প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে নির্বাচনকালীন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দাবি করেছিলেন; তার দাবিতেই যে ব্যবস্থা চালু হয়েছিলো; সে ব্যবস্থাটি তিনি নিজেই তুলে দিয়েছেন উচ্চ আদালতের একটি রায়ের ওপর ভিত্তি করে। সে রায়ে এ ব্যবস্থা তুলে দেবার রায় দিয়ে বিদ্যমান বাস্তবতায় আরও অন্তত দুটি নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ব্যবহারের কথা রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছিলো। কিন্তু শেখ হাসিনা সে পর্যবেক্ষণকে উড়িয়ে দিয়ে তার ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করলেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনটি হলো একপেশে-ভোটহীন-অগ্রহণযোগ্য।
পাঁচবছর বে-আইনিভাবে ক্ষমতায় থেকে হাসিনা ২০১৮-র নির্বাচনের ডাক দিলেন। নিহত ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সরাসরি ছাত্র ড. কামাল হোসেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করলেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে গণতান্ত্রিক পন্থাকেই শ্রেষ্ঠতর মনে করেছিলেন। তার ছাত্র কামাল হোসেনও জনগণের ভোটাধিকারের নবজন্মের আন্দোলনে তাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংলাপ, প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তার অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পুলিশ-প্রশাসন সামরিকজান্তার প্রতি অনুগত হওয়া সত্বেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের নির্বাচনী প্রচারণা ছিলো নির্বিঘ্ন। এর আগে বঙ্গবন্ধুকে বার বার কারাগারে যেতে হয়েছে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার রুদ্ররোষে পড়ে। তার দলের নেতা-কর্মীদের বরণ করতে হয়েছে জেল-জুলুম। পরাধীন দেশের সে প্রতিকূলতার মাঝেও অন্তত ১৯৭০ সালের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনী প্রচারণা বাধাপ্রাপ্ত হয়নি।
আজ স্বাধীন বাংলাদেশে ড. কামালের ঐক্যফ্রন্টের নেতা-কর্মীরা নির্বাচনের প্রচারণার দিনগুলোতে আওয়ামী লীগের কর্মীদের হামলা ও পুলিশের জেল-জুলুমের মুখোমুখি। এমন একটি দিন নেই যেদিন ক্ষমতাসীন সরকারের পেটোয়া বাহিনীর বাধার মুখে পড়েনি ঐক্যফ্রন্টের নেতা-কর্মীদের নির্বাচনী প্রচারণা। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে বামদলগুলোর নেতা-কর্মীরাও অনেক জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীদের হামলার মুখে পড়েছে। লক্ষণীয় যে পুলিশ বাহিনী নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য ধরে রেখে দলীয় পেটোয়া বাহিনীর কাঁধে কাঁধ রেখে নির্বাচনের প্রতিপক্ষের দমন নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার এই আদিম দিকটির কথা খেয়াল রেখেই উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণে অন্তত দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের পরামর্শ রেখেছিলো।
শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্বাচিত বলে তা অগণতান্ত্রিক ও অগ্রহণযোগ্য; তাদেরকে বিশ্বাস করা যায় না; এমন কথা বার বার বলেছেন। অথচ শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন সরকারটিও অনির্বাচিত-অগ্রহণযোগ্য; সংবিধানের আনুষ্ঠানিকতা আর কথামালায় সাজিয়ে গণতান্ত্রিক বলা হলেও নির্বাচনের আগের দিনগুলোতে তাদের আচরণে প্রমাণ রেখে চলেছেন; গণতন্ত্রকে হত্যা করে এর মৃত কফিনে গণতন্ত্র বেঁচে আছে; এমনি একটি প্রহসনের বিষাদ-সিন্ধু আজকের বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনা নিজচোখে দেখেছেন; পাকিস্তানের সেই সামরিকজান্তা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সক্ষম হয়েছিলো ১৯৭০ সালে। প্রতিতুলনায় শেখ হাসিনা এই জায়গায় পিছিয়ে গেলেন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানের চেয়ে। শেখ হাসিনা দেখেছেন, ১৯৭০ সালে জনগণের দেওয়া রায় অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা অর্পণ না করে; গণহত্যার মাধ্যমে জনগণের রায়কে কফিনে শুইয়ে দিতে গিয়ে ইতিহাসের কোন আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন খুনে সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান।
বাংলাদেশ পর্বে জোর করে ক্ষমতা দখল করে গণতন্ত্রকে কফিনে শুইয়ে দিয়ে জিয়াউর রহমান ও এরশাদ স্বৈরশাসকের পরিচয়টি ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করেছেন। জিয়াউর রহমান স্টাইলের হ্যাঁ-না ভোট; বা এরশাদ স্টাইলের গৃহপালিত বিরোধী দল পুষে ভোটহীন ক্ষমতাসীন দল হবার প্রবণতাগুলো আজকের শেখ হাসিনা সরকারের প্রাত্যহিক অনুশীলনে ধরা পড়লে ইতিহাস শেখ হাসিনাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে তা সহজেই অনুমেয়।
বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি ভোটহীন নির্বাচন করলেও এর পর পরই আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটহীন নির্বাচনের ওপর নির্মিত বে-আইনি মসনদে আজো বসে আছেন।
নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লিগের সন্ত্রাসী ও ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি অনুগত পুলিশের এই প্রতিপক্ষকে হামলার বর্বরতা প্রতিদিন দেশের সাধারণ মানুষ দেখছে; চোখের সামনে তাদের নিহত ভোটাধিকারের শেষকৃত্য দেখছে। এই বেদনার প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ ঘটা করে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস উদযাপন করলেও এই গোষ্ঠীগত বিজয় উদযাপন সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করতে অসমর্থ হয়েছে। স্বৈরশাসনের অধীনে সমগ্র দেশকে একটি কারাগারে রূপান্তর করে কয়েদিদের মুক্তির গান গাইতে বলার মতোই প্রহসন এইসব মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদের বিমূর্ত আলঙ্কারিক শব্দমালা। যে মুক্তির বোধ যাপিত জীবনে নেই; তা ঠোঁটাচারে থেকে লাভ কী!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য