প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আব্দুল করিম কিম | ২৬ জানুয়ারী, ২০১৯
যেহীন আহমেদ, আগাছার জঙ্গলে থাকা এক ছায়াবৃক্ষ। সমসাময়িক সময়ে এমন ছায়াবৃক্ষ দেখা দুর্লভ। তিনি ছিলেন দেবতুল্য এক বিরল মানুষ। সিলেটে বিরলপ্রজ এ মানুষ দহনকালেও বেঁচে ছিলেন। গত ২৮ অক্টোবর তাঁর চিরবিদায় হয়। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেন্ডস ইন ভিলেজ ডেভেলপম্যান্ট অব বাংলাদেশ(এফআইভিডিবি)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক নিভৃতচারী যেহীন আহমেদ ছিলেন শিক্ষা ও উন্নয়ন সহযোগিতার অনন্য সব প্রয়াসের জনক। জীবন জুড়ে নানা স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছিল তাঁর ব্যস্ততা।
১৯৫০ ইংরেজির ১ বৈশাখে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী সুনাইতা গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারে যেহীন আহমেদের জন্ম। তাঁর দাদা ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এক নির্ভীক কর্মী এবং ভবিষ্যতের সমাজসংস্কারে মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষার অনুসারী। শিক্ষানুরাগী বাবার উৎসাহে তাঁর বাবা নাজমুল হুসাইন চৌধুরী কলকাতায় পড়াশোনা করতে যান। ব্রিটিশ আমলেই ইন্সপেক্টর অফ কলেজ হয়ে তৎকালীন পূর্ববাংলায় এবং সিলেটে শিক্ষা বিস্তার ও নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি ছিলেন সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সাহিত্য সংসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। যেহীন আহমেদ-এর চাচা খান সাহেব মোদাব্বির হোসেন চৌধুরী ছিলেন ‘৪৭ পূর্ব আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং আসামের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী স্যার সৈয়দ সাদুল্লাহর মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি ইন্দোনেশিয়াতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন। তাঁর মাতুলালয় সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার প্রসিদ্ধ ফুলবাড়ি গ্রামে।
যেহীন আহমেদের জীবনের সবচেয়ে বড় অবদান ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি সাহায্য প্রতিষ্ঠান ফ্রেন্ডস ইন ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ (এফআইভিডিবি)-এর প্রতিষ্ঠা। যার গ্রামবান্ধব কর্মসূচি বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায় অসামান্য অবদান রেখে যাচ্ছে।
এফআইভিডিবি নতুন শিক্ষা পদ্ধতি, এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংগঠন গড়া, অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনে নানামুখী নিরীক্ষা, অনগ্রসর মানুষের স্বাস্থ্য সেবার উদ্যোগ, কর্মসংস্থান তৈরি ও খাদ্যে উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে যেহীন আহমেদ ছিলেন অগ্রসর চিন্তার মানুষ।
শিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের উদ্ভাবিত ‘ফাংশনাল লিটারেসি’ কর্মসূচি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রশংসিত হয়। বর্তমানে দেশে ৩০০টি সংস্থা এই পদ্ধতি ব্যবহার করছে এবং ২১ লাখ মানুষ এই পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। ভারতের বিহার ও উড়িষ্যায় ১৯৯২ সাল থেকে এবং সম্প্রতি ইয়েমেনে এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। ইদানীং শহরের বস্তিতেও এটি চালুর জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা উদ্যোগ নিয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে যাঁরা বেসরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত, তাঁদের সমীহ পেয়েছেন যেহীন আহমেদ। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও বিভিন্ন উন্নয়ন ফোরামে যেহীন আহমেদ ছিলেন পরিচিত মুখ। দেশ ও বিদেশের আলোকিত মানুষেরা যেহীন আহমেদকে জানতেন। তবে হাইব্রিড উর্বরতার জমিতে উৎপন্ন প্রতিনিয়ত সম্বর্ধনা-প্রাপ্ত 'বিশিষ্ট ব্যক্তি'দের কাছে যেহীন আহমেদ অচেনা ছিলেন। তাঁর কাজের ব্যাপ্তি পরিমাপ করার যোগ্যতা "হাইব্রিড বিশিষ্ট ব্যক্তি'দের নেই। আপাদমস্তক রাজনীতি সচেতন মানুষ হয়েও বাংলাদেশের রাজনীতির মানুষদের থেকে তিনি দূরে থেকেছেন। তাই একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদক পাওয়ার শতভাগ যোগ্যতা সত্বেও এই রাষ্ট্রের পরিচালকেরা তাঁকে মূল্যায়ন করেনি।
তিনি অবসর কাটাতেন বিশ্ব সাহিত্যের খবরাখবর ও ক্লাসিক্যাল মিউজিকে। ক্লাসিক্যাল সংগীতের ঈর্ষনীয় সংগ্রহ ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এসব সংগ্রহ করেছিলেন। ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথকে। জীবনানন্দকে খুঁজতেন। হাফিজ, মির্জা গালিব, আল্লামা ইকবাল, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ-এর চর্চা করতেন আড্ডায়-আলোচনায়। তাঁর মতো মানুষ আমাদের সমাজে খুব বেশি নেই, আসবেনও না। আরেকজন যেহীন আহমেদের বেড়ে ওঠার মত সামাজিক পরিমণ্ডল ধ্বংস হয়ে গেছে।
সমাজকর্ম আর উন্নয়নকে সংসার মনে করে জীবন কাটিয়ে দেয়া যেহীন আহমেদের অনাড়ম্বর জীবনযাপনের গল্প অবিশ্বাস্য মনে হয়। নিজের জন্য কিছুই করেননি। প্রান্তিক মানুষের সংসার গড়ে দিয়েছেন, কিন্তু নিজের সংসার হয়নি। যেহীন আহমেদের রক্তের কোন উত্তরাধিকারী নেই। তবে কর্মের-ভাবের-স্বপ্নের উত্তরাধিকারী তিনি রেখে গেছেন। তাঁর প্রিয় একটি রবীন্দ্র সংগীতে রেখে যাওয়া সেই উত্তরাধিকারীর কথা আছে।
"আসা-যাওয়ার পথের ধারে /গান গেয়ে মোর কেটেছে দিন / যাবার বেলায় দেব কারে / বুকের কাছে বাজল যে বীণ / সুরগুলি তার নানা ভাগে / রেখে যাব পুষ্পরাগে / মীড়গুলি তার মেঘের রেখায় / স্বর্ণলেখায় করব বিলীন / কিছু বা সে মিলনমালায় / যুগলগলায় রইবে গাঁথা / কিছু বা সে ভিজিয়ে দেবে / দুই চাহনির চোখের পাতা / কিছু বা কোন চৈত্রমাসে / বকুল-ঢাকা বনের ঘাসে / মনের কথার টুকরো আমার / কুড়িয়ে পাবে কোন উদাসে"। নির্মোহ ও অনাড়ম্বর জীবনের অধিকারী উদাসী যেহীন আহমেদ মনের কথার টুকরো রেখে গেছেন বকুল ঢাকা বনের ঘাসে। কোন "উদাসে' যা ঠিকই কুড়িয়ে পাবে, সে বিশ্বাসেই কর্মময় জীবনের তিনি সমাপ্তি টেনেছেন।
যেহীন আহমেদের সাথে আমার আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ হয় ব্যবসায়িক কারণে। ২০০১ সালে আমরা বন্ধুরা মিলে প্রতিষ্ঠা করি বেসরকারি ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সিলেট অনলাইন বাংলাদেশ ( সল-বিডি)। আমি ছিলাম প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ২০০৩ সালে এফাআইভিডিবি আমাদের থেকে ইন্টারনেট সংযোগ নেয়। খাদিমে তাঁদের প্রধান কার্যালয়ে ইন্টারনেট সেবাদানের জন্য ওয়ারল্যাস টাওয়ার নির্মাণ ও ইকুইপমেন্ট সেট-আপ সহ ইন্টারনেট সেবাদানের লক্ষ্যে প্রায় দুই/তিন লক্ষ টাকার একটি চুক্তিপত্র সাক্ষর হয়। নির্ধারিত ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবাদানের মাসিক মূল্য ৩০,০০০ টাকা সাব্যস্ত হয়। এক বছর মেয়াদী সেই চুক্তিপত্রে এফাআইভিডিবির পক্ষে যেহীন আহমেদ ও সল-বিডি'র পক্ষে আমি সাক্ষর করি। সেই সময় থেকেই তাঁর শুশ্রুমণ্ডিত হাসি মুখ হৃদয়ে গেঁথে যায়। যদিও তাঁর সাহচর্য লাভের সে সময় কোন সুযোগ হয়নি।
২০১৩ সালে সামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদকে সিলেটে নাগরিক সংবর্ধনা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। স্যার ফজলে হাসান আবেদ নাগরিক সংবর্ধনা কমিটি, সিলেট গঠন করা হলে যেহীন আহমেদকে আহবায়ক করা হয়। সেই আহবায়ক কমিটিতে আমিও একজন সক্রিয় সদস্য ছিলাম। এই আয়োজনের সুবাদে আবারো তাঁর সংস্পর্শ পেলাম। দেখলাম তাঁর নিখুঁত কর্মপরিকল্পনা। কমিটির সকল সদস্যের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে শোনার আগ্রহ। এরপরে একাধিকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। প্রতিবার তিনি "নাগরিক সংবর্ধনা" কমিটিতে ছিলাম একথা বলে আমাকে যে চিনেছেন তা বুঝিয়ে দিতেন। সে সময় তাঁর কাছে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলাম কিন্তু কাছে যাইনি, ধারণ করার যোগ্যতা হয়নি ভেবে।
যেহীন আহমেদ-এর ‘ফাংশনাল লিটারেসি' কার্যক্রমের উদ্ভাবনী দলের অন্যতম সদস্য আ ন স হাবিবুর রহমান আমার ফুফাতো ভাই। ৪ জুলাই ২০১৮ ইং তারিখে আ ন স হাবিবুর রহমান দুরারোগ্য ব্যাধিতে মৃত্যুবরণ করেন। ১১ আগস্ট ২০১৮ ইং তারিখে সিলেটে আয়োজন করা হয় আ ন স হাবিবুর রহমান স্মরণে 'নাগরিক শোকসভা'। শোকসভা প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক করা হয় এডভোকেট ই ইউ শহিদুল ইসলাম শাহিন ও সদস্য সচিব করা হয় আমাকে। শোকসভাতে যেহীন আহমেদ ছিলেন প্রধান অতিথি। তাঁর সাথে এই আমার শেষ দেখা। অনুষ্ঠান শেষে তাঁকে বললাম, আমার কাজিন ও আপনার স্নেহধন্য সাংবাদিক ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন আমাকে একটি দায়িত্ব দিয়েছেন। প্রথম আলো, উত্তর আমেরিকা'র জন্য আপনার একটি ইন্টারভিউ করতে হবে। যেখানে ‘ফাংশনাল লিটারেসি' ও এফআইভিডিবি প্রতিষ্ঠার না বলা কথাগুলো বলবেন। তিনি জানালেন, পরের দিন ঢাকা চলে যাচ্ছেন। আবার সিলেট আসলে আমি যেন তাঁর মিরেরময়দানের বাসায় যাই। তিনি আমাকে সময় দেবেন।
আমি আর যাইনি। বোহেমিয়ান ব্যস্ততায় ভুলে গেছি। জীবনের একটি অনবদ্য অর্জন থেকে বঞ্চিত করেছি নিজেকে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য