আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

মনের মিলনই হোক দাম্পত্য জীবনের মূল ভিত্তি

দেবজ্যোতি দেবু  

আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে আত্মহত্যা সমর্থন করি কি না, আমার উত্তর হবে না, করি না। জোর দিয়েই বলছি করি না। আমি জীবনটাকে বড্ড ভালোবাসি। আমার জীবনের সাথে জড়িত মানুষগুলোকে বড্ড ভালোবাসি। আমি আমার দেশকে ভালোবাসি, ভালোবাসি আমার সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক চর্চাকে। ভালোবাসি শরতের স্নিগ্ধ আকাশ, বর্ষার মেঠো পথ, বসন্তের পাতা ঝরা দিন। এমন বৈচিত্র্য ছেড়ে কে পালাতে চায় বলুন?

তবুও মানুষ আত্মহত্যা করে! কেন করে? চিকিৎসকেরা বলেন, বেশিরভাগ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে মানসিক অসুস্থতার কারণে। যার মধ্যে বিষণ্ণতা অন্যতম। এর বাইরেও কিছু তুচ্ছ কারণ আছে যেগুলোকে ইতিবাচক মানসিকতার কোন মানুষই মেনে নেন না, নিতে পারেন না। কিন্তু কোন চিকিৎসকই যদি আত্মহত্যা করে বসেন, তখন?

সম্প্রতি মোস্তফা মোরশেদ আকাশ নামের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক স্ত্রীর উপর অভিমান করে আত্মহত্যা করেছেন। এ নিয়েও ভার্চুয়াল জগতে দু'টি পক্ষ তৈরি হয়ে গেছে। কেউ বলছেন আকাশ ভুল করেছেন, কেউ বলছেন আকাশের স্ত্রী মিতুর কারণে আকাশ আত্মহত্যা করেছেন। মানে মিতুই খারাপ। কিন্তু কেউ বলছেন না আত্মহত্যা করা খারাপ। কেউ বলছেন না আমাদের সনাতনী সামাজিক ব্যবস্থাই খারাপ। কেউ প্রশ্ন তুলছেন না বৈবাহিক জীবনে সুখী না হলে কেন কেউ সহজে আলাদা হয়ে যেতে পারবে না? কেন দেনমোহরের চাপে পড়ে একজন মানুষকে দিনের পর দিন মরে মরে বাঁচতে হবে? দেশে আইন আছে, আদালত আছে। তবুও কেন একজন মানুষের কাছে আইনের দ্বারস্থ হওয়ার চেয়ে আত্মহত্যাকেই সহজ সমাধান বলে মনে হবে?

আকাশ আত্মহত্যা করে ভুল নয়, অপরাধ করেছেন। দেশের প্রচলিত আইনেও এটা অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত হয়। পাশাপাশি মিতুও অপরাধ করেছেন দাম্পত্য জীবনে পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গায় ভাঙন ধরিয়ে। আকাশকে পছন্দ না হলে তিনি বিয়ে না করলেও পারতেন। আকাশও পারতেন দাম্পত্য কলহের অবসান করতে আইনের দ্বারস্থ হতে। তারা উভয়েই তা করেননি। মানে নিজ নিজ দায়িত্বে তাদের দু'জনেরই অবহেলা ছিল, ছিল পরস্পরের প্রতি অশ্রদ্ধাও। তাই বলে কি এমন মৃত্যু যৌক্তিক হয়ে যায়? হওয়া উচিত?

আকাশ তার ফেইসবুক পোস্টে জানিয়েছিলেন, বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়ে তিনি তার স্ত্রীকে বারবার বলার পরও তার স্ত্রী তাতে রাজি হচ্ছিলেন না। শোনা যায় দেনমোহরের ৩৫ লক্ষ টাকা পরিশোধের ভয়ে আকাশও নিজে থেকে তালাক দিতে পারছিলেন না। কারণ এতো টাকা পরিশোধ করার ক্ষমতা উনার ছিল না। তখন প্রশ্ন জাগে, যে অংকের টাকা পরিশোধের ক্ষমতা উনার নেই সেই অংকের টাকা তিনি দেনমোহর হিসেবে দেয়ার প্রতিশ্রুতিই বা কেন দিয়েছিলেন?

দেনমোহর আইনেতো বলাই আছে, নিজের আর্থিক সচ্ছলতার উপর ভিত্তি করেই দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণ করার কথা। তাহলে তিনি কেন এতো টাকার দায় নিলেন কাঁধে? মিতুও কেন আকাশের সাথে বিচ্ছেদে রাজি হচ্ছিলেন না? আকাশ ছাড়া অন্য কাউকে যদি তিনি ভালোবেসেই থাকেন তাহলে কেন আকাশের সাথে সম্পর্ক ছেদ করে তার প্রেমিককে বিয়ে করলেন না? দেনমোহরের লোভে? যদি তাই হয় তাহলে এই আত্মহত্যার জন্য মূলত দায়ী কে? মিতু, আকাশ নাকি দেনমোহরের ঐ বিশাল অংকের টাকা?

যারা পরকীয়াকে দায়ী করে আত্মহত্যার সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন তারাও কিন্তু ঘুরে ফিরে আমাদের সমাজের সনাতনী ধ্যান ধারণাকেই জিইয়ে রাখার চেষ্টাতেই এমনটা করছেন। নারী-পুরুষকে একসাথে থাকতে হলে সামাজিক নিয়ম অনুযায়ী বিয়ে করতে হবে এবং সঙ্গ ত্যাগ করতে হলে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে হবে। সেজন্যও পুরুষকে গুনতে হবে বড় অংকের টাকা। কেন ভাই, হাজার বছর পুরনো এমন রীতিকেই কেন বর্তমান সময়ে সঠিক বলে মানতে হবে? কেন মানুষ নিজের ইচ্ছায় সঙ্গ গ্রহণ এবং ত্যাগ করতে পারবে না? কেন একজন নারী কিংবা পুরুষকে তার পছন্দ মত সঙ্গী খুঁজে নিতে সব সময় সমাজের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে? কেন বিয়ে নামক একটি সামাজিক চুক্তির কারণে দুটি মানুষকে সারাজীবন মরে মরে বেঁচে থাকতে হবে? সামাজিক এমন সনাতনী রীতি যদি সঠিক হয়ে থাকে, যদি বর্তমান সময়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে থাকে, তাহলে আকাশকে কেন আজ আত্মহত্যা করতে হলো? কেন আকাশদের আত্মহত্যা করতে হয়? এরজন্য কি সমাজের কোন দায় নেই?

আমাদের মানসিকতা এতোটাই পুরুষতান্ত্রিক যে, একজন পুরুষ যখন একাধিক নারী সঙ্গ পেতে চায় তখন সে একাধিক বিয়ে করলেও সেটা বৈধ! কিন্তু একজন নারী করলেই সেটা অবৈধ। একজন পুরুষ চাইলেই পতিতালয়ে যেতে পারে। কিন্তু একজন নারী চাইলে সে কূলটা, ব্যভিচারী! কেন? ধর্ষণ হলে মেয়ের দোষ, বিয়ে না হলে মেয়ের দোষ, স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করলে মেয়ের দোষ, এমনকি বিবাহ বিচ্ছেদেও মেয়েদেরই দোষ খোঁজা হয়! কেন ভাই, ছেলেদের কোন দোষ থাকতে নেই বুঝি? আকাশের আত্মহত্যার জন্য যেমন মিতুর দায় অস্বীকার করা যায় না, তেমনি এমন ভঙ্গুর বৈবাহিক সম্পর্ক জিইয়ে রেখে ধুঁকে ধুঁকে মরার জন্য আমাদের সামাজিক সনাতনী রীতিনীতি এবং আমাদের মানসিক দৈন্যতার দায়ও অস্বীকার করার কোন সুযোগ নাই।

শুধুমাত্র স্ত্রীর সাথে অন্য ছেলের প্রেমের সম্পর্ক থাকার কারণেই যদি আকাশের আত্মহত্যা করা জায়েজ হয়ে যায়, যদি মিতু সেক্ষেত্রে অপরাধী হয়ে যায়, তাহলে একবার ভেবে বলুন তো যেসব পুরুষ একাধিক নারীকে বিয়ে করে সংসার করেন তার সংসারে নারীদের মানসিক অবস্থাটা কেমন হয়? তাদের সবারই কি এভাবে আত্মহত্যা করে মনের জ্বালা মেটানো উচিত নয়? পুরুষের বেলায় যা সঠিক মনে হয়, নারীর বেলায় সেটাকেই কেন দোষ বলে বিবেচনা করা হবে?

কে দোষী আর কে নির্দোষ, সেই বিতর্কের সমাধান আমি জানি না। আমি সেদিকে যাবও না। আমি শুধু বলতে চাই, আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রয়োজন সামাজিক রীতিনীতির সংস্কার। দাম্পত্য কলহ, নির্যাতন, আত্মহত্যা বন্ধের জন্য বিয়ে নামক 'চুক্তি' থেকে বের হয়ে আসা জরুরী। যে চুক্তি কারো জীবন বাঁচাতে পারেনা, কাউকে সুখী করতে পারেনা, সেই চুক্তির কি প্রয়োজন? আর যদি এই চুক্তি না রাখলে সমাজের মর্যাদা নষ্ট হয় বলে মনে করেন, তাহলে এই বিবাহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদ নামক এমন চুক্তিপত্রের আইনি এবং সামাজিক সংশোধন করুন। চুক্তি নয়, বরং মনের মিলনই হোক দাম্পত্য জীবনের মূল ভিত্তি।

দেবজ্যোতি দেবু, সংস্কৃতি কর্মি, অনলাইন এক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ