আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

রবীন্দ্র-বিরোধীদের লাভালাভ

দেবজ্যোতি দেবু  

রবীন্দ্র-বিরোধীদের মুখে রবীন্দ্র বিতর্ক নতুন কিছু নয়। তাদের জন্মই হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কুৎসা রটনা করতে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে তখন, যখন কথিত প্রগতিশীলরাও কোনকিছু যাচাই বাছাই না করেই সেই ফাঁদে পা দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে 'চোর' দাবি করে বসে!

বেশ কিছুদিন যাবত রবীন্দ্রনাথ নিয়ে একটা অভিযোগ লক্ষ্য করছি যে তিনি গগন দাস (গগন হরকরা) এর সুর 'চুরি' করে আমাদের জাতীয় সংগীতে ব্যবহার করেছেন। তাই কোন বিতর্কিত গান আমাদের জাতীয় সংগীত হতে পারে না!

এমন অভিযোগে লাভ হচ্ছে দুইটা।
এক. এতে করে রবীন্দ্রনাথ, যিনি কিনা আবার অমুসলিম তাঁকে চোর উপাধি দিয়ে তাঁর সৃষ্টি এবং সম্মানকে বিতর্কিত করা যায়।
দুই. এতে করে চুরির অপবাদ দিয়ে আমাদের জাতীয় সংগীতকে কলুষিত করে পরিবর্তন করিয়ে দেয়ার অসৎ উদ্দেশ্যও চরিতার্থ করা যায়।

আমাদের কথিত পণ্ডিত প্রগতিশীলরা বুঝে হোক আর না বুঝেই হোক এই বিভ্রান্তির ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের অতি পাণ্ডিত্য দেখানোর নামে আমাদের জাতীয় সংগীতকেই যে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছেন, সেটা কি জানেন?

এখন আসি রবীন্দ্রনাথকে কিসের বলে 'চোর' দাবি করা হচ্ছে!

গগন দাস (যিনি গগন হরকরা নামেই বেশি পরিচিত) রচিত "আমি কোথায় পাবো তারে" শীর্ষক বাউল গানটির সুর রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছিলেন তাঁর রচিত "আমার সোনার বাংলা" গানে। দাবি করা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ গগন হরকরার এই সুর চুরি করে তাঁর গানে ব্যবহার করে গগন হরকরাকে ঠকিয়েছেন! যেহেতু রবীন্দ্রনাথ জমিদার ছিলেন এবং তাঁর সৃষ্টির কথা সবাই জানতো, পক্ষান্তরে গগন দাস অপরিচিত একজন বাউল, তাই এই সুর নিজের নামে চালাতে রবীন্দ্রনাথের সমস্যা হয়নি। সেই বিচারে রবীন্দ্রনাথ চোর!

হাস্যকর এমন কুযুক্তি শুনে প্রশ্ন জাগে, রবীন্দ্রনাথ কি কোথাও বলেছেন যে "আমার সোনার বাংলা" গানের সুরকার তিনি নিজেই? বরং বিভিন্ন ভাবে তিনি গগন হরকরার কথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলে গেছেন নানান জায়গায়। এমনকি রবি ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায়ও গগন হরকরার কথা, তাঁর "আমি কোথায় পাবো তারে" গানের কথা, এমনকি এই গানের সুর নিয়ে "আমার সোনার বাংলা" গানে সুরারোপ করার কথাও উল্লেখ পাওয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথের বেশকিছু গানে নানান প্রচলিত গানের সুরের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় কথাটি মিথ্যা নয়। রবীন্দ্রনাথের আরেকটি গান "যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক"-এর সুরের ভিত্তি ছিল গগন হরকরার "ও মন অসাড় মায়ায় ভুলে রবে" গানটি।

শুধু তাই নয়, রবি ঠাকুরের অনেক গানে বিদেশী সুর পাওয়া যায়। তিনি 'কালমৃগয়া' নামক গীতিনাট্যটি রচনা করেন কয়েকটি বিদেশী গানের সুর থেকে। তাঁর বেশ কিছু গান যেমন, 'সহে না যাতনা', 'প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন', 'হল না হল না সই' সহ আরো অনেক গানের সুর দিয়েছিলেন রবি ঠাকুরের বড় ভাই জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ফিরে আসি গগন হরকরা প্রসঙ্গে। অধ্যাপক মনসুর উদ্দিনের "হারামণি" গ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, "শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখাসাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা হত। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাত-সারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে বাউলের সুর ও বাণী কোন -এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে। আমার মনে আছে, তখন আমার নবীন বয়স, শিলাইদহ অঞ্চলেরই এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিল—

আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে!
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে
দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে"

শুধু তাই নয়, রবি ঠাকুর তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতা-প্রবন্ধেও গগন হরকরার কথা বলেছেন কয়েকবার। গানের সুর কখন, কোথায়, কীভাবে ব্যবহার হয়েছে তার উল্লেখ আছে অনেক জায়গায়।

এতো স্বচ্ছতা থাকা সত্বেও যখন কেউ বলে রবি ঠাকুর গগন হরকরার সুর 'চুরি' করেছেন, তখন স্বাভাবিক অর্থেই বুঝতে হবে হয় সে রবীন্দ্র-বিদ্বেষী, নতুবা সে কিছুই জানে না। এই সাধারণ বিষয়গুলো জানতে পণ্ডিত হতে হয়না। ইন্টারনেটের যুগে খুব সহজেই এসব তথ্য পাওয়া যায়। রবি ঠাকুরের রচনা সংক্রান্ত অনেক আলোচনা-নির্ভর গ্রন্থ আছে বাজারে যা থেকে খুব সহজেই যাচাই করে নেয়া যায় এসব তথ্য। এরপরও যাদের ঘুম ভাঙে না, তাদের ঘুম আর কোনদিন ভাঙবে বলেও মনে হয় না।

আমি রবীন্দ্র মৌলবাদী নই। কিন্তু ভুল তথ্য দিয়ে একজন জ্ঞানী মানুষকে তিরস্কার করলে বুকের মধ্যে ঘা লাগে। কষ্ট হয়। আর শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনা মানুষ যখন ঐসব ভুল তথ্যকে পুঁজি করে তর্ক করতে আসে, রবীন্দ্রনাথকে ওজন করতে আসে, তখন ঘেন্না লাগে। সত্যিই ঘেন্না লাগে।

দেবজ্যোতি দেবু, সংস্কৃতি কর্মি, অনলাইন এক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ