প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯
সমাপ্তির পথে অমর একুশের বইমেলা। বইমেলা আসলেই আমার কেন যেন ঘুরেফিরে তসলিমা নাসরিনের নামটা মনে আসে। একুশে বইমেলা আসলে এক ধরণের ব্যাকুলতা কাজ করে। আমি প্রথম বইমেলায় আসি চাকরীতে যোগ দেওয়ার পর। মফস্বলের মানুষ রাজধানীর সাথে যোগাযোগ খুবই অল্পই ছিল আমাদের। প্রথমবার মেলায় এসে বেশি খুঁজেছিলাম তসলিমা নাসরিনের বই, কারণ নাইন টেনে পড়ার সময়ই তার লজ্জা, ফেরা, নিমন্ত্রণ, নির্বাচিত কলাম, প্রেমের কবিতা ইত্যাদি পড়ে শেষ। তাই পরবর্তী বইগুলো নিয়ে বেশ আগ্রহ ছিল। বইমেলায় খুঁজে খুঁজে না পেয়ে ফুটপাত থেকে কিছু নকল বই কিনেছিলাম উতল হাওয়া, ‘ক’ আরও কী কী ছিল।
তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। আমি ২০০৫/৬ সালের কথা বলছি। নামের আগে লেখা হতো “বিতর্কিত লেখিকা” এখনো লেখেন অনেকেই। বিতর্কিত লেখা হতে পারে, বিতর্কিত লেখক বা লেখিকা কিভাবে হয় আমার বোধগম্য নয়। পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহ নিয়েও যুগ যুগ ধরেই নান দ্বিমত, বিতর্ক চলে আসছে। সেইক্ষেত্রে লেখা বিতর্কিত না লেখক বিতর্কিত?
তসলিমা নাসরিনের বহু লেখার সাথে, বক্তব্যের সাথে আমার দ্বিমত আছে। যেমন আছে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক নারীবাদী লেখকদের সাথে। সৌভাগ্যক্রমে লেখক তাঁদের অনেকের সাথেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে পরিচয়। সেই লেখকদের লেখা আমি পড়ি; কেন যেন মনে হয় তারা তাঁরা যা বিশ্বাস করেন, তা ধারণ করেন না। যা ধারণ করেন তা প্রকাশ করেন না। একটা খোলসের ভিতর থেকে লিখছেন। এবং কেউই তসলিমা নাসরিনের লেখার ধরণ থেকে বের হয়ে ভিন্ন কিছু লিখছেন বলেও মনে হয়না। শুধুমাত্র স্থান, কাল পাত্র বদল। কিন্তু কাউকে দেশ ছাড়তে হয়নি।
দেশহীন মানুষের বেদনা, শুধুমাত্র নাগরিকত্ব না থাকলে বুঝা যায়। প্রবাসীরা কিছুটা সেই বেদনার অংশীদার হতে পারেন। আপনার একটা দেশ আছে, যার আলো-জলে, আপনি বেড়ে উঠেছেন। প্রবাসীরা প্রতিদিন মনে মনে একবার ক্যালেন্ডার তৈরি করেন কবে দেশে ফিরবেন। অন্যের কথা আমি জানিনা। রাতে বিছানায় গেলে প্রতিদিন মনে হয়- এই বছর কি যাওয়া যাবে দেশে? কতো বছর পরে গেলে একেবারে যাওয়া যাবে?
মনে-মনে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাই, নানা যুক্তি তর্ক করি। দিনশেষে জানি আমার একটা যাওয়ার ঠিকানা আছে। আমি চাইলেই সব ছেড়েছুড়ে কালকেই চলে যেতে পারব। কিন্তু যে মানুষটার সব আছে, কিন্তু নিজের একটা দেশ নেই। দেশহীন একটা মানুষ। কোথায় যাবে? যাকে এখনো তার জন্মের শহর ডাকে, বয়ে চলা নদী ছুঁয়ে যায়, ঢাকার পিচঢালা পথ, দুপরের খরতাপ ব্যাকুল করে। সে ফিরতে পারেনা, দেশ তাঁকে ফিরতে দেয় না।
কতোটা ভয়ংকর হলে একটি রাষ্ট্র- একটি দেশ তাঁকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে।
বাংলাদেশের পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হয়, তাঁর ফেইসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে অনলাইনগুলো সংবাদ ছাপে, প্রতিটা ফেইসবুক স্ট্যাটাসে হাজার হাজার লাইক কমেন্টস আসে। তাঁর মানে তসলিমা নাসরিনের পাঠকপ্রিয়তা বা ভালোবাসার জায়গাটা এখনো বিশাল। কিন্তু তাঁকে দেশে ফিরিয়ে নিতে আগ্রহী না কেউ।
আরিফ আজাদ নামে এক লেখকের প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ নামের বইটি নাকি বেস্টসেলারের তালিকায় ছিল। অন্য আরেকটা বই অনলাইন ভার্সনে দেখলাম জান্নাত: মুক্তির সন্ধানে নারী। পুরো বইটা পড়া হয়ে উঠেনি। দুইটা দুই মেরুর বই। প্যারডক্সিক্যাল সাজিদ কিছুটা কাশেম বিন আবুবকর টাইপের লেখা, কোরানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অবিশ্বাসীদের বিতর্কের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক আরিফ আজাদ। বহু আয়াত কিভাবে রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, সেসব নানা যুক্তি দিয়ে বিতর্ক খণ্ডনের চেষ্টা করেছেন।
শামস অর্ক'র জান্নাত: মুক্তির সন্ধানে নারী, বইয়ে ধর্মে নারীদের কিভাবে অবমাননাকর ভাবে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বন্দি করেছে, সেই বিষয়গুলো জান্নাতের বয়ানে বলেছেন লেখক। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের কোন প্রকাশক এই বই প্রকাশ করবেন না। ইচ্ছা থাকুক বা না থাকুক সেই সাহসই হবে না কোন প্রকাশকের। লেখক তাই অনলাইন ভার্সন উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। প্যারাডক্সিকাল সাজিদ যদি বই মেলায় সর্বোচ্চ বিক্রির তালিকায় আসে জান্নাতও নিশ্চয় সেই তালিকায় থাকতো। এই চর্চাটা সুন্দর; মানব জাতির বিকাশে চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবচেয়ে বড় উপাদান।
বিশ্বের বড় বড় ৩০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও ডিগ্রি অর্জনের জন্য উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, যা মালয়েশিয়া ও চীন দীর্ঘদিন ধরে একদম স্কুল পর্যায় থেকে করে আসছে। দেরিতে হলেও বাংলাদেশ সেটা শুরু করতে পেরেছে। ধন্যবাদ অবশ্যই প্রাপ্য।
ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ঈশ্বর নিয়ে তার ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এই ভিন্ন মতের জন্য তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়নি, বিন্দুমাত্র অসম্মানিত হতে হয়নি। জ্ঞান বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করা কেউ যখন বিবর্তন বাদ কিংবা ধর্ম বিশ্বাসের বিপরিতে যায় কোন মতবাদ বা তত্ব কি মেনে নেবে বাংলাদেশ? সমকামিতা সারা বিশ্বে আজ সম্মানের সহিত গ্রহণযোগ্য। সমকামিতা নিয়ে বাংলায় অভিজিৎ রায়ের কাছাকাছি পর্যায়েও কেউ কিছু লিখেছেন বলে আমার জানা নেই।
তারচেয়ে বরং মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডার পুরোহিতদের জন্য ধর্মীয় উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা মঙ্গলজনক।
শুধুমাত্র মেগা প্রজেক্টে লাভ হবে না, মেগা চিন্তার মানুষ ও তৈরি করতে হবে। এক লন্ডন প্রবাসীর গ্রামের বাড়িতে একজনের বেড়ানোর গল্প শুনেছিলাম। রাজকীয় বাড়ি, আসবাব পত্র, কেউ বাড়িতে নেই, যারা থাকেন, রাজকীয় সোফায় ধানের বস্তা রাখা, সেই ধানের বস্তার মাঝখানেই বসতে বললেন। আসলে যারা বাড়িতে থাকেন তারা এর ব্যবহার বা মর্যাদা কোনটাই বুঝেন না।
গত দুই সপ্তাহ ধরে ব্রিটিশ গণমাধ্যম তথা বিশ্বগণমাধ্যমের আলোচিত বিষয় শামীমা বেগম নামের সদ্য কৈশোর পেরুনো ব্রিটিশ বাংলাদেশি জেহাদিবধূটি। আমি শুরু থেকেই সংবাদটির সাথে আছি। প্রথমদিন টাইমসকে দেয়া সাক্ষাতকারের পর থেকে প্রতিদিন শামীমার সংবাদটি রূপ বদলাচ্ছে।
শামীমা সিরিয়ার ক্যাম্প থেকে গর্ভজাত সন্তান জন্ম দিতে ব্রিটেনে ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু তার কৃতকর্মের জন্য সে অনুতপ্ত ছিলনা। যদিও শুরু থেকেই শামীমার মা এবং বোন শামীমার পক্ষে ছিল, তাকে ব্রিটেনে ফিরিয়ে আনার আবেদন করেছে।
ব্রিটেন সেই আবেদনে সাড়া দেয়নি। বিশেষ ক্ষমতাবলে উল্টো শামীমার নাগরিকত্ব বাতিল করে দিয়েছে। শামীমা এবং শামীমার সদ্যোজাত শিশু সন্তান নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে চলছে নানা তর্ক বিতর্ক। যেহেতু শামীমা অপরিণত বয়সে মাত্র ১৫ বছর বয়সে সিরিয়া পালিয়ে গিয়েছিল, তাই অপ্রাপ্ত বয়স্ক হিসাবে অনেকেই তার প্রতি সহানুভূতিশীল। ব্রিটেন যতোটা নির্দয় শামীমার প্রতি ঠিক ততোটাই সদয় আমাদের প্রবাসীরা। তাদের বক্তব্য হচ্ছে ব্রিটেন শামীমাকে সুরক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্রিটেনের উদার মানবিকতার সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে চাইছেন। আনোয়ার নামের আরেক ব্রিটিশ বাংলাদেশি আইএস যোদ্ধা যার জিহাদি নাম আবু ওবাইদা আল-ব্রিটানিয়া সেও দেখলাম ব্রিটেনে ফিরে আসতে চায়।
যাই হোক মূল বিষয় শামীমা নয়, শামীমা একটা উপলক্ষ মাত্র। শামীমাকে ভর করেই হয়তো শত শত জেহাদি ইংল্যান্ডে প্রবেশ করবেন। পরবর্তীতে এদের অনেকেই হয়তো ধর্মীয় নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবেন। শামীমার ব্রিটেনে ফেরার এই তর্ক বিতর্ক দেশে ফেরার সাথে আমি তসলিমা নাসরিনের দেশে ফেরার সংযোগ ঘটাতে চাই। ব্রিটেনে যারা দেখলাম শামীমার ফিরে আসার ব্যাপারে মানবাধিকার, আইনকানুন ইত্যাদি বিষয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন, সেই একই ব্যক্তি তসলিমা নাসরীনের বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যান!
আহমদ ছফা প্রগতিশীলদের খুব সুন্দর সংজ্ঞায়িত করে গেছেন “ যারা মৌলবাদী তারা শতভাগ মৌলবাদী। কিন্তু যারা প্রগতিশীল বলে দাবি করে থাকেন তাদের কেউ কেউ দশভাগ প্রগতিশীল, পঞ্চাশভাগ সুবিধাবাদী, পনেরোভাগ কাপুরুষ, পাঁচভাগ একেবারে জড়বুদ্ধি সম্পন্ন”।
প্রখ্যাত সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকতা নিয়ে বলেছিলেন ৬০-এর দশকে মাত্র দুইজন নারী সাংবাদিক ছিলেন ঢাকা শহরে। আজ শত শত নারী সাংবাদিক, কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক বাংলাদেশে। যাদের এই প্রথা ভেঙে সামনে আসার মিছিলের প্রথম ভাগের সৈনিক তসলিমা নাসরিন। কিন্তু দীর্ঘ ২৪ বছর একটা মানুষ দেশান্তরী, কেউ দাবিটা জানায় না কেন একজন মানুষ নিজের দেশে ফিরতে পারবে না। দেশে আইন আছে, আদালত আছে, নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়েছে। তসলিমা নাসরিন অপরাধী নন। ভিন্ন মতাবলম্বী। হাজার হাজার ওয়াজী ওয়াজ মাহফিলে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন, নানা মত নানা পথের কথা বলছেন। ধর্মীয় ভিন্নমত পোষণ করছেন। আর সনাতন ধর্মের তো নানা মত নানা পথ ধর্মীয় ভাবেই গ্রহণযোগ্য। কাউকে দেশ ছাড়া তো দূরের কথা, আজ পর্যন্ত নিষেধ করা হয়েছে বলে জানা নেই।
কোন ধরণের আত্মপক্ষ সমর্থন, তাঁর লেখার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে বলেও জানিনা। শুধুমাত্র মৌলবাদীদের অযৌক্তিক, অনৈতিক দাবির কারণে রাতের আঁধারে দেশ ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। একুশের বইমেলায় অভিজিৎ রায়ের রক্তের দাগে পা মাড়িয়ে প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ বেস্ট সেলার বই হয়! শামীমার চেয়ে ও ভয়ংকর অপরাধী হয়ে দেশহীন হয়ে জীবন কাটাতে হয় একজন তসলিমা নাসরিনকে।
তসলিমা নাসরিন কি শামীমার চেয়েও ভয়ংকর?
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য