশ্যক কথা না বলে তো পারছি না।

ক্রিকেট মাঠের প্রতিটা স্থান, বলতে পারেন যে প্রায় প্রতি বর্গফুট জায়গা আপনি চিহ্নিত করতে পারেন ফিল্ডিং পজিশনের নাম দিয়ে। ব্যাটসম্যানের প্রতিটা মুভমেন্টের নাম আছে। প্রতিটা বোলিং স্টাইলের নাম আছে, বর্ণনার উপায় আছে। একজন পাকা ধারাভাষ্যকার কেবল মুখের কথায় বোলারের বোলিং মার্ক থেকে ছুটে আসা থেকে শুরু করে একেকটা বলে কী কী ঘটেছে সেটা একদম দৃশ্যমান করে তুলতে পারে। যেন আপনি দেখতে পাচ্ছেন বলটার ফ্লাইট কিরকম ছিল, কোথায় পিচ করেছে, লেগ স্পিন ছিল কি অফ স্পিন ছিল কি চায়নাম্যান ছিল কি দুসরা ছিল, টার্ন করলো কিনা, ব্যাটসম্যান কি শট খেলেছে, বলটা মাঠের ঠিক কোন জায়গা দিয়ে কিভাবে কোন রাস্তায় গেল। ঠিকঠাক মতো কমেন্ট্রি হলে আপনি চোখ বন্ধ করেই খেলাটা দেখতে পাবেন।

কিন্তু ধারাভাষ্যকার যদি খেলাটা ঠিক কী হলো সেটা বর্ণনা না করে বোম্বাস্টিক একেকটা বিশেষণ মারতে থাকে তাইলে আপনার কেমন লাগবে, বলেন।


এই খেলাটায় বুদ্ধিমত্তা লাগে। বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে।

ক্রিকেট খেলা বলতে পারেন একটা গুচ্ছ খেলা। গুচ্ছ খেলা কী? ক্রিকেটে প্রতিটা বলই একেকটা স্বতন্ত্র খেলা। বোলারের হাত থেকে বলটা বেরিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে বলটা ডেড হওয়া পর্যন্ত প্রতিটা বলই একেকটা খেলা। আবার এইরকম ছয়টা খেলা নিয়ে একেকটা ওভারও আবার একটা স্বতন্ত্র খেলা। এইরকম অনেকগুলি খেলা মিলে হিসাব মিলাতে হয় একটা পুরো ইনিংস আর পুরো ম্যাচের পরিণতির।

আর এই যে খেলাগুলি চলতে থাকে, সেও আবার একটা ম্যাচের সাথে আরেকটা মিলবে না, সকালের সাথে বিকালে মিলবে না। কেননা একজন মানুষ একটা বল দুইবার করতে পারে না। প্রতিটা বলই নতুন। প্রতিটা শট নতুন। জীবন্ত খেলা। এমনকি পিচ, মাঠের গতি, আলো মেঘ রোদ হাওয়া- সবই খেলার অনুষঙ্গ। এই সবকিছু মিলিয়ে ফিল্ডিং ক্যাপ্টেন আক্রমণ শানাতে থাকেন ওঁর হাতের যত হাতিয়ার আছে সেগুলি দিয়ে। পরিকল্পনা করে, ব্যাটসম্যানকে মাপে, রোদ মাপে, খেলার গতি মাপে হাওয়া মাপে। তারপর একটা বল হয়। প্রতিটা আক্রমণই নতুন। ব্যাটসম্যান এইরকম প্রতিটা আক্রমণ মোকাবেলা করে। কখনো কখনো করে পাল্টা আক্রমণ, চড়াও হয় বোলারের উপর।

এই খেলা তো কেবল শারীরিক নৈপুণ্য দিয়ে হয় না। টেস্ট ক্রিকেট তো নয়ই। এর জন্যে বুদ্ধিমত্তা লাগে, সৃজনশীলতা লাগে। শুধু প্লেয়ারদের না। বোর্ডের, সাংবাদিকদের, কমেন্টেটরদের, এক্সপার্টদের, এবং সবার আগে দর্শকদের। আর এইখানেই আসে জাতীয় গড় ইন্টেলেকচুয়াল এবিলিটির কথা। গোটা জাতির গড় বুদ্ধিমত্তার মান যখন একটু বাড়বে, তখন দেখবেন টেস্ট খেলার মানও বাড়বে।

তাইলে তার আগে কি আমরা টেস্ট ক্রিকেটে ভাল করবো না? হয়তো করবো। টেস্ট ক্রিকেট হচ্ছে রহস্যময় ক্যারেক্টার- কখনো মনে হয় রুক্মিণী কখনো শ্রীরাধিকা আর কখনো চন্দ্রাবলীর মতো। এক রূপে তাকে আপনি ব্যাখ্যা করতে পারবেন না।

ইমতিয়াজ মাহমুদ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ