আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ভালোবাসা কারে কয়

সঙ্গীতা ইয়াসমিন  

আজ চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইন ডে! বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবেই সমধিক পরিচিত যে দিন! একসময় যাকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অংশ বলে নাক কুঁচকিয়েছি,আজ মুক্তবাজার অর্থনীতির কল্যাণে তা ই আমাদের ঘরের অতি আদরের সন্তান! গ্লোবাল ভিলেজের অংশ হিসেবে এখন আমরাও কর্পোরেট বাণিজ্যের হাতের পুতুল। ফলে, দেশজ সংস্কৃতির না হলেও অনেক উৎসবকেই আমরা আত্মীকরণ করে নিয়েছি, ভালোবাসা দিবস তথা ভ্যালেন্টাইন ডেও তেমনই এক বিশেষ দিবস! এই দিবসের মূল উৎপত্তি আর ভিত্তি যাই হোক না কেন,আজকের দিনে এই দিবসের মর্ম আলাদা করে বলার কিছুই নেই, শুধু ভালোবাসাবাসিই এর মহত্তর উদ্দেশ্য।এই উৎসবকে ঘিরে আবালবৃদ্ধবনিতা সাজে নতুন সাজে, প্রেয়সীর মনে লাগে নতুন রঙ, প্রকৃতিও যেন সাজে স্বপ্নিল বর্ণে, পহেলা ফাল্গুনের একদিন পরেই যেহেতু এই ভালোবাসা দিবস উদযাপিত হয় সে কারণে প্রকৃতির সাথেও এর একটা যোগসূত্র আছে বলেই মনে হয়! তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, যাকে ঘিরে এত আয়োজনের পসরা আদতে সেই ভালোবাসা বস্তুটি কী? কোথায় তার বাস? এক জীবনে তার দেখা মেলে কি? নাকি তার খোঁজেই আমাদের যাপিত জীবনের একটা বড় সময় চলে যায়, দ্বিধা-সংশয় নিয়েই আমরা খুঁজে বেড়াই তাকে, ডাকি নানা নামে, তবুও রয়ে যায় সে অচেনা, রয়ে যায় অধরা!

আমাদের যাপিত জীবনেও থাকে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের ভালোবাসার গল্প;কারও জীবনে ভালোবাসা আলো জ্বালে, আবার কারো চোখের সবটুকু আলো কেঁড়েও নেয় সেই ভালোবাসা।কেমন করে জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকে নানা রঙের ভালোবাসা সে কথাই বলব আজ গল্পে গল্পে!


রোকেয়া বেগম, আমাদের সকলের রুকু বুজি! সায়েরা খালার সুন্দরী মেধাবী কন্যা, দুধে আলতা রঙ, মেঘ কালো কেশ, দীর্ঘাঙ্গি। গরীবের ঘরে যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক রাজকন্যা। তবুও কালু মাঝির চিন্তার অন্ত নেই! কীভাবে এই আগুন সে ঘরে রাখে, কন্যাটি সাবালিকা হয়ে উঠেছে, তাকে বিদায় করা দরকার।কালুমিয়ার অর্থসম্পদ নেই, ভালো ঘরে বিয়ে দেবার সামর্থ্য নেই। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।পাড়াতো ভাই মহিম, মেম্বারের ছেলে, মাঝে সাঁঝে রোকেয়াকে পড়া দেখিয়ে দেয়। এতে প্রাইভেট টিউটরের খরচটা বেঁচে যায়। মহিম রোকেয়াকে বোনের চোখেই দেখে।যদিও মহিমের পড়ানোর ব্যাপারে সায়েরা খালা প্রথমে আপত্তি ছিল, পরবর্তীতে মহিমের অতিমাত্রায় ভদ্রতা আর মার্জিত আচরণে সায়েরাবানুও মুগ্ধ হয়ে যায়।রোকেয়াদের কাচারি ঘরেই ওদের চলে রোজকার পঠনপাঠন! হঠাত একদিন রোকেয়াবুর ভীষণ জ্বর এলো, সাথে মাথাধরা, রক্তবমি! বুজি আর স্কুলে যায় না। দিন সাতেক পরে কাকাডাকা ভোরে নানীজানের দরোজায় সজোরে জোরে করাঘাত। ধড়ফড় করে উঠে বিছানায় চোখ রগড়াতে রগড়াতে শুনলাম রোকেয়া বুজি আর নেই। গতকাল থেকে তার ঘরের দরোজা বন্ধই ছিল। ভেতর থেকে কেবল হু হু কান্নার আওয়াজ শোনা গিয়েছিল। আজ ভোর ভোর নাগাদ আর কোনো শব্দ না পেয়ে দরোজা ভাঙা হল।সিলিংয়ে ঝোলানো অচেতন, নীলাভ রোকেয়াবুজিকে নামানো হল। নানীজানের সাথে আমিও রোকেয়া বুজির মরণ দেখতে সফরসঙ্গী হই। ঘরভর্তি বয়স্ক নারীদের নীচুগলায় ফিসফাস শব্দে একটা মৃদু ভুতের বাতাসের গন্ধ পেলাম। গোসলের নানী বললেন, বাতাস লাগছিল, তেঁতুল তলাত গেছিল মাইয়াটা, বহুত রক্ত ভাঙছে, হইব না! তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা যে। শব্দটি সেই প্রথমবার শুনেছিলাম! মানে না জানলেও অনুমান করেছিলাম, যে কারণে রোকেয়া বুজিকে ইহজগতের মায়া কাটিয়ে চলে যেতে হল সেটি আর যা-ই হোক খুব ভালো কিছু নয়! তবে, এইটুকু বুঝিনি সেদিন অন্তঃসত্ত্বার সাথে ভালোবাসারও সম্পর্ক থাকে!


মিথিলা আর রাতুলের ঠিক প্রেম-পরিণয়ে যৌথবাস না হলেও নিতান্তই অ্যারেঞ্জড ম্যারেজও ছিল না।দুজন-দুজনের পরিচিত, অল্প-বিস্তর জানাশোনাও, অতঃপর বিয়ে! যদিও দুই পরিবারের অমতে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল তাঁদের।হয়তো ভুলটা ছিল সেখানেই! দু’জনের বেড়ে ওঠা, জীবন দর্শন, বোধ, সামাজিকতা সবই দুই মেরুতে অবস্থান, আর স্বল্প সময়ে যা বোঝার সুযোগও কম ছিল।বিয়ের পরে নিজেরা নিজেদেরকে বুঝে ওঠার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করতে হয় দুপক্ষের পরিবারের প্রত্যাশা-প্রাপ্তিতে।এতে করে নিজেরাই নিজেদেরকে বঞ্চিত করে। তৈরি হয় দূরত্ব,অভেদ্য কাঁচের দেয়াল। মেয়েদেরকেই ছাড় দিতে হয় সবক্ষেত্রে,মিথিলা দিয়েছিলও তাই।রাতুলের অবস্থান ছিল একেবারেই টিপিক্যাল পুরুষের জায়গায়।মিথিলা সুন্দরী না হলেও শিক্ষিতা,একটি বিদেশী কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, স্বাভাবিকভাবেই তাঁর আত্মসম্মান জ্ঞান টনটনে।বিয়ের আগের আর পরের রাতুলকে তাঁর অচেনা মনে হতে থাকে।তবুও চেষ্টা করে যায়, হাল ছাড়ে না।সর্বশেষ আঘাত আসে তখন, যখন মিথিলার কাছে স্পষ্ট হল, রাতুলের শারীরিক অক্ষমতা! অনেক কৌশল করে, ইনিয়ে-বিনিয়ে মিথিলা রাতুলকে সেই বিষয়টি বলার চেষ্টা করে, রাতুলের পুরুষ ইগো কিছুতেই মেনে নিতে চায় না। উল্টো এতোটাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে যা সম্পর্কের মাঝের কংক্রিটের সুউচ্চ দেয়াল তুলে দেয়।শত চেষ্টাও সেই দূরত্ব ঘোচাতে পারেনি মিথিলা। কোনোরূপ চিকিৎসার কথাও রাতুল কানে তোলেনি।ততদিনে ওদের সংসারে সন্তান আসে।সন্তানকে ফেলে মিথিলার আর কোথাও যাওয়া হয় না।বিবাহের সনদ মাথায় নিয়ে মিথিলা কাটায় দাম্পত্য সুখবিহীন দীর্ঘ অযৌন-জীবন! দীর্ঘ এই অসহনীয় পথের সাথী হয় না ঘুমানো চোখের মণি, রাতের তারারা, ভেজা বালিশের সমুদয় নরোম শরীর!সমাজের চোখে রাতুল-মিথিলা তবুও খুব সুখি দম্পতি!


দিলারা-সাত্তারের বিয়ে হয়েছিল আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে।সাত্তার খানের বয়সের দূরত্ব দিলারা বেগমের থেকে মাত্র পনের বছর। একজনের ২০ আরেকজনের ৩৫। যৌবুন্নেচ্ছার কেস-মামলার মধ্য দিয়ে ধ্বসে যেতে যেতে একখানি বিধবার সংসার বাঁচিয়ে রেখেছিল সাত্তার খান, সে কেবল দিলারার প্রেমের আগুনেই পুড়ে পুড়ে।আর সেই থেকেই দিলারার মা যৌবুন্নেচ্ছা খানম সাত্তারকে কথা দিয়েছিল সে তাঁর মনের আশা পূরণ করবেই। যে তাঁর বিষয় আশয় উদ্ধার করে দিয়েছে, তাঁকে সে বঞ্চিত করবে না। দিলারার আপত্তি থাকলেও পিতৃহীন পরিবারে মায়ের ওপর কথা বলার সাহস ছিল না।ব্যস, হয়ে গেল বিবাহ।দিলারা তখন টগবগে যৌবনের ভারে উচ্ছল, চঞ্চল! সাত্তার চিরকালই ঘরছাড়া-বোহেমিয়ান! তবু আজ দিলারার মত রূপবতী যৌবনবতী এক তরুণীকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে জীবন ধন্য হয়েছে তাঁর।সে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে, বংশের প্রদীপের আশায় দিন গোনে। কোর্টের মহুরির কাজে আগের থেকে বেশি মনোযোগী হয়, দিলারাও সংসারে বাড়তি রোজগারের জন্য ঘরে বসেই টেইলার্সের কাজ করেন।দর্জিগিরি করতে গিয়ে দিলারার সাথে মীর কাশেমের পরিচয়, সেই পরিচয় থেকে একসময় হয় ঘনিষ্ঠতা।ঘনিষ্ঠতার মাত্রা যতটুকু হওয়া সম্ভব তার সকল আয়তন-ব্যাপ্তি ছাড়িয়ে কাশিম আর দিলারার জীবনেও হয়তোবা এসেছিল মধুবসন্ত! হঠাত একদিন খুব সকালে পাড়ার লোকের ঘুম ভেঙে যায় দিলারার অজস্র গালাগালসহ চিৎকারে!সচকিতে সকলেই অবলোকন করে সাত্তারের ঊর্ধ্বশ্বাসে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ছোটার নয়নাভিরাম দৃশ্য! সদর দরোজার বাইরে অবধি সাত্তারের পেছনে পেছনে দিলারা রাম দাও হাতে ছুটছে আর বলছে, “ বুড়ো ভাম! আমার জীবন যৌবন সব শেষ করে দিয়ে এসেছিস স্বামিত্ব ফলাতে? দিলারা তখন সন্তান সম্ভবা, কিছুদিন পরে সে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেন যার মুখচ্ছবি, গাত্রবর্ণ হুবহু মীর কাশিমের আদলেই।পাড়ার লোকে খুঁচিয়ে ঘা করার লক্ষ্যে সাত্তারকে জিজ্ঞেস করে, ও সাত্তার, তোমার বংশে তো এইরূপ গাত্রবর্ণ এমন ভোঁতা চেহারা নেই! তাইলে এই ছৈল কোত্থেকে আইল? সাত্তার উদাস দৃষ্টিতে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, সে আমি ক্যবা কইতাম, আল্লার মাল আল্লায়ই ভালো জানে!!


পঁচিশের উত্তুঙ্গু ফেনায়িত যৌবন আর নায়কোচিত চেহারা নিয়ে রিক্সা চালালেও হিরণের গর্বের কমতি নেই। সে তাঁর তিনচাক্কাকে কখনও রিক্সা ভাবে না, ভাবে গাড়ি। গাড়িখানকে অতি যতনে সাজিয়েছে, দামী সীট লাগিয়েছে সাথে রংবেরঙের ঝালর! একটা গান শোনার বাক্সও আছে, আছে লাইটও, রাত বিরেতে বিদ্যুতবিহীন রাস্তায় যাত্রী টানার সময় খুব কাজে দেয়,তার রিক্সাখান আবার ব্যাটারিতে চলে! অভাবের কারণে ক্লাস ফাইভ অবধি পড়লেও নিজের মেধা আর বুদ্ধি সম্পর্কে তাঁর হিসেব ষোলো আনাই পাক্কা। ট্রানজিস্টারের সাথে বাংলা সিনেমার গানে গলা মিলাইয়া মাথায় লাল ওড়না বেঁধে রংবাজ সেজে শহরময় ঘুরে বেড়ায়।

গলির মুখে পিটি আই ভবনের ভেতরেই নাসিমা বেগমের কোয়ার্টার। একমাত্র কন্যাকে নিয়ে বছর পাঁচেক তিনি এখানে বদলী হয়ে এসেছেন। ঊর্মি, নাসিমা বেগমের একমাত্র কন্যা, যাকে প্রতিদিন বাসের ভিড় ঠেলে পিটিআই কোয়ার্টার থেকে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে যেতে হয়, এতে কন্যার নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কায় নাসিমা বেগম উতলা হন। ঊর্মির বাবার বদলি চাকরি, বছর বছর স্কুল আর বন্ধু বদলের ঝক্কি উর্মি সামলাতে পারছিল না। অনেক তো হল, এবার থিতু হবার দিন।তাই, মায়েতে মেয়েতে মিলেই এই শহরে গাঁটছড়া বেঁধেছেন তাঁরা। হিরণ মিয়া পাশের বস্তিতেই থাকে। চেহারা-কথাবার্তায়, দেখেশুনে হিরণকে ভদ্র ছেলেই মনে হল নাসিমা বেগমের!সে ঊর্মিকে স্কুলে আনা-নেওয়া করার জন্য মাস কাভারি রিক্সা ঠিক করলেন হিরণ মিয়াকে।মাস দুয়েক পরে হঠাতই একদিন অফিসে সুপারেন্টেন্ডের কক্ষে নাসিমা বেগমের জরুরি টেলিফোন, রাজশাহী মেডিকেল থেকে।উর্মিকে ইউনিভার্সিটির কয়েকজন ছাত্র মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের এমারজেন্সীতে ভর্তি করিয়েছে, আপনি শীঘ্রই চলে আসুন। নাসিমা বেগম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন, প্রফেসর জানালেন, উর্মির দুটো চোখই নষ্ট হয়ে গেছে।এই সুন্দর পৃথিবী আলো আর দেখতে পাবে না, মুখের অবয়বও বীভৎস! ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে ঊর্মিকে। মা হয়ে একমাত্র কন্যার এই যন্ত্রণা কীভাবে সইবেন তিনি! বুক ভেঙে, চোখ ভেঙে অথৈ ধারারা বাধাহীন ধেয়ে এলো।হঠাতই মনে হল, হিরণের একটা খবর নেওয়া দরকার! না, কোথাও হিরণের টিকিটি আর মিলল না এই জন অরণ্যের শহরে! ঊর্মি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও এই বীভৎস মুখচ্ছবি আর আলোহীন জীবনের গ্লানি সইতে না পেরে কিছুদিন পরেই আত্মহত্যা করে। শুধু নাসিমা বেগম আজও পথ চেয়ে থাকেন, বীভৎস স্মৃতির পাঁজা কোলে নিয়ে, পুড়ে খাক হন, কেবল অপেক্ষার দিন গোনেন! মৃত্যুও ভালোবেসে কাছে ভিড়ছে না তাঁর!


বোন শিলার বন্ধু রুমকির সাথে রিফাতও বন্ধুর মতোই মিশেছে এতোটা কাল। মিশতে মিশতে একধরণের আস্থা-বিশ্বস্ততা, মায়া তৈরি হয়ে যায়; যাকে আর যা-ই হোক রুমকি কখনো ভালোবাসা মনে করেনি।তাই রিফাতের প্রবল বাসনায় লালিত ভালোবাসার প্রস্তাবে শুধু না-ই বলেনি, গোপন প্রেমপত্র শিলার হাতে দিয়ে আচ্ছা করে কথাও শুনিয়েছিল শিলাকে! যাতে সেও তাঁর দাদাকে রুমকির হয়ে বকে দেয়।শিলাও তেমনি, মাকে বলে রিফাতকে এমন ভৎসনা করালো যাতে লজ্জায়-ঘৃণায় রিফাত একদম বাড়ি ছাড়া! মা-ভাই-বোনের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল।এর বছর পনেরো পরে হঠাতই একদিন অফিসের কাজে রাঙ্গামাটিতে গিয়ে রিফাতের কথা জানতে পারে রুমকি! ভেতরে কেমন একটা মোচড় দিল।পুরোনো কথা মনে করে অপরাধবোধে কিছুটা বিব্রতও হল। যোগাযোগের চেষ্টা করল রিফাতের সাথে।অনেক মান-অভিমানের, প্রশ্নোত্তরের ঝাঁঝালো পর্ব পেরিয়ে দুজনেই দেখা করে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল। অবশেষে, প্ল্যানমাফিক অফিস ট্যুরে গিয়ে তাঁরা দেখা করল।একই হোটেলের পাশাপাশি কক্ষে বুকিং ছিল তাঁদের। সন্ধ্যায় আচম্বিতে দেখা হয়ে যাওয়ার মতো করেই হোটেলের ডাইনিং হলে দেখা হল, দুজনের রুম নম্বর, ফোন নম্বর বিনিময় হল! এবং তারপরে একটি রাত! অনন্ত স্মৃতি জাগানিয়া কাব্যময় একটি রাত! যে রাতে দুজন পূর্ণ-যৌবনা নর-নারী বহুদিনের জমানো আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা না পাওয়ার যাতনা, দীর্ঘ অদেখার আকুলতার গল্প করতে করতেই ঝর-জলে ভরা আলোহীন ঘন তমসার আঁধার মনের আলোতেই ভরে দিয়েছিল। সে রাতে দুজনই কেঁদেছিল অজর ধারায়।দুজনের মুখ, বুক এতোটা কাছে ছিল, একে অন্যের নিঃশ্বাসের শব্দও শুনতে পেয়েছিল! বুকের ডিবডিব আওয়াজেও নীরবতা ভাঙেনি তাঁদের, তাঁরা যেন একে অন্যকে স্পর্শের আকাঙ্ক্ষায়ই ব্যাকুল ছিল, জগতের আর কোনো খিদে, তৃষ্ণা, কাম-লোভ তাড়িত করেনি এই দুজনকে! জন্ম-জন্মান্তরের এমন প্রবল চাওয়া যাকে, সেই রুমকিকে বুকের মাঝে পেয়েও রিফাতের শরীরের কোনো অঙ্গই উদ্যত হল না আক্রমণের নেশায়। রিফাত সেদিন রুমকির চোখের জলের গভীর মায়ায় মিশে গিয়েছিল।পরের দিন রুমকি রিফাতকে জিজ্ঞেস করেছিল, “তোমার অন্যকিছু ইচ্ছে করেনি? রিফাতের সোজাসাপ্টা জবাব, করবে না কেন, ভালোবেসেই জয় করতে চেয়েছিলাম তোমায়! যা ভালোবাসা দিয়ে পাইনি, তা জোর করে আজ কেনো নেব? কেঁড়ে নেওয়ায় আনন্দ তো নেই কোনো!

কী আশ্চর্য নরোম সুরে জীবনের কঠিনতম সত্যটি বলে গেল!সে কোনো ছোট গল্পের হিরো নয়, এই সমাজেই বেড়ে ওঠা রক্ত মাংসের কাম-ক্রোধপূর্ণ ত্রিশোর্ধ এক যুবক! যখন আমাদের শিশু কন্যারা, বোনেরা, মেয়েরা, মায়েরা, ঘরে-বাইরে, স্কুলে-পাঠাগারে, মসজিদে-মক্তবে কোথাও নিরাপদ নয় শকুনের থাবার কাছে! রিফাত সেই সমাজেই পুরুষ প্রজাতিকে প্রতিনিধিত্ব করছে।একদিন চরমভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েও আজ জিতিয়ে দিয়েছে তাঁর ভালোবাসাকে, তাঁর বোধের কাছে ভালোবাসা হেরে গিয়েও জিতে গেছে।

বলা বাহুল্য নর-নারীর ভালোবাসায় এমন অশরীরী ভালোবাসার গল্প কল্পনাও করা যায় না।মানব-মানবীর আবেগঘন প্রেম বলতে আমরা কাম-বাসনা, মোহ-মাৎসর্য, লোভ-লালসার মূর্তমান এক চরম অস্তিত্বকেই অনুভব করি। আমাদের চারপাশের চলমান বাস্তবতায় সেই কাম-বাসনারা আরও কদর্য হয়ে ধরা দেয় আমাদের যাপিত জীবনে! যাকে ভালোবাসা বলেই ভ্রম হয়। এমন ভ্রমে সংশয়েই হয়তো গুরুদেব শুধিয়েছিলেন-
সখী ভাবনা কাহারে বলে,
সখী যাতনা কাহারে বলে
তোমরা যে বল দিবস রজনী ভালোবাসা ভালোবাসা
সখী ভালোবাসা কারে কয়!
সে কি কেবলই যাতনাময়...।।

এই সংশয়ের বাণীর ভেতরেই আজ আপন আলোয় নিজেদের দেখবার দিন এসেছে।পত্রিকার পাতা ওল্টালেই যে দেশে শিশু ধর্ষণের খবর বের হয়, রেহাই মেলে না স্বয়ং পিতার হাত থেকেও, সেই সমাজে সেই দেশে ভ্যালেন্টাইন ডে, কিংবা ভালোবাসা দিবসের আলাদা কোনো মাহাত্ম্য আছে কি? কী বারতা বয়ে আনে এই দিবস আমাদের জীবনে? গুরুদেবের সুরে সুর মিলিয়ে আমারও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে- “আহা ভালোবাসা কারে কয়, সে কি কেবলই শরীরময়? সে কি ত্রিকোণ যোনীতেই রয়?

সঙ্গীতা ইয়াসমিন, কানাডা প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ