প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রণেশ মৈত্র | ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮
এবারের নির্বাচন এতটাই অত্যাসন্ন যে, বর্তমান নিবন্ধটি লিখে শেষ করা, দূরে পাঠিয়ে তাকে টাইপ করিয়ে আনা অত:পর পত্রিকায় পাঠানো, ডেস্কের প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষ করে তা পত্রিকার পৃষ্ঠায় মুদ্রিত আকারে প্রকাশ করা সময়াভাবে তার অবকাশ আছে বলে আদৌ মনে হয় না। দায়ী আমি নিজেই আমার হার্টজনিত কার্ডিয়াক সমস্যা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি হয়ে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দুটি সপ্তাহ কোন কিছু লেখার সুযোগ বিহীন অবস্থায় থাকার কারণেই এমনটি ঘটতে পারলো।
যা হোক, সাহস করে তবু লিখতে বসেছি ২৬ ডিসেম্বর সকালে। শারীরিক সুস্থতা যথেষ্ট না হওয়ায় লেখতে তেমন গতি আনতে পারছি না। কতটা গুছিয়ে লিখে আমার প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদেরকে উপহার দিতে পারব তাও অজানা।
নির্বাচনের নানাবিধ প্রক্রিয়া শুরু হতেই সকলে দেখলাম, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলগুলির মতভেদ। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বৃহৎ বিরোধী দল বি.এন.পি ই শুধু নয়, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ বাদ বাকী সকল বিরোধী দলও জোট। সবারই অভিযোগ হামলা, মামলা, আটক ও নির্যাতনে জর্জরিত বিরোধী দলগুলির প্রার্থীরা কর্মীরা। নবগঠিত জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া তাঁদের সর্ববাদী সম্মানিত নেতা গণফোরাম সভাপতি ও বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একদল বিরোধী দলীয় নেতা দফায় দফায় নির্বাচন কমিশনের সাথে দেখা করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার দাবীসহ বহু অনিয়মের কথা তুলেছেন। বহু প্রমাণ দাখিল করেছেন এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার দাবী জানিয়েছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা হবে বলে তাঁদেরকে আশ্বস্ত করেছেন কিন্তু নির্বাচনের দিনটি একবারেই দোরগোড়ায় এসে পড়লেও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দেওয়া ঐ প্রতিশ্রুতি আদৌ কার্যকর হয় নি।
বস্তুত: এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত সম্ভবত: অনেক আগেই নেওয়া হয়েছিল যে নির্বাচন হবে কিন্তু লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নয়। তাই বারংবার নানামহল থেকে নির্বাচনকালীন মন্ত্রীসভা, গঠন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, বর্তমান মন্ত্রীসভা বাতিল, সংসদ বাতিল প্রভৃতির পক্ষে জোরালো দাবী ওঠা স্বত্বেও তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নি। মন্ত্রী-এম.পি.রা স্বপদে বহাল থেকে সরকারি সুযোগ সুবিধা প্রায় সবগুলি গ্রহণ করে দিব্যি মনোনীত হয়ে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে পড়েছেন যেমনটি ২০১৪ সালের নির্বাচনের পূর্বে ঘটে নি। দাবীটি ছিল সর্বজনীন কিন্তু শেষতক দেখা গেল, দু’জন অনির্বাচিত মন্ত্রীকে (টেকনোক্রাফট) শুধু-বাদ দেওয়া হলো-বাদবাকি সব মন্ত্রী যথারীতি নিজ নিজ পদে বহাল থাকলেন থাকলেন সাংসদ রাও সবাই। শুধুমাত্র সরকারি গাড়ী ও পতাকা নিজ এলাকায় নির্বাচনী প্রচারে তাঁরা ব্যবহার করতে পারছেন-বাদ-বাকী সকল সুবিধাই তাঁদের রয়ে গেল নিরাপত্তাসহ। এতে হলো কি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ? অসম সুযোগে চূড়ান্ত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই তাদেরকে নির্বাচনে অংশ নিতে হচ্ছে কারণ তাঁরা সিদ্ধান্তই নিয়েছেন এবারে আর তাঁরা একতরফা প্রার্থী বিহীন, ভোটার বিহীন ২০১৪ সালের মত নির্বাচন করতে দেবেন- তা সে যতই বৈষম্য, হামলা-মামলা তাঁদেরকে কাবু করতে চেষ্টা করুক।
এ দিকে ব্যাপকভাবে অভিযোগ উঠছে-বি.এন.পি মনোনীত প্রার্থীরা নির্বাচনী ময়দানে থাকতে পারছেন না। বি.এন.পি প্রার্থীদেরকে পিটিয়ে, তাদের গাড়ী ভাংচুর করে মাঠ ছাড়া করা হচ্ছে। তা ছাড়াও বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, গণফোরাম মনোনীত প্রার্থীরাও রেহাই পাচ্ছেন না। সব কিছুই জানা স্বত্বেও নির্বাচন কমিশন নির্বাক যেন কোন কিছুই করার হুকুম তাঁদের নেই যদিও এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণে তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন। তবে হ্যাঁ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার তোতা পাখীর মত মাঝে মধ্যেই বয়ান ছাড়ছেন, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হয়ে গেছে-নির্বাচনের পরিবেশও সুন্দর।
দেশবাসী নির্বাক তাঁরা আদৌ মুখ খুলছেন না। ভাবখানা এমন, যেন দেশে কি ঘটছে না ঘটছে সে খবর তাঁরা রাখছেন না- রাখা প্রয়োজনও বোধ করছেন না। ভোট পাগলা বাংলাদেশে এমন জনমতের পরিস্থিতি এমন নিপৃহতা খুব কমই দেখা গেছে।
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। বিরোধী দলীয় বহু প্রার্থীকে নির্বাচনী প্রচারণাও চালাতে দেওয়া হচ্ছে না। হয় সরকার দলীয় গুণ্ডারা নয়তো পুলিশ প্রার্থী-কর্মী নির্বিশেষে পিটিয়ে সমাবেশ ব্যর্থ করে দিচ্ছে পণ্ড করে দিচ্ছে। অনেককে রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে আবার প্রতিদিনই বহুজনকে গ্রেফতারও করা হচ্ছে। এই হামলা মামলা গ্রেফতার, বিশেষ করে নির্বাচনের প্রাক্কালে একেবারেই নজীর বিহীন। বেদনা দায়ক বটে কারণ এগুলি ঘটছে গণতান্ত্রিক বলে পরিচিত একটি সরকারের আমলে এবং নির্বাচন কমিশনের চোখের সামনেই। এরপরও বলা হচ্ছে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা হয়েছে।
এবারের নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণ যেমন আনন্দের, তেমনই আবার এই দুঃখজনক এবং ঘোরতর আপত্তিকর ঘটনাবলী সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথে মারাত্মক প্রতিবন্ধক। বস্তুতঃ সরকারি দলের গুণ্ডারা যেন বিএনপিকে তার প্রতিশোধের রাজনীতিতে ফিরে আসতে এইভাবে উসকানি দিয়ে চলেছে। কিন্তু এতে তো কোন পক্ষেরই লাভ নেই। ক্ষতি কিন্তু সবারই। দেশের, দেশবাসীর এবং গণতন্ত্রের।
মনে রাখা দরকার কার্যতঃ একদলীয় নয়, প্রকৃতই নির্বাচনই হলো গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রার প্রথম সোপান। তাই নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে হতে না দেওয়া গণতন্ত্র বিরোধী একটি পদক্ষেপ। তাই, সকল মহলকেই গণতন্ত্র বিরোধী তাবৎ পদক্ষেপ থেকে এবং সকল প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ উসকানি থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান নিতে হবে।
তার সাথে একথাও স্মর্তব্য যে নির্বাচনই গণতন্ত্রের জন্য যথেষ্ট নয়-মুক্তিযুদ্ধ আমাদেরকে গণতন্ত্রের সকল তাৎপর্য সম্পর্কে স্পষ্ট দিক নির্দেশনা দিয়েছে বাহাত্তরের সংবিধানের মাধ্যমে। সংবিধান বর্ণিত সেই নির্দেশনাগুলি মুক্তিযুদ্ধের ৪৮ বছরেও অপূর্ণই শুধু নয়-তার মৌলিক নির্দেশনাগুলিতে আজও হাত দেওয়া হয় নি। সে কর্তব্যগুলি সম্পাদন না করলে মুক্তিযুদ্ধ যে অর্থহীন হয়ে পড়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের মৌল অর্জনগুলি বিসর্জিত হতে পারে তাও যেন আমরা দিব্যি ভুলতে বসেছি।
মূলনীতিতে বলা ছিল গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। এই চার স্তম্ভের সবগুলিই আজ নড়বড়ে। গণতন্ত্র নির্বাচনে সীমাবদ্ধ হয়েছে। আবার সেই নির্বাচনও হয়েছে প্রশ্ন বিদ্ধ। জাতীয়তাবাদ আজ আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ নেই হয়ে পড়েছে অনেকটাই যেন ইসলামী জাতীয়তাবাদ। আর সমাজতন্ত্র ? হলো দূর অন্তত, কারণ আজ বাজার অর্থনীতি দেশটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। একেই বলা হয় পাকিস্তানী করণ আদর্শিক ক্ষেত্রে। তার ঘনীভূত রূপ হলো সংবিধানের পঞ্চদশ সংবিধান যে খানে “বিসমিল্লাহ” সংযোজিত হয়েছে, ‘জামায়াতে ইসলামী বৈধ ধর্মাশ্রয়ী সকল দল ও সংগঠনকেও বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এগুলি সব সামরিক স্বৈরাচার জিয়াউর রহমানের কাণ্ড। অতঃপর এলেন হাজী এরশাদ। তিনি শেষ পেরেকটি মেরে দিলেন ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে’ সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে। পাকিস্তানীকরণের বাদ রইল কি ? দুই তৃতীয়াংশেরও বেশী আসন পাওয়া স্বত্বেও বিগত দুই টার্মের ১০ বছরেও বর্তমান সরকার এই পাকিস্তানী করণকে বিদেয় করে বাংলাদেশকে তার মৌলিকত্বে ফিরিয়ে আনেন নি। আর এবারের নির্বাচনে তেমন কোন প্রতিশ্রুতিও দেননি। ফলে আমাদের এই দুর্ভাগ্য জাতির ভাগ্যে প্রতীকে যাত্রা বোধ করি অক্ষুণ্ণ অব্যাহতই থাকবে।
এবারে আমি গণ মাধ্যমের প্রশ্নে। দেশে গণমাধ্যমের অন্ত নেই। সবাই ব্যস্ত নির্বাচন উপলক্ষে কোথায় কি মারামারি কাটাকাটি হবে তা প্রচার প্রচার নিয়ে। কোন নেতা আহত হলেন-কাদের নির্বাচনী ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ করা হলো অথচ প্রধান নির্বাচন কমিশনার কি বিষয়ে কি বললেন তা নিয়ে। দীর্ঘ ৬৫ বছর একটানা সাংবাদিকতা করে আমি নির্বাচনী প্রচারণায় জনগণের এমন করুণ পরিস্থিতি কদাপি প্রত্যক্ষ করি নি। এবারে করতে হচ্ছে। অথচ জনগণই হলেন নির্বাচনের প্রধান কারিগর বা প্রধান বেনিফিসিয়ারী অথবা প্রধান হেরে যাবার শক্তি।
শুধুমাত্র আওয়ামীলীগ বিএনপি ছাড়া আর কেউ নির্বাচন আছেন নিত্যদিনের সংবাদপত্র পাঠে তা সামান্যতমও উপলব্ধি করার জো নেই। অথচ ৪০টিরও অধিকদল এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। নির্বাচনী টুকিটাকিও বা প্রাক-নির্বাচনী জরীপও এখনও চোখে পড়ছে না।
দেখছি বিদেশী পর্যবেক্ষকদেরকে আসতে দেওয়া হচ্ছে না-ভিসা মঞ্জুর হচ্ছে না। দেশে যারা অনুমোদন পেয়েছেন পর্যবেক্ষণের তাঁদের মধ্যে কিছু সংস্থার অনুমতি বাতিলের প্রার্থনা সরকারি মহল থেকে। তবে কি গুরুতর কোন কিছু আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে ? জানি না কিছুই- জানানো হচ্ছেও না।
এহেন পরিস্থিতিতে টকশোগুলিও বেশী নিবেদিত হচ্ছে দলবাজির কাজে। কাজেই গণমাধ্যমেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য