আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

এমন সিদ্ধান্তের দায়টা কার?

দেবজ্যোতি দেবু  

পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ না পেয়ে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এমবিএ প্রথম বর্ষের ২য় সেমিস্টারের এক ছাত্র আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছেন বলে খবরে প্রকাশ। ছাত্রের নাম উত্তম কুমার দাশ। বর্তমানে তিনি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

চলতি মাসের ১৮ তারিখ উত্তমের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার কথা। কিন্তু সে পরীক্ষা দিতে পারছে না। কারণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিছু না বললেও উত্তমের সহপাঠীরা জানান, স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্রআন্দোলনে জড়িত থাকার অজুহাতে গত সেপ্টেম্বরে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাময়িক ভাবে বহিষ্কার করে। এই কারণেই তাকে পরীক্ষা দিতে দেয়া হচ্ছে না। ঐ বহিষ্কারাদেশের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে নানাভাবে তাকে হয়রানির শিকার হতে হয়। সর্বশেষ গত শুক্রবার ক্লাস থেকে বাসায় ফিরেই উত্তম আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বলে জানা যায়।

আত্মহত্যা কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য কোন সমাধান হতে পারেনা। এটা সমর্থনযোগ্যও নয়। তবে শুধুমাত্র এই কারণেই কি একজন শিক্ষিত প্রতিবাদী মানসিকতার একজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনাকে এড়িয়ে যাওয়া উচিত? অধিকার আদায়ের জন্য প্রতিবাদ করেছিল বলে তার পরীক্ষা দেয়ার অধিকার কেড়ে নেয়াটা কতোটুকু যৌক্তিক? মোটা অংকের ফিস নিয়ে এরপর অযৌক্তিক একটা কারণ দেখিয়ে তার পরীক্ষা দেয়ার অধিকার কেড়ে নেয়াটা কি তার ছাত্রত্বের অধিকার হরণ করা নয়? ভাবা যায়, জীবন ধ্বংসকারী এমন শাস্তি তাকে কতোটা অসহায় করে তুলেছিল যে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হলো সে!

উত্তমের দোষ কি ছিল? ছাত্রদের অধিকার আদায়ের জন্য আওয়াজ তোলা? একজন শিক্ষার্থী তার অধিকার আদায়ের দাবি জানাবে সেটাইতো স্বাভাবিক। এজন্য তাকে বহিষ্কার করা হবে? পরীক্ষা দেয়ার অধিকার থেকেও তাকে বঞ্চিত করা হবে? ক্ষমতা আছে বলেই কি তার যথেচ্ছা প্রয়োগ আমাদের মেনে নিতে হবে?

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বেশ কয়েক মাস ধরে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি নানান নেতিবাচক কারণে সমালোচিত হয়ে আসছে। দীর্ঘদিন যাবৎ ভার্সিটির কার্যক্রম চলছে ভিসি, প্রক্টর, ট্রেজারার ছাড়াই। ভারপ্রাপ্ত হিসেবে কয়েকজনের হাতে দায়িত্ব দিয়েই দায় সেরেছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এমন অবৈধ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে গেলেই বহিষ্কারের হুমকি দিয়ে দমিয়ে রাখা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে লাগাতার আন্দোলন করে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সুফল পাওয়াতো দূরের কথা উলটো শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার, পুলিশি হামলা, রাজনৈতিক কর্মীদের দ্বারা হুমকি ধামকি দিয়ে আন্দোলন দমানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এইটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের দাবি, তাদের পরিবারের সদস্যদেরও নানাভাবে হুমকি ধামকি দিচ্ছে তারা।

গত বছর ডিসেম্বরে সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ নিয়ে দ্বন্দ্ব ও মামলা থাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তির বিষয়ে সতর্কতা জারি করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। অথচ এরপরও কোন এক অজানা শক্তির ক্ষমতায় অবৈধভাবে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এই তথ্যটুকুই যথেষ্ট তাদের স্বৈরাচারী মনোভাব এবং ক্ষমতা প্রমাণের জন্য। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেখানে শিক্ষার্থীদের জীবন গড়ে দেয়ার ব্যবস্থা থাকার কথা, সেখানে তাদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে মৃত্যুর দিকে। বাধ্য করা হচ্ছে আত্মহত্যার মত জীবন বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত নিতে। বলতে পারেন, আত্মহত্যা করতে যাওয়ার এমন সিদ্ধান্তের দায়টা কার? শিক্ষার্থী উত্তম কি একাই এরজন্য দায়ী? একটি আইনসম্মত ন্যায্য দাবিতে অনড় থাকা, শিক্ষার্থীদের মঙ্গলার্থে দায়িত্বশীল অধ্যক্ষের নিয়োগ দাবি করাকে 'অপরাধ' বিবেচনা করে উত্তম এবং তার সহপাঠীর ছাত্রত্ব কেড়ে নেয়াটা কি বেআইনি নয়?

গত মাসে ভিকারুননিসা স্কুলে অরিত্রি নামের এক ছাত্রীকে বহিষ্কার এবং তার অভিভাবককে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়ার লজ্জা সহ্য করতে না পেরে অরিত্রির আত্মহত্যার ঘটনায় সারা দেশে প্রতিবাদ হয়েছিল। প্রশাসনকে বাধ্য করা হয়েছিল আত্মহত্যায় প্ররোচনা দানকারী শিক্ষকদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে। প্রশাসনের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ আমাদের আশ্বস্ত করেছিল অরিত্রি ন্যায় বিচার পাবে। এইবার উত্তমও কি ন্যায় বিচার পাবে? নাকি সর্বমহলের নির্লিপ্ততা এইবারও বাঁচিয়ে দেবে শিক্ষক নামক ঐ অমানুষদের? লজ্জিত হবে আমাদের প্রতিবাদী ছাত্র আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস! যে শিক্ষার্থীদের ভালর জন্য আওয়াজ তুলেছিলো উত্তম, তারাও কি উত্তমের জন্য কিছুই করবে না? উত্তমের পাশে দাঁড়াবে না? অরিত্রির জন্য প্রতিবাদ হলে উত্তমের জন্য কেন হবে না? উত্তম মরে যায়নি বলে?

ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য প্রতিবাদ করলে যে দেশে ছাত্রত্ব হারাতে হয় সেই দেশে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ কিভাবে আশা করতে পারি আমরা? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে কত ধরনের প্রলোভন দেখানো হয় শিক্ষার্থীদের! সবাই দাবি করে তারাই শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। অথচ ভর্তির পরেই শুরু হয় নানান নির্যাতন। এসবের কি কোন বিচার হবে না? শিক্ষকতার নামে এভাবেই বর্বরতা চালিয়ে যাবে তারা আর আমরা এভাবেই মুখ বুজে সব সহ্য করে যাবো? কোথাও কি কোন প্রতিবাদ হবে না? সহপাঠী হত্যার প্রতিবাদে ছোট ছোট বাচ্চারাও রাস্তায় নেমেছিল। আমরাতো তাও ওদের চাইতে বয়সে অনেক বড়। আজ যদি আপনারা উত্তমের পাশে দাঁড়াতে না পারেন তাহলে কি মুখ নিয়ে যাবেন উত্তমের সামনে, প্রতিবাদী ঐসব ছোট ছোট বাচ্চাদের সামনে? লজ্জা করবে না আপনাদের? যে রাষ্ট্রের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন বর্বরতা সংগঠিত হয় সেই রাষ্ট্র কিভাবে নিজেকে সভ্য বলে দাবি করবে?

উত্তম মরতে আসেনি। তার বাবা মা'ও তাকে মরার জন্য পাঠাননি। সে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর আস্থা রেখেই নিজের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল। সে স্বপ্ন দেখেছিল পড়ালেখা করে জীবনে অনেক বড় কিছু হওয়ার। কিন্তু তাকে সেটা করতে দেয়া হয়নি। তার স্বপ্ন নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। হাত পা বেঁধে তাকে পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছে সাঁতরে উপরে উঠার জন্য। তাকে বাধ্য করা হয়েছে স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করার জন্য। এই দায়টা কার? কে নেবে তার এবং তার বাবা মায়ের স্বপ্ন ভঙ্গের দায়? কাদের উপর বর্তায় এই দায়? আপনার বিবেক কি বলে? দেশের আইন কি বলে?

ব্যক্তিগতভাবে আমি উত্তমের উপর হওয়া এমন অমানবিকতার বিচারের দাবি জানাই। তার ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দিয়ে তাকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ করে দেয়ার দাবি জানাই। পাশাপাশি সরকারের কাছে দাবি জানাই ছাত্র নির্যাতনকারী এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং তার কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হোক। যেন ভবিষ্যতে আর কোন উত্তমকে এভাবে আত্মহত্যার জন্য প্ররোচিত হতে না হয়। উত্তমকে লজ্জিত হতে দিবেন না প্লিজ। উত্তমের বাবা মায়ের কাছে পুরো জাতিকে লজ্জিত হতে দিবেন না। এমন লজ্জা থেকে আমাদের বাঁচান!

দেবজ্যোতি দেবু, সংস্কৃতি কর্মি, অনলাইন এক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ