প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ২২ নভেম্বর, ২০১৮
বামদলের নেতা-কর্মীরা এতোবছর ধরে জন অভিমুখী রাজনীতি করে চলেছে। জনগণের দাবি দাওয়া নিয়ে কেবল তারাই সক্রিয় থাকে। সৎ ও সাদাসিধে জীবন তাদের। নির্বাচনে আদর্শ প্রার্থী বলতে যা বোঝায়; তা থাকে বামদলগুলোরই। অথচ বাংলাদেশের ভোটারেরা কখনোই তাদের দিকে তাকিয়েও দেখলো না।
এর কারণ খুব সম্ভব বড় দলগুলোর বাইরের চটকের প্রতি ভোটারদের সীমাহীন আগ্রহ। ঢাকা থেকে বাঘ-ভালুক মেরে বড় গাড়ি আর মোটর শোভাযাত্রা নিয়ে ফেরা বসন্তের কোকিল বড় দলের নেতাদের প্রতি ভোটারদের বিরাট আকর্ষণ।
আমাদের শেকড় সঞ্জাত সংস্কৃতিতে রাজা-বাদশা-পীরের প্রতি যে জীনগত ভক্তি উপচে পড়ার রোগ রয়েছে; সেটিই ভোটারদের আকৃষ্ট করে বড় দলের প্রার্থীদের রাজসিক কুচকাওয়াজ আর ভোটের মৌসুমে খই-মুড়ির মতো টাকা ছিটানোর প্রতি। ভোটারদের এই হীনমন্যতা ও নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার আজন্ম লালিত সাধে; এলাকায় সারা বছর জনস্বার্থে সক্রিয় বাম দলগুলোর প্রার্থীদের অবজ্ঞা আর অবহেলা করে তারা।
জনপ্রতিনিধি মানে জনগণের মাঝেরই একজন; তাদের মতো পোশাক পরে যে; খাবার খায় যে; পায়ে হেঁটে পথ চলে যে। কিন্তু ভোটারেরা ধরেই নিয়েছে জনপ্রতিনিধি মানে রাজা; তার রাজপ্রাসাদ থাকবে ঢাকায়; রাজভোগ খেয়ে খেয়ে শরীরে চর্বি থলথল করতে হবে তাদের; রাজ গাড়িতে চড়ে; অমাত্যবর্গ নিয়ে সে এলাকা দাপিয়ে বেড়াবে; তবেই সে যোগ্য প্রার্থী। এই যোগ্য প্রার্থীর পক্ষে ভোটের পাইকারি ক্রেতারা টাকার বান্ডিল নিয়ে এলাকায় ঘুরে। এক একটি এলাকার ভোট কেনে সে; যেন মানুষ সেখানে এক গুচ্ছ কিনে নেয়া ব্যালট পেপারের চেয়ে বেশি কিছু নয়।
আজন্ম পুষ্টিহীনতায় ভোটারদের মস্তিষ্ক বিকশিত না হওয়ায়; তারা বোঝে না; এই যে ভোট ফড়িয়ারা ভোট কিনে নিয়ে যাচ্ছে; এই টাকা তারা সুদে আসলে অনেক গুণ তুলে নেবে এলাকা থেকেই। তাদের ফুট সোলজার ক্যাডারেরা ভয় দেখিয়ে চাঁদা নেবে; এলাকার উন্নয়ন বাজেটে ভাগ বসাবে; কৃষকদের জন্য বরাদ্দ সার খাবে; নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বরাদ্দ খাদ্য খাবে; দুর্বল মানুষের জমি দখল করে খাবে; আর খাবে মানুষ।
আর এটাকেই "রাজনীতি" বলে সংজ্ঞায়িত করে বড় দলের কুমিরদের পোষা মিডিয়াগুলো। এই মিডিয়ার কাজ বড় দলগুলোকেই কেবল ভোটের যোগ্য করে দর্শকের সামনে পরিবেশন। সেইখানে সিল্কের পাঞ্জাবি আর হাতা-কাটা কোট পরে; বাচ্চা হাতির মত বিশাল দেহধারী নেতারা এসে গণতন্ত্রের সবক দেয়। জনগণকে দেশপ্রেমের চেতনা; অধুনা ধর্মীয় চেতনা শেখায়। ধনিক রাজনীতির নারীরা দামী শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে হাতে সোনার বালা পরে "দেবী চৌধুরানী" সেজে নেমে যায় এই ভোটের প্যারেডে। ভোটারেরা এইসব হাতি ও হস্তিনীর সার্কাস দেখে আনন্দে অশ্রুসিক্ত হয়।
সেই খানে কে আর ঐ বামদলের প্রার্থীরা! তারা গাড়ির শোডাউন; রাজপ্রাসাদ; টাকার বান্ডিল এসব কিছুই দেখাতে পারেনা। বাম দলের নারী পার্লার থেকে মেক-আপ শেক-আপ করে, ঘোমটা দিয়ে "রাজবধূ" সেজে ভোট চাইতে আসেনা। ওদেরকে দেখে ভোটারদের মনে হয়; নাহ; এরা রাজা-রাণী হবার যোগ্য নয়। যে মানুষগুলো সারাজীবন এলাকায় কাটালো; নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ালো; ধনী-গরীবের ব্যবধান কমানোর লক্ষ্যে স্থির থাকলো; তাদের ভোট দিয়ে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের কথা ভাবতে পারলো না সাধারণ জনগণ।
বাহিরি চটকের প্রতি ভোটারদের এই যে আত্মঘাতি আকর্ষণ; এতে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে; আজ গান্ধীজী, ভাসানী, বঙ্গবন্ধুর মতো নেতারা ভোট চাইতে এলেও; ভোটারেরা হয়তো টিপ্পনী কাটতো; নাহ টেকাটুকা নাই; গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি নাই; বিশাল গাড়ি নিয়া আসে নাই; ক্যান্ডিডেট দেইকা পছন্দ হইলো না।
এইরকম মধ্যযুগীয় চিন্তায় আবদ্ধ ভোটারদের ভোটে কল্যাণকর জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবার সম্ভাবনা খুবই কম। আজকাল পরিসংখ্যানে দেখি সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতা বেড়েছে; পুষ্টিযুক্ত খাবার খেতে পাচ্ছে তারা। এতে যদি মস্তিষ্কের পুষ্টি কিছু বেড়ে থাকে; সামান্য চিন্তার ক্ষমতা যদি বৃদ্ধি পেয়ে থাকে; আশা করা যায় ভোটারেরা একটু নয়ন মেলে দেখবে; ঐ গাড়ি বহর নিয়ে আসা ভোট-ব্যবসায়ী রাজা-গজা হচ্ছে দূরের মানুষ; আর জনগণের মতো দেখতে-তাদের মতোই অর্থনৈতিক অবস্থার বাম জোটের নেতারা আসলে তাদেরই একজন; নিকটতম আত্মীয়। এতোদিন যে রাজা-গজাদের ভোট দিয়েছে তারা; এরা রাজপ্রতিনিধি; কিন্তু এই সাম্যচিন্তার পরিশ্রমী রাজনীতিকরাই হতে পারেন জনপ্রতিনিধি।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য