প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ড. কাবেরী গায়েন | ১১ ডিসেম্বর, ২০১৮
আমি কি নকল করাকে সমর্থন করছি?
শুরুতেই বলে নেয়া ভালো, ভিকারুননিসা নূন স্কুল কর্তৃপক্ষের যে রুঢ় আচরণের জন্য অরিত্রী আত্মহত্যা করেছে মর্মে খবর পাওয়া গেছে, প্রথম কিস্তিতে সেই রুঢ়তার বিপরীতে অবস্থান নেবার জন্য যাঁরা প্রশ্ন করেছেন, আমি নকলকে সমর্থন করছি কি না, তাঁদের প্রতি আমার পরিস্কার উত্তর, না। আমি নকল করাকে সমর্থন করিনি।
প্রথমত, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জানিয়েছে অরিত্রীর মোবাইলে পাওয়া বিষয়বস্তুর সাথে তার পরীক্ষার খাতায় লেখা বিষয়ের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাজেই, অরিত্রী নকল করেছে মর্মে যে খবর চাউর করা হয়েছিলো, সে’খবর মিথ্যা।
তদন্ত কমিটির রিপোর্টের সাপেক্ষে বলা যায়, অরিত্রী যেহেতু নকল করেই নি, তাই নকল করাকে সমর্থন করার প্রশ্নটি-ই এক্ষেত্রে অবান্তর। অরিত্রী ও তার পরিবারের প্রতি যে রুঢ় আচরণ করা হয়েছে, সেই আচরণের বিরুদ্ধাচরণ করা মানে নকলকে সমর্থন করা নয়। সেই সাথে বলে রাখছি যে, এমনকি যদি মিল পাওয়াও যেতো পরীক্ষার খাতা আর মোবাইলের বিষয়বস্তুর, তবুও আমি অরিত্রীর বাবার প্রতি এই রুঢ় আচরণের প্রতিবাদ বহাল রাখতাম। প্রকৃতপক্ষে, আমি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বের হবার আগেই, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী অরিত্রী নকল করেছে ধরে নিয়েই তার অভিভাবকদের সাথে দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ করেছি। সে অবস্থান থেকে সরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না।
আমি বরং বলতে চাই, পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কেউ মোবাইল ফোন নিয়ে ঢুকেছে দেখার পরে সেই মোবাইল জব্দ করা পর্যন্তই দস্তুর। এমনটা আমাদের বিভাগের পরীক্ষার হলেও হামেশাই ঘটে, এবং আমরা ঠিক এতোটুকুই করি। তবে, যদি ভিকারুননিসা নূন স্কুলে লিখিত নিয়ম থেকে থাকে যে কেউ মোবাইল নিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকলেই তাকে টিসি দেয়া হবে, তাহলে কিছু বলার নেই। সেটি প্রতিষ্ঠানের নিয়মের ব্যাপার। আমার পছন্দ-অপছন্দে কিছু যায় আসে না। যাঁরা এসব স্কুলে তাঁদের সন্তানদের ভর্তি করান, ধরে নেই এসব জেনেই ভর্তি করান।
সেই শৈশব থেকে শুনে এসেছি ক্যাডেট কলেজের নিয়মানুবর্তিতার কথা। যেসব অভিভাবক ক্যাডেট কলেজে তাঁদের সন্তানকে ভর্তি করান, নিয়মানুবর্তিতার এসব মিথ জেনেই ভর্তি করান। অনেকে হয়তো এইসব শৃঙ্খলার কথা জেনেই বরং বিশেষভাবে আগ্রহী হন সন্তানদের ভর্তি করতে। তো এইসব অতি সম্মানের স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারে যে বিশাল চাপ, সেই চাপ থেকে শিক্ষার্থী বাছাইয়ের জন্য কিছু উদ্যোগ স্কুলকে নিতে হতেও পারে। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ভুল উত্তর দেবার জন্য নম্বর কাটা হয়। এটা খুব পছন্দনীয় বিষয় নয়, কিন্তু একটা সিটের বিপরীতে যখন চার-পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী, তখন কোন না কোন উপায় নিতেই হয় চাপ কমানোর জন্য।
নকল করে ধরা পড়লে টিসির বিধান যদি থাকে সেটা দেয়ায় অভিভাবকদের রাগ করার কিছু নেই, কেননা তাঁরা এই বিধানের কথা জানেন। দশ লক্ষ টাকা দিয়ে এসব স্কুলে সিট কেনেন, বা পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চাকে লটারি তুলতে নিয়ে স্কুলের দরোজায় হাজির হন যেসব বাবা-মা, তাঁরা স্কুলের নিয়মের কথা জানেন না, বিশ্বাস করতে আমার অসুবিধা আছে। কিন্তু, সে’জন্য শিক্ষার্থীর মা-বাবার সাথে খারাপ আচরণ করাটা বৈধ হয়ে যায় না। তাই নিন্দা আমি জারি রাখছি।
দ্বিতীয়ত, আমি নকলকে সমর্থন করছি না বলাই যথেষ্ট নয়। আমি বরং সকল প্রকার নকলের বিরুদ্ধে। আসলে নকলের সংজ্ঞা এবং ব্যাপ্তি নিয়েই বরং আলোচনা হোক।
দুই
নকল কি কেবল পরীক্ষার হলে নিয়ে যাওয়া কাগজের টুকরো? বই? কিংবা মোবাইল ফোনে ডাউনলোড করা কোন ছবি বা জামার আস্তিনে লিখে আনা প্রশ্নের উত্তর যা দেখে দেখে পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার খাতায় লেখে চুরি করে?
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের গোটা শিক্ষাপাড়ায় শুধু এতটুকুই নকল বলে স্বীকৃত। পরীক্ষার হলে বসে এই কাজ করাকেই কেবল অন্যায় মনে করা হয়। কিন্তু পরীক্ষার হলে ঢোকার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত যে প্রশ্নের উত্তরগুলো মুখস্থ করল কোন পরীক্ষার্থী যা নিজে সে প্রস্তুত করেনি, যে প্রশ্নের উত্তর লিখেছেন কোন প্রাইভেট শিক্ষক বা কোচিং সেন্টারের কোচ, সেই অন্যের লেখা নোট মুখস্থ করে খাতায় উগরে দিয়ে আসাকে আমরা কতজন নকল মনে করি? আদৌ কেউ করি কি?
আমার সন্দেহ আছে। অথচ পার্থক্য তো কেবল অন্যের লেখা নোট পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে এবং পরে ব্যবহারের। সারা বছরের নকল করে আয়ত্ত করা শিক্ষাকে, যা বিপুল উদ্দীপনায় স্কুল, প্রাইভেট শিক্ষক, অভিভাবক এবং সমাজ-পরিজন প্রবলভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন, তকমা দেয়া হচ্ছে নকলের কেবল যদি কাগজের টুকরোটাকে কয়েক মিনিট পরে পরীক্ষার হলে উদ্ধার করা হয়। কী হাস্যকর আমাদের বিচার পদ্ধতি! ব্যতিক্রম পাই রবীন্দ্রনাথে, যিনি লিখেছেন, ‘মুখস্থ করিয়া পাস করাই তো চৌর্যবৃত্তি! যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাকে খেদাইয়া দেওয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, অর্থাৎ চাদরের মধ্যে না লইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায়, সেই-বা কম কী করিল?’ (শিক্ষা। শিক্ষার বাহন)
রবীন্দ্রনাথের এই কথা সোনার জলে বাঁধিয়ে রাখার মতো। তবে, তিনি যেটুকু বলেননি এখানে তা হল, শিক্ষার্থীকে মগজের মধ্যে মুখস্থ বিদ্যারূপী চৌর্যবৃত্তিকে ঢুকানোর আপাদমস্তক পদ্ধতিকে কী নামে ডাকা হবে। আমি বলি গোটা পদ্ধতিই হচ্ছে নকল পদ্ধতি। এখানে খালি পরীক্ষার হলে উদ্ধার করা কাগজের টুকরোটিকে নকল বলে চালানোর মানে হয় না।আমি এই গোটা প্রাইভেট আর কোচিং নির্ভর মুখস্তবিদ্যা পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে আসার পদ্ধতিকেই নকল বলছি। সেই নকলের বাইরে আজ আর কেউ নেই- না শিক্ষক, না অভিভাবক, না শিক্ষার্থী।
এমন প্রশ্ন কেনো হবে যে কেউ কী প্রশ্ন আসতে পারে অনুমান করে নোট করে মুখস্থ উত্তর মাথায় নিয়ে পরীক্ষার হলে আসতে পারে? আমাদের সময়ে চল ছিলো ‘সাজেশন’-এর। অমুক শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে হবে, উনি খুব ভালো সাজেশন দেন। দশটা সাজেশন দিলে আটটাই কমন আসে। সেই শিক্ষক কীভাবে জানতেন কোন প্রশ্ন আসবে? জানতেন, কারণ প্রশ্ন কমন পড়ারও একটা মুখস্থ ধারা ছিলো। যেমন, কোন অধ্যায় থেকে ‘ক’ প্রশ্ন গতবারে এসে গেছে, অতএব এবার ওটি আর আসবে না, অন্য যে প্রশ্নটি হতে পারে সেটি আসবে। অতএব, ধন্বন্তরি প্রাইভেট শিক্ষকের তেলেসমাতি মেনে দশ অধ্যায়ের বই থেকে গতবারে না আসা অন্য যে দশটি প্রশ্ন আছে, সেই দশটি পড়ার, মুখস্থ করার এবং সুচারুভাবে উগরে দিয়ে আসার নামই ছিলো ভালো ছাত্রত্ব। এই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে মনে হয় না। এখন শুনি, বিভীষিকার নাম না কি সৃজনশীল প্রশ্ন। মজার ব্যাপার হল, সেই সৃজনশীল প্রশ্নের জন্য না কি প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়ার কোন বিকল্প নেই। সৃজনশীলতার কী অসাধারণ প্রয়োগ!
তিন
যারা এই মুখস্থবিদ্যায় একটু কম পারদর্শী তাদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। আমি পরীক্ষার হলে অংকের সূত্র মনে রাখতে পারতাম না, অংকের উত্তর মনে রাখার চেষ্টাও করিনি কখনো। তাই পরীক্ষার হলেই যখন আমার বন্ধুরা বলতেন অংকের উত্তর মিলেছে, তখন অবাক হতাম। আর কলেজে স্ট্যাটিক্স, ডিনামিক্স করার সময়ে অংকের সূত্র মনে থাকতো না বলে আমার চারিপাশের মানুষের মতো নিজেও বিশ্বাস করতাম আমি অংকে ভালো না। বিদেশে পিএইচডি করতে যাবার পরে যখন ক্লাসে স্ট্যাটিস্টিক্স পড়াতে শুরু করলাম, তখন অনেকে বলতে শুরু করলেন আমি খুব ভালো বুঝি বিষয়টা। সত্যি বলতে আমার চোখে জল চলে এসেছিলো, যেদিন প্রথম বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার হলে পাহারা দিতে গিয়ে শুরুতেই পরীক্ষার্থীদের হাতে সব ফর্মুলা লেখা একটা একটা বড় কাগজ ধরিয়ে দিয়েছিলাম। হায়! শুধু এটুকু সুযোগ আমার দেশেও থাকলে আমার পড়াশুনা হয়তো অন্য ধারায় হতো। আমাদের দেশে অংক বোঝার সাথে ভালো শিক্ষার্থী হবার সম্পর্ক নেই, বরং সূত্র মুখস্থ রাখার সাথেই এই সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত।
চার
আমি এই সামগ্রিক নকল পদ্ধতির ঘোর বিরোধী, পরীক্ষার হলে এক-আধ টুকরা কাগজ নিয়ে ধরা পড়ে যে শিক্ষার্থী কেবল তাকে ডাইনীহত্যা করে এই নকল পদ্ধতির উপশম করা সম্ভব না। শিক্ষা নীতি, শিক্ষাদান পদ্ধতি, শিক্ষকের মান- এর সব কিছুতে আমূল সৃজনশীল পরিবর্তন না এনে ‘নকল’ করতে গিয়ে ধরা পড়া শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অপমান-লাঞ্ছনা-শাস্তির ছুরি বাগিয়ে তোলাটা এই গোটা অনৈতিক নকল ব্যবস্থার বলিকে ফের শাস্তি দেয়া ছাড়া আর কিছুই না। অনৈতিক ব্যবস্থায় যাঁরা বড় করছেন, তাঁরাই পেলেপুষে বড় করা শিকারটিকে মূহুর্তে ‘অনৈতিক’ তকমা লাগিয়ে ছুঁড়ে ফেলে নিজেদের পরিশুদ্ধ হিসেবে উপস্থাপন করছেন। এটা ঘোর অন্যায়। এই অবস্থার অবসান চাই। শিক্ষা পদ্ধতির সৃজনশীল এবং মানবিক পরিবর্তন চাই। বিদ্যমান পরিস্থিতি বজায় রেখে একজন নিরপেক্ষ বিচারক কাকে শাস্তি দেবেন আসলে নকলকারী হিসেবে?
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য