আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

অরিত্রীদের জন্য-১

ড. কাবেরী গায়েন  

আমার প্রথম স্কুল ছিলো বেথেলহাম প্রাইমারি স্কুল, বরিশাল। বেতন দিতে হতো না। মাঝেমধ্যে সাদা মিশনারি কেউ এলে এক কাপ দুধ বা খান কয়েক বিস্কুট বরং পাওয়া যেত। নিচু বেঞ্চ, প্রায় মাটির সাথে মিশে থাকা। বড় দিদিমনি খুব কড়া ছিলেন। খুব ভয় পেতাম। ধর্ম-ক্লাসে খৃস্টান ছেলেমেয়েদের ক্লাসের পেছন বেঞ্চে বসে যীশুর অলৌকিক গল্প শুনতাম। অ-খৃস্টান ছেলেমেয়েরা তখন ক্লাসের বাইরে খেলে বেড়াত। আমি খেলায় দক্ষ ছিলাম না। তেমন দৌড়াতে পারতাম না। কোন ক্ষোভ ছিল না মনে। গল্প শুনে অনির্বচনীয় আনন্দে থাকতাম। ক্লাস শুরুর অনেক আগে গিয়ে গেটের সামনে দাঁড়াতাম, গেট খুললে হুড়মুড় করে ঢুকতাম। দশ পয়সার বাসি চালতার আচার অমৃতসমান ছিলো।

ক্লাস ফোরে উঠতে উঠতে দেখলাম ক্লাস শেষে কোচিং শুরু হয়েছে। আমি করিনি। টাকা দিয়ে কোচিং করানোর অর্থনৈতিক সামর্থ্য যেমন ছিলো না পরিবারের, দরকারও ছিলো না। তখন ক্লাসে পড়ানোর সাথে সাথে মাথায় গেঁথে যেতো। বাসায় এসে গল্পের বই পড়ায় তাই কোন সমস্যা হতো না। আমার ক্লাসের পেছন দিকে আমার চেয়ে বয়সে বড় কিছু মেয়েও পড়ত। ক্লাসে পড়া না পারলে দিদিমনিরা ডাস্টার দিয়ে তাদের ঠাস ঠাস করে মারতেন। কমন গালি ছিলো: 'বুনো জানোয়ারগুলো কোথাকার', 'অসভ্য ধাড়ি', 'স্কুলে না এসে মাকে সাহায্য করলেও তো পারো', 'এরা আসে ক্যান স্কুলে অ্যাঁ? এরা আসে ক্যান? খালি খালি বেঞ্চের জায়গা নষ্ট'...ইত্যাদি।

এই স্কুল ছেড়ে, কেঁদে-কেটে ক্লাস ফাইভের মাঝামাঝি রাঙ্গামাটি চলে গেলাম বাবার বদলির সুবাদে।

দুই
ভাঙা বছরে সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সম্ভব না। বাসার কাছে কাঁঠালতলি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন বাবা। ভাঙা বেড়ার সেই স্কুলে প্রায় মাটিতে বসে স্কুল করতাম। দিদিমনিরা উল বুনতেন। স্যাররা মাঝেমধ্যেই ছেলেমেয়েদের ঠাস-ঠাস করে বাড়ি দিতেন ডাস্টারের। আরেকটা খারাপ শাস্তি ছিল যে পড়া পারতো তাকে দিয়ে যে পড়া পারতো না তার কান টানানো। এই স্কুল থেকে বৃত্তি পরীক্ষায় আমি প্রথম বৃত্তি পাই, এমনকি তিন পার্বত্য জেলায় প্রথম হই। কী তাঁরা পড়িয়েছেন, আমি কী শিখেছিলাম মনে নেই। কোন ক্ষোভ, দুঃখ, বেদনা কিছুই হয়নি।

বছরশেষে ভর্তি হলাম রাঙামাটি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ভালো স্কুল। সবার সাথে হেঁটে প্রথমে গিয়ে উঠতাম সাম্পানে। লেক পার হয়ে পাহাড় ভেঙে উঠতাম। ফের মাইলখানেক হেঁটে স্কুলে ঢুকতাম। কোনদিন ক্লান্তি লাগেনি। এই স্কুলে মাঝেমধ্যে এক-আধটু ডাস্টারের বাড়ি খেয়ে থাকতেও পারি। কিন্তু মার খেয়েছি পণ্ডিত স্যারের কাছে। শিক্ষার্থীদের মারার ব্যাপারে তাঁর বিশেষ দক্ষতা ছিল। মুখও চলতো সমানে। একটা মেয়ের পদবি ছিলো পুরকায়স্থ। তিনি বলতেন, 'দাঁড়া, আজ তোরে আধা কায়স্থ বানাই।'

তিনি আমাকে পাঠাতেন ক্লাসের অন্যদের মারার জন্য গাছের ডাল ছিঁড়ে আনতে। আমি খুব অনিচ্ছায় গিয়ে অনেক সময় নিতাম সবচেয়ে দুর্বল ডালটা বাছার জন্য। মার খেতাম সেজন্য। একবার ধর্মক্লাসে যারা কথা বলেছে তাদের নাম তাঁর কাছে না দেবার জন্য তিনি আমাকে চাবির গোছা দিয়ে খুব মেরেছিলেন। বাসায় ফেরার পথে সেদিন সাম্পানের মধ্যে আমি বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাই। আমার মনিদা যাচ্ছিলেন তবলছড়ির লাইব্রেরিতে পড়তে। আমাদের সাম্পান লেকের এপারে ভিড়লে সেই সাম্পানে তিনি যাবেন। বেহুঁশ আমাকে কোলে করে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার মা একটু রাগ করেছিলেন। গানের শিক্ষক ভূপতি ধর স্যার তখন বাসায় এসে গান শেখাতেন। তাঁকে মৃদু স্বরে বলেওছিলেন কিছু হয়তো। কিন্তু আমার সামনে নয়। আমার ভেতর কোন বাড়তি ক্ষুব্ধতা সেজন্য তৈরি হয়নি।

স্কুলযাপনের স্বাভাবিক অংশ হিসেবেই ভেবেছি। কষ্ট পেয়েছিলাম অন্য এক ঘটনায়। স্বাধীনতা দিবসের রচনা প্রতিযোগিতায় আমি রচনা জমা দিয়েছিলাম একা। কিন্তু দিনশেষে স্টেডিয়ামে পুরস্কার নিয়েছিলেন লেখা জমা না দেয়া আমার এক সিনিয়র আপা। তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড টিচারের মেয়ে ছিলেন। এই ঘটনা জেনে আমাদের হেড টিচার প্রতিমা'দি শুনেছি শুধু বলেছিলেন তাঁকে, 'ছিঃ! এটা আপনি কী করেছেন? কীভাবে পারলেন!' আমার মা-বাবা সালিশে যাননি। আমার বাবা শুধু অবাক হয়ে বলেছিলেন, একজন শিক্ষক এমন কাজ করতে পারলেন! এই পর্যন্তই।

তিন
সেই স্কুল ছেড়ে, বন্ধুদের ছেড়ে পাবনায় এলাম ক্লাস সেভেনে। আমার মেজদা তখন ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্র। এস্কারশন থেকে একটা কাফতান কিনে এনেছিলেন। তখন শুক্রবারে স্কুলড্রেস না পড়লেও চলতো। তাই সাদা পাজামার উপরে ওই কাফতানটা পরে গিয়েছিলাম। আমাদের এক দিদিমনি (নাম বলছি না) খুব কর্কশ ভাষায় বকেছিলেন স্কার্ফ না পড়ার জন্য। তিনি বলেছিলেন, 'ওড়না পরার উপযুক্ত তুমি হওনি। কিন্তু একটা স্কার্ফ না পরে স্কুলে আসতে তোমার মা দিলেন কীভাবে?' তারপর তিনি কাঠের স্কেল দিয়ে সামান্য দু'টো বাড়ি দিয়েছিলেন হাতে আর দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন ক্লাসে। সেই প্রথম খুব খারাপ লেগেছিলো। বাসায় এসে বলিনি, কিন্তু কোনদিন আর ক্লাসে স্কুলড্রেস না পরে যাইনি। আমাদের এক আক্কাস স্যার ছিলেন। তিনি নাইন-টেনের মেয়েদের বোধহয় খুব খারাপ খারাপ কথা বলতেন। দু'একটা সে'সময়েও কানে এসেছে। এখন বুঝি তিনি আসলে খুব খারাপ কথা বলতেন। একবার ক্লাসে এক শিক্ষক 'Island'- এর উচ্চারণ ইস্ল্যান্ড করায় সেকথা বলেছিলাম বলে তিনি তেড়েমেরে বলেছিলেন, 'চেয়ারে বস তুই। আর এই নে চশমা। আমার চশমা তুই পর।' তারপর সারা ক্লাস দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। আমাদের হেড টিচার আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আসলে ভীষণ ভালোবাসতেন। কিন্তু তিনি কড়া নজর রাখতেন মেয়েদের উপর। কাউকে বকতেন, 'পা লম্বা হইছে?' কাউকে বলতেন, 'লেটার বক্স'। এখন বুঝতে পারি, কী কর্কশ কী অপমানজনক ছিলো সেইসব ডাক!

এইসব গল্পের কোন শেষ নেই। আমাদের স্কুলে নির্যাতন, গালি, অপমান কোন নতুন কথা নয়। ভিকারুননিসা স্কুলের প্রিন্সিপ্যালই একমাত্র অপমানকারী নন। ভিকারুননিসা স্কুলই কেবল খারাপ স্কুল নয়। স্কুলে স্কুলে এইসব কাহিনী। আমি বরং অবাক হচ্ছি জাতির প্রতিক্রিয়া দেখে। তাঁরা কি আসলেই জানেন না কী ধরণের অপমান করা হয় স্কুলগুলোতে? ভালো ছাত্রছাত্রী প্রথম বেঞ্চে বসবে আর খারাপরা শেষ বেঞ্চে থেকে শুরু করে কী করা হয় না? সেখানে নকল ধরা পড়লে ইজ্জত শিরোমণি স্কুলে টিসি দিতে চাইবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এক ম্যাজিস্ট্রেট প্রিলিমিনারিতে ভর্তি হয়েছিলেন। তাকে দেখেছি কী গো-গ্রাসে তিনি নকল করছেন। অথচ সেই তাকে একদিন বলতে শুনলাম, পরীক্ষার হলে গিয়ে প্রথমেই তিনি যে কাজটি করেন সেটি হল, কেউ নকল করলেই প্রথমে তিনি ঘুষি মারেন নাক বরাবর।

তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ!

ড. কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ