প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
এখলাসুর রহমান | ২৩ জানুয়ারী, ২০১৯
একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে বিদেশে নানা আলোচনা সমালোচনা চলছে। এই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনটিকে ঘিরে বাংলাদেশ সংকটে পড়ে যেতে পারে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। ভয় আর আতংকই বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংকট; এমন অভিমত দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব এন্টোনিও গুতেরেস। তিনি বলেন, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বহুল বিক্রিত পণ্য হলো ভয়। আপনি ভয় দেখিয়েই বিভিন্ন জরিপ ও রেটিংয়ে ভালো স্কোর লাভ করেন, ভয় দেখিয়েই নির্বাচনে ভোট নেন আবার বিজয়ীও হন। ভয় দিয়েই সবাই বিশেষ করে সরকারগুলো নিজেদের মত করে সবকিছুকে আদায় করে নেয়া হচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে গুতেরেস এসব কথা বলেন। একই সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বাংলাদেশের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ হয়নি। তিনি আরও বলেন, যে যত কথাই বলুক, নির্বাচনটি সুষ্ঠু হয়নি, এতে কোন সন্দেহ নেই। আর তাই বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি খোলামেলা সংলাপ বা আলোচনার কোন বিকল্প নেই। এটা করা সম্ভব না হলে দেশটি সংকটে পড়ে যেতে পারে। গুতেরেস জাতিসংঘ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচন ‘পারফেক্ট’ হয়নি।
দেশে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, ২০ দল, বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ও ইসলামী শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনও একাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে অভিযোগ করছেন। তারা এই সরকারের অধীনে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও হয়তো অংশগ্রহণ করছেনা। এই নির্বাচনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি)। দেশের জনসাধারণের মধ্যেও ভেতরে ভেতরে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। কিন্তু ভয়ে এই ক্ষুব্ধতা চেপে যাচ্ছে তারা।
নির্বাচন পরবর্তী মন্ত্রিপরিষদ গঠন নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে। তারা বিএনপি জামাত জোট সরকারের বিরুদ্ধে দুঃসময়ে একসাথে আন্দোলন করেছে। নবম সংসদ ও দশম সংসদে একসাথে নির্বাচন করেছে ও সরকারে থেকেছে। একাদশ সংসদেও একসাথে নির্বাচন করেছে। নির্বাচনের পরে তাদের বলা হচ্ছে বিরোধী দল হয়ে যেতে। নৌকা প্রতীক নিয়ে তারা নির্বাচন করেছে কিন্তু নৌকার বিজয় উৎসবে তারা আমন্ত্রিত হয়নি। এ নিয়ে শরিক দলগুলোর মধ্যে বিরাজ করছে নিশ্চুপ ক্ষুব্ধতা। ক্ষুব্ধতা বিরাজ করছে খোদ আওয়ামী লীগের দুর্দিনের সাথী ত্যাগী নেতাদের মধ্যেও।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছেন দশম জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তর যুব মহিলা লীগের সভাপতি সাবিনা আক্তার তুহিন। নিজের ফেসবুক পেইজে একটি আবেগঘন স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এমনটাই জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের এই ত্যাগী রাজনৈতিক। তিনি লিখেছেন, 'রাজনীতি থেকে মনে হয় বিদায় নিতে হবে, নায়ক নায়িকাদের এত ভিড়ে আমাদের আর দেখা পাওয়া কঠিন। আন্দোলন সংগ্রামের রোদে পোড়া শরীর এখন কিছুটা ভালো দেখতে হলেও নায়িকাদের রূপে বিলীন। 'তিনি বলেন, 'ক্ষমতায় থাকতে এত লোক বিরোধী দলে থাকতে তো দেখি নাই। মেয়েদের রাজনীতিতে কেবলই জ্বালা, নায়িকা জ্বালা। আবার মেয়ে হওয়ার জন্য পুরুষের চাইতে বেশি কাজ করলেও সাধারণ আসনে নমিনেশন দেয়া যাবে না। সরকারি দলের চাইতে তো বিরোধী দলেই ভাল ছিলাম, নিজেদের দল নিজেদের ছিল। এখন মহাবিপদ, আমাদের দল ছিনতাই করছে নায়িকা হাইব্রিড বিএনপি থেকে আমদানিকারীরা। 'সাবিনা আক্তার তুহিন দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে দলের দুঃসময়ে কঠোর ভূমিকা পালন করেছেন রাজপথে। বিএনপি জামায়াতের শাসনামলে রাজপথে নানা আন্দোলনে অংশ নিয়ে কঠোর ভূমিকা রাখার পাশাপাশি কারাবাসের শিকারও হয়েছেন বহুবার। জানা গেছে, নিজের শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় গ্রেপ্তার হয়ে শিশুকে দুধ না খাইয়েই জেলে যেতে হয়েছে তাকে। এইগুলো বেশিদিন আগের কথাও নয়। বিপুল কর্মী সমর্থকের সমর্থন ও প্রধানমন্ত্রীর আশির্বাদপুষ্ট হয়ে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ নিযুক্ত হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৪ আসন থেকে মনোনয়ন দাবি করেও বঞ্চিত হন তিনি।
ক্ষোভ দেখা দিয়েছে আওয়ামী ওলামা লীগেও। ওলামা লীগ নেতা মাওলানা মো. আবুল হাসান শেখ বলেন, আমাদের ঋণ আওয়ামী লীগ কোনোদিন শোধ করতে পারবে না। আমরা এত জীবনবাজি রেখে কাজ করেছি। ১/১১’ বলেন আর ‘৩০ এপ্রিল ডেডলাইন’ বলেন— সব জায়গায় আমরা ছিলাম। কিন্তু চিটারি-বাটপারি কোনও কিছু করি নাই আমরা। আমাদের বহু অবদান আছে। আমরা সর্বোচ্চ লেখাপড়া করছি। আজকে আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আওয়ামী লীগ। জয় বাংলা বলার কারণে আমরা ৩-৪ বার গ্রেপ্তার হইছি। পুলিশ আমাদের রাসেল স্কয়ার থেকে ধরে নিয়ে গেছে। তখন জলিল সাহেব, নাসিম সাহেব আমাদের ছুটাইছেন। উল্লেখ্য সরকার গঠনের পর আওয়ামী ওলামা লীগকে তাদের অঙ্গ,সহযোগী সংগঠন হিসাবে অস্বীকার করছে আওয়ামী লীগ। সবাইকে দূরে ঠেলে কোথায় ছুটছে দলটি। এত এত চাপা ক্ষুব্ধতার কী ফল হতে পারে? ক্ষোভ নিজ দলে, ১৪ দলে। নির্বাচনের আগে সক্রিয় জোটটি নির্বাচনের পরে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। অথচ নির্বাচনের আগে ১৪ দল নেতাকর্মীদের অধিকতর সক্রিয় করতে প্রচার করা হয়েছে এ জোট ক্ষমতায় না এলে সকলের জীবনের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। কেউ কেউ এমন কথাও বলেছে বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় এলে কারও পিঠের চামড়া থাকবেনা। এখানেও নেতাকর্মীদের বশে রাখতে ভীতিপ্রদর্শনকেই কাজে লাগানো হল। হয়তো সেজন্যই মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার অনেকেই সাহস পায়নি।
নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা চলছে দেশে বিদেশে। এসব সমালোচনার জবাবে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘জাতিসংঘ বলছে নির্বাচনটা পারফেক্ট ছিল না, নিখুঁত ছিল না। আমি বলছি, নিখুঁতভাবে কোন দেশে নির্বাচন হয়েছে? কে বলতে পারবে আমার নির্বাচনটা একেবারে নিখুঁত। ’এই কথায় কি এসব সমালোচনার যথার্থতার দিক স্পষ্ট হয়ে উঠল না?
এদিকে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের একাদশ সংসদ নির্বাচনে ‘ভোট ডাকাতি’ করে আওয়ামী লীগ জিতেছে বলে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি অভিযোগ করে চলেছে।
বাংলাদেশের সদ্য সমাপ্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘প্রহসনের ভোট’ আখ্যা দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের এডিটরিয়াল বোর্ড গত ১৬ জানুয়ারি একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিগত ১০ বছরের সাফল্যের প্রশংসা করা হয়। মাথাপিছু আয় ১৫০ ভাগ বৃদ্ধি, চরম দারিদ্র্য ১৯ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশে নেমে আসার বিষয়গুলোকে উল্লেখ করা হয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর সব অর্জন নির্বাচনে একতরফা জয়ের কারণে ম্লান হয়েছে বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছে। তারা বলছে বিএনপি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ‘অপপ্রচার’ চালাচ্ছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ঐক্যমত্যের সরকারের মন্ত্রী আ স ম আব্দুর রব এবার রয়েছেন আওয়ামী লীগ বিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে একক আধিপত্য বিস্তার করার কারণে মহাজোটের শরিকদের ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে টানাপোড়ন সৃষ্টি হয়েছে; যা আগামীতে আরও অবনতির দিকে যাবে এবং এর ফলে একটা অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এর ফলে আওয়ামী লীগ দেশ চালাতে পারবে না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিশ্বে গ্রহণযোগ্য হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, বহির্বিশ্ব তথা জাতিসংঘ সহ দাতা সংস্থাগুলোর চাপের মুখে সরকার কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে। কিন্তু তা কোনোভাবেই ফলপ্রসূ হবে না।
আবার নতুন এমপিদের শপথের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা রিটের শুনানি হতে চলেছে ৩১ জানুয়ারি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত এমপিদের শপথের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট শুনানির জন্য ৩১ জানুয়ারি দিন ধার্য করেছেন আদালত।
৮ জানুয়ারি সংবিধান অনুসারে দশম জাতীয় সংসদ না ভেঙে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত এমপিদের নেয়া শপথের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে আইনি নোটিশ দেয়া হয়। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মো. তাহেরুল ইসলাম তাওহীদের পক্ষে নোটিশটি পাঠান মাহবুব উদ্দিন খোকন। নোটিশে বলা হয়, সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদে- সংসদ ভেঙে দিয়ে পুনরায় এমপিদের শপথ অনুষ্ঠিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু সে অনুচ্ছেদ প্রতিপালন না করে পুনরায় সংসদ সদস্যরা শপথ নেয়ায় বর্তমানে দুটি সংসদ বহাল রয়েছে, যা সংবিধান পরিপন্থী। কিন্তু সেই নোটিশের কোনো জবাব না পেয়ে তারা হাই কোর্টে রিট আবেদন করেছে। সংবিধানের আলোকে কী রায় দেবে হাই কোর্ট? দু'সংসদ ও সংবিধান লঙ্ঘনের সমালোচনাকে কেন চলতে দেয়ার সুযোগ দেয়া হল? কেন সংসদ ভেঙে শপথ নেয়া হলো না? নিলে এমন কি ক্ষতি হতো? ১২৩(৩) অনুচ্ছেদটির সঠিক ব্যাখ্যা কী? সংবিধান বিশেষজ্ঞদের প্রতিই এ প্রশ্নটা রইল।
দেশিবিদেশি সমালোচনা, নিজ দলে, জোটে ক্ষোভ বিক্ষোভ নিয়ে একলা চলো নীতিতে আওয়ামী লীগ কোথায় ছুটছে? তারা ছুঁড়ে ফেলছে জনগণের স্বাধীন ভোটাধিকার, ছুঁড়ে ফেলছে বিরোধী দল, ছুঁড়ে ফেলছে শরিক দল, ছুঁড়ে ফেলছে মহাজোট ও ছুঁড়ে ফেলছে দুর্দিনের সাথীদের। এরকমভাবে তারা নিজেরা কোথায় যাচ্ছে আর দেশকেও বা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য