টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
অসীম চক্রবর্তী | ২৫ জুন, ২০১৫
আইসিসি ট্রফিতে খেলার আগে এসিসি ট্রফি নামে একটা টুর্নামেন্ট হতো এশিয়ার সকল 'নালায়েক' ক্রিকেট টিম নিয়ে। সেই খেলা কোনদিন ও টিভিতে দেখাতো না। রেডিওতে নেপাল, জাপান ইত্যাদি দেশের বিরুদ্ধে আমাদের আকরাম, বুলবুল, শান্ত, নান্নু, আতাহার, রফিক, আনিস, ফারুক, সুজন, পাইলট, এনামুল মনিদের খেলা শুনতাম আর মনে মনে ভাবতাম একদিন আমরাও...!
আইসিসি ট্রফিতে বারবার কেনিয়া জিম্বাবুয়ে আমাদের ঠেকিয়ে দিচ্ছিল। কোনোমতেই আমরা এগুতে পারছিলাম না বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মহাযজ্ঞের দিকে। আমার এক কাকা আছেন। তিনি মনে মনে ঘোর সমর্থক কিন্তু আমাদের সামনে ভ্রুকুটি করতেন আমাদের আকরাম বুলবুল গোল্লাদের। উত্তরে কিছুই বলার থাকতো না।
অবশেষে ১৯৯৭ সালে আসলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সেবার আইসিসি ট্রফিতে একুশটি দল অংশ গ্রহণ করেছিলো- বাংলাদেশ, কেনিয়া, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, হংকং, বারমুডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফিজি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাপুয়া নিউ গিনি, সিঙ্গাপুর, নামিবিয়া, মালয়েশিয়া, পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকা, পশ্চিম আফ্রিকা, জিব্রাল্টার, আর্জেন্টিনা, ইসরায়েল/ ইতালি।
গ্রুপ পর্বের খেলা শেষে প্রথম সেমিফাইনালটি হয়, আয়ারল্যান্ড এবং কেনিয়ার মধ্যে। যেখানে কেনিয়া, আয়ারল্যান্ডকে ৭ রানে পরাজিত করে। দ্বিতীয় সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ এবং স্কটল্যান্ড। যেখান থেকে নাটকীয় ভাবে পাইলট ৭০ রানের ইনিংস খেলে উড়িয়ে দেন স্কটিশদের।
সামনে শুধুই ফাইনাল আর সেই ফাইনাল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী কেনিয়ান সিংহরা। আমাদের সময়ে বাংলাদেশের জন্য ত্রাস ছিলেন কেনিয়ার স্টিভ টিকলো, মরিস অদুম্বে, তনয় মিশ্র, রবিন্ধু শাহ, কেনেডি অটিয়েনো, সুজি ভ্রাতৃদ্বয়, আর স্পিনার আসিফ করিম।
ফাইনালের দিন রেডিও নিয়ে বসে আছি কখন চৌধুরী জাফর উল্লাহ শরাফত, খোদা বক্সরা তাদের বাক্স খুলবেন সুদূর মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে। অবশেষে খেলা শুরু হল। দুর্দান্ত ব্যাটিং করে চলেছে কেনিয়া আর অন্যদিকে কাকু স্লেজিং করে যাচ্ছেন আমাদের। নিখাদ সিলেটী ভাষায় "কটাই মজরের ফুয়াইন গেছইন খেলাত, বাদামর ছুটে এড়এড়ি ডাকের, একলা স্টিভে যতো রান খরের ঔ রান উ খরত ফারতো নয় বাংলাদেশর হক্কলটিন্তে।
ম্যাচে স্টিভ টিকোলোর ১৪৭ রানের সুবাদে কেনিয়া ২৪১। তখন ২৪১ রান ছিলো আমাদের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যে বৃষ্টি দিলো বাগড়া। ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারিত হলো ২৫ ওভারে ১৬৬। গলদঘর্ম হয়ে শেষ বল অবধি খেলে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হলো বিশ্ব ক্রিকেটে। প্রাণ খোলে মিছিল দিয়েছিলাম গ্রামের রাস্তায়। গ্রামের লোকেরা জানতই না মিছিল কেনো হচ্ছে। তবে ভালো কিছু যে হয়েছে সেটা তারা আঁচ করেছিলো নিঃসন্দেহে।
এর পরের কয়েক বছরের ইতিহাস খুব একটা সুখকর ছিলো না। তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠানামা করা বানরের মতো আমরা উঠার চেয়ে নামছিলাম বেশি। পারবেনা জেনেও পাশে থেকেছি। হারের পর হার। খেলোয়াড় কেনো আমার নিজেরই আত্মবিশ্বাস ও ভেঙ্গে খান-খান হয়ে যেতো। রাগে-কষ্টে-অপমানে সমালোচনা করতাম কিন্তু হাল ছাড়িনি। প্রতিটি পরাজয়ের গ্লানিতে যেমন নীল হয়েছি তেমনি এক ফোটা অর্জনে উদ্বেলিত হয়েছি লক্ষ-কোটিবার।
হতাশ হতে হতে আমি একসময় ভাবতাম জীবদ্দশায় মনে হয় কোনদিন পাকিস্তান, ইন্ডিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজদের সাথে সিরিজ ঘরে নিতে পারবোনা। আমরা ছোট দল বলে আমাদের অবহেলা করেছে প্রতিবেশী ক্রিকেট পরাশক্তিরা । ব্যঙ্গ করেছে, তাচ্ছিল্য করেছে, নানা ধরনের কু-ব্যবহারে জর্জরিত করেছে। আমাদের ক্রিকেট সব সহ্য করেছে নিরবে নিভৃতে।
ধীরে ধীরে দিন বদলের পালা শুরু হলো। আমার প্রিয় ক্রিকেট দল টিম বাংলাদেশ ধীরে ধীরে একটি সংগঠিত দলে রূপ নেওয়া শুরু করলো। নিয়মিত নাই হোক অনিয়মিত ভাবে ক্রিকেট পরা শক্তিদের ধরাশায়ী করা শুরু করলো। সেই অনিয়মিত জয় আজকে নিয়মিত জয়ে পরিণত হয়েছে। আজকের এই সাফল্যে আমি আবেগী হয়ে যাই। আমার মনে পড়ে মহিন্দর অমরনাথ থেকে শুরু করে গর্ডন গ্রীনিজ, এড বার্লি, ডেভ হোয়াইটমোর, জেমি সিডন্স এবং অবশ্যই হালের হাথুরুসিংহের কথা। যাদের নিষ্ঠা আর কোচিংয়ে আজ বাংলাদেশ টিম যেকোনো দলকে আজ বাংলাওয়াশের সামর্থ্য রাখে।
ভয়ানকভাবে আমার সেই দিনের কথা মনে পড়ে যেদিন এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের আতাহার আলী ৮২ রানের ইনিংস খেলেছিল। সেদিন আমরা পাকিস্তানের কাছে হেরেছিলাম কিন্তু আতাহার আলীর অর্জন আমাদের বিজয়ের স্বাদ এনে দিয়েছিলো। আজকে জয় পিপাসী বাংলাদেশ দল সামান্য অর্জনে ক্ষান্ত নয় বরং বাংলাওয়াশের চিন্তায় মশগুল থাকে। আর আমার সেই কাকা যিনি বাংলাদেশের হার সহ্য করতে না পেরে আমাদের এবং ক্রিকেট টিমকে গালাগালি করতেন, সেই তিনিও রাত জেগে ক্লান্তিহীন খেলা দেখেন। অবশ্য এখনো হারলেই গালাগালি অব্যাহত রাখেন তবে পরিমাণটা একটু কম আর আফসোসটাই বেশি ।
নানাধরনের প্রতিকূলতা, রাজনৈতিক, সামাজিকসহ ভিন্ন ভিন্ন অব্যবস্থাপনা আর নানাধরনের দুঃসংবাদের মধ্যেও দল মত নির্বিশেষে বৈষম্যহীনভাবে যে একটা জিনিস দেশে বিদেশে সমগ্র জাতিতে এক সুতার বন্ধনে আবদ্ধ করে সেই বন্ধনের নাম ক্রিকেট। বিশ্ব পরিবেশবাদী সংগঠনের কাছে বাংলাদেশ যখন একটি ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত হয় ঠিক তখনি আমাদের সাকিব বিশ্ব ক্রিকেটে এক নাম্বার স্থানে বাংলাদেশের নাম মেলে ধরে।
দুর্নীতিতে যখন আমাদের দেশ ক্রমান্বয়ে সামনের দিকে এগুতে থাকে ঠিক তখন আমাদের রাজ্জাক বোলিংয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের একনাম্বার অবস্থানের জানান দেয়। যখনই ৭১ এর খুনি নারীধর্ষণ কারীদের অনুসারীরা বাংলাদেশ কে নব্য পাকিস্তান বানানোর স্বপ্নে বিভোর ঠিক তখনি আমাদের বীর ক্রিকেটাররা বাড়িতে ডেকে একে পাকিস্তান ক্রিকেট টিমকে বাংলা ওয়াশ করে ফকফকা বানিয়ে পাকিস্তান ফেরত পাঠায়।
তিস্তা চুক্তি, সীমান্ত, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিয়ে দরকষাকষি করতে যখনি বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফর করেন। সেই মোদীর সাথে সাক্ষাৎ করতে যখন আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নির্লজ্জভাবে মান অভিমান করেন এর ঠিক দুই সপ্তাহের মাথায় আমাদের বেঙ্গল টাইগাররা ব্যাটে বলে জবাব দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে জয় করে নেয় সিরিজ। ভারতীয় ক্রিকেটারদের মনে ভীতি সঞ্চার করে জীবনের প্রথম দুই ম্যাচে আমাদের সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ আঠারোর যুবক মুস্তাফিজ লণ্ডভণ্ড করে দেয় ভারতীয় ব্যাটিং লাইন আপ।
নানা খাতে দুর্নীতি অব্যবস্থাপনা, খুন, গুমসহ নেতিবাচক সংবাদ বহরের মধ্যেও সাত সমুদ্র তেরনদী পাড়ি দিয়ে প্রিয় মাতৃভূমি থেকে এক পশলা আনন্দের মিষ্টি বাতাস যে পাঠায় সেই হচ্ছে আমাদের ক্রিকেট। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা আসছে বাংলাদেশ সফরে। নিজেদের সেরা ফর্মে থাকা বাংলাদেশ টিমের জন্য রইলো শুভকামনা। দূর দেশ থেকে শুভ কামনা করা ছাড়া কি বা করার থাকে!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য