প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আব্দুল্লাহ আল নোমান | ২৪ জুন, ২০১৫
মানব ইতিহাস সংগ্রামের। আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত এক শ্রেণী আরেক শ্রেণীর উপর চালিয়েছে অকথ্য নির্যাতন। বর্তমান ইউরোপের যে চাকচিক্য তার পেছনে আছে অন্যান্য সমাজের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপ যখন তাদের উন্নয়নের দিকে যায় তখন তারা ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়া বা প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রয়োজন অনুসারে জোর জবরদস্তি করে শিল্পের জন্য কাঁচামাল ও কাজ করার জন্য দাস নিয়ে যেত। নিজেদের ইচ্ছামতো তাদের কাজে লাগাতো।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে দেখতে পাই এ ব্যবস্থার নব্য রূপ। কথিত উন্নত জীবনের আশায় মানুষ কিভাবে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে দালালদের দৌরাত্ব্যে অপেক্ষাকৃত উচ্চ আয়ের দেশে পাড়ি জমাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সম্প্রতি মালয়েশিয়া গমনের উদ্দেশে যাত্রা দেওয়া মানুষের লাশ গণকবর থেকে উদ্ধার হওয়া যেন আমাদের সেই অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) বলছে, মিয়ানমার ও থাই সীমান্তে সম্প্রতি ১৩৯টি গণকবর পাওয়া গেছে। এসব গণকবরের অধিকাংশ লোক মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও বাকিরা বাংলাদেশের নাগরিক। মূলত বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অধিকাংশই ভারত, মালয়েশিয়াসহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছে। যারা যাচ্ছে তারা হারাচ্ছে সর্বস্ব, দালালরা হচ্ছে বিত্তের মালিক। সম্প্রতি বাংলাদেশ হতে গমন করা লোকদের নদীপথে মালয়েশিয়ায় গমনের ফলে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড সীমান্ত থেকে গণকবর থেকে লাশপ্রাপ্তির ঘটনায় যে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে তার প্রেক্ষিতে এই লেখা।
নেপথ্যে: পাচার হওয়া অধিকাংশই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা যারা মিয়ানমারের রাখাইনের (পূর্বে আরাকান) বাসিন্দা। রোহিঙ্গারা এ রাজ্যে বসবাসকারী ইন্দো-অ্যারিয়ান জনগোষ্ঠীর একাংশ, যাদের ভাষা রোহিঙ্গা। এরা ষোল শতক থেকে রাখাইনে বাস করে আসছে। মিয়ানমার সরকার তাদের সরকারিভাবে অস্বীকার করছে, উপজাতির তালিকা থেকে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে তারা খাদ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি, সামাজিকভাবে অধিকারবঞ্চিত। ফলে তারা উন্নত জীবনের আশায় পাড়ি জমাচ্ছে মালয়েশিয়ার মতো দেশে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে পারি। বাংলাদেশের রেমিটেন্সের হিসাব থেকে দেখা যায়, ২০১৫ সালের মার্চে ১৩৩ কোটি ৮ লাখ ডলারের বেশি অর্থ এসেছে বাংলাদেশে যা ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে রেমিট্যান্স থেকে ১২ কোটি ডলার বেশি। সাম্প্রতিক সূচকগুলোতে দেখা যাচ্ছে, দেশের দারিদ্রের হার ১৯ শতাংশে এসেছে, যা ২০০৫ সালে ছিল ৪০ শতাংশের বেশি। অতি দারিদ্রের হার ২৪ শতাংশ থেকে কমে এসেছে ১১-১২ শতাংশে, যা দারিদ্র ও অতিদারিদ্র অর্ধেকে নেমে আসার কথা বলে। গত ৫-৬ বছর ধরে দারিদ্র নিরসনে গতি সঞ্চার হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রবাসী জনসংখ্যার হার বা এর প্রবণতা বাড়ছে। ফলে যে জনগোষ্ঠী এখনো দরিদ্র বা অতিদরিদ্র আছেন তারা জীবনের ঝুঁকি নিতে কুণ্ঠিত হচ্ছে না। কম পয়সায় দালালের মাধ্যমে তারা সাগর পাড়ি দিতে আগ্রহবোধ করছে। ফলশ্রুতিতে বাড়ছে অবৈধ উপায়ে দেশান্তর হওয়া।
১১ মে ২০১৫ তারিখের বিডিলাইভ২৪.কম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সুত্র হতে জানায়- অসাধু পুলিশ, কোস্টগার্ড এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অর্থের বিনিময়ে দালালদের সহযোগিতা করাসহ ৬টি কারণে মানব পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। সূত্রটি আরো জানায়, মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের আটক বা উদ্ধারের পর তাদের ভিকটিম হিসেবে ছেড়ে দেয়ার কারণে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার বাড়ছে।
বর্তমানে ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২’- এ পাচার হওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেওয়া, মালয়েশিয়ায় মানব পাচার করা ঘাট বা পয়েন্টসমূহে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহলের ব্যবস্থা না থাকা, গোয়েন্দা সংস্থা পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ডের স্থানীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাঝে অসাধু সদস্যরা পাচারকারীদের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়ে আটক না করে যাত্রীদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করা, পাচারকারীরা মাসিক ভিত্তিতে থানায় এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার বিজিবি’র বিওপিগুলোতে মাসোহারা দেওয়া প্রভৃতি কারণ ওঠে এসেছে। এছাড়া অশিক্ষা, বেকারত্ব, দারিদ্রতা ও জনসচেতনতার অভাবের কারণে পাচারের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। বেকার ও অপেক্ষাকৃত কম আয়ের মানুষরা কম খরচে মালয়েশিয়ায় পৌঁছে টাকা পরিশোধ করার প্রলোভনে এ সুযোগ নিতে চায়।
মানব পাচারের পরিসংখ্যান: দিন দিন বেড়েই চলেছে মানব পাচার। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) সংস্থার এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৯৪ সালের পর পৃথিবীতে শরণার্থীর সংখ্যা এখন যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। প্রতিবছর নানা কারণে সাড়ে চার কোটি লোক শরণার্থীর খাতায় নাম লিখাচ্ছে। এর মধ্যে সাড়ে নয় লাখ লোক বৈধ উপায়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিচ্ছে এবং দুই কোটি ৮৮ লাখ লোক নিজ দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে অন্য দেশে যাচ্ছে।
প্রতিবেদন হতে জানা যায়, সমুদ্রপথে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত হয়ে মাত্র এক বছরের ব্যবধানেই মানব পাচার বেড়েছে ৬১ শতাংশ। আরো বলা হয়, ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত মালয়েশিয়ার উদ্দেশে বঙ্গোপসাগর দিয়ে অবৈধভাবে গেছেন ৫৩ হাজার লোক। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৩ হাজার। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) গবেষণায় দেখা গেছে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৩ লাখ নারী ও শিশু ভারতে পাচার হয়েছে।
সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে দেশ থেকে প্রায় ৫ লাখ নারীকে নানাভাবে পাচার করা হয়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার নারী ও শিশু ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়ে থাকে।
যেসব স্থান দিয়ে মানব পাচার: বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্ট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে স্থলপথে ভারতের মতো দেশে এবং সাগরপথে মালয়েশিয়ার মতো দেশে মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু সাগরপথে অপেক্ষাকৃত কম টাকায় যেতে পারার কারণে এ পথে পাচার সংখ্যা তুলনামুলকভাবে বেশি। দেখা যায়, কক্সবাজারের মহেশখালী, উখিয়া, ইনানী, টেকনাফ প্রভৃতি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ সমুদ্রে নেমে বিপদে পড়ছেন। কক্সবাজারে দীর্ঘদিন ধরে মানব পাচারে জড়িত রোহিঙ্গাসহ ৩ শতাধিক স্থানীয় ও বহিরাগত দালাল বিপুল টাকার মালিক হয়েছেন।
পাচারকারীরা বাংলাদেশের সাথে ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকা ব্যবহার করে মানব পাচার করে থাকে। উত্তরের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী ও চাপাইনবানগঞ্জ জেলার সীমান্ত দিয়ে নারী ও শিশুদের পাচার করা হয়। ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমা সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য যশোরের বেনাপোল সীমানা অত্যন্ত সহজ রুট।
যশোর থেকে পাচারকারীরা ভোমরা কলোরোয়া, দর্শনা জীবননগর ও ঝাউডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে নারী ও শিশু পাচার হয়ে থাকে। দক্ষিণ-পশ্চিমের সীমান্তবর্তী ফরিদপুর, নোয়াখালী, বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট, নড়াইল, কুষ্টিয়া, যশোরের ঝিকরগাছা, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আইন ও করণীয়: মানব পাচার আইন ২০১২ এর বিভিন্ন ধারা বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাওয়া যায় মানব পাচারকারী অপরাধী হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ও সর্বনিম্ন শাস্তি ৫ বছরের কারাদণ্ড। পাশাপাশি বিভিন্ন অনুপাতে অর্থদণ্ড। পাচার হওয়া ব্যক্তি অপরাধী হলেও কোন শাস্তি পায় না। এভাবে আইনের ফাঁক গলে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে সব ব্যবস্থা নিতে হবে। আন্তঃদেশীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ এই সমস্যা সমাধানে ভাবতে শুরু করেছে। ২৯ মে ২০১৫ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে মানব পাচার ও অবৈধ অভিবাসন সমস্যা মোকাবেলায় বৈঠকে অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশন্স (আসিয়ান)- এর সদস্য রাষ্ট্রসহ ভারত মহাসাগরে অবৈধ অভিবাসন সমস্যায় আক্রান্ত ১৭টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা মানব পাচার ঠেকাতে ও সংকট উত্তরণে ১৭ দফা প্রস্তাব ও সুপারিশ করেছে। সম্মেলনে বাংলাদেশ ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার প্রতিনিধিরা দেশের অবস্থান তুলে ধরে অভিবাসীদের মানবিক সহায়তা প্রদানে তাদের অঙ্গীকারের কথা বলেন। বৈঠকে অবৈধ অভিবাসন ও মানবপাচারের কারণগুলোর সমাধান ও ঝুঁকিতে থাকা সম্প্রদায়ের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে উন্নয়ন ও মানবিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রচেষ্টা জোরদারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া মানব পাচারের মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধ দমন করা সম্ভব নয় বলে ঐক্যমতে পৌঁছেছেন বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, অষ্ট্রেলিয়া, নেপাল, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডের ৩৫ বিশেষজ্ঞ পুলিশ। ২০১৫ সালের জুনের প্রথমদিকে ঢাকায় দু’দিনব্যাপী এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে তারা এই সহমত পোষণ করেন।
২০১৫ সালের ২৭ মে বাংলামেইল২৪ডটকমের এক খবরে বলা হয়, সম্প্রতি শত শত বাংলাদেশি অবৈধভাবে সাগর পথে মালয়েশিয়া পাচারের ঘটনা ও থাইল্যান্ডের গহীন অরণ্যে পাচারকৃত বাংলাদেশিদের গণকবরের সন্ধান পাওয়ায় উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ সরকার। এই অমানবিক ঘটনা ঠেকাতে এবং দেশের শ্রম সেক্টরের ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখতে মানব পাচারের মতো অপরাধ বিচারের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে মানব পাচারকারীদের বিচারের জন্য সাত বিভাগে সাতটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে।
মানব পাচার আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটানো, সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা, সার্ক ও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় মানব পাচার রোধে একযোগে কাজ করা, জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গাসহ সব ভাসমান মানবগোষ্ঠীর বৈধ অভিবাসনের ব্যবস্থা করা এবং জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা ও নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে পারলে এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব কিছু নয়। পাশাপাশি এ সমস্যা সমাধানে সরকারকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসতে হবে সকল রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন, সিভিল সোসাইটি, গণমাধ্যম ও সর্বোপরি দেশের সাধারণ জনগণকে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য