আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ডাকসু নির্বাচন: বঞ্চনা শেষে স্বপ্নপূরণের দিন

আলমগীর শাহরিয়ার  

সকল অনিশ্চয়তা ও সংশয় কাটিয়ে, প্রায় তিন দশক বঞ্চনার পর---অবশেষে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ(ডাকসু) নির্বাচন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ১১ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশবাসী গভীর আগ্রহ নিয়ে এ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে।

নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচার বিরোধী ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দেশব্যাপী আন্দোলন হয়। বরাবরের মত ঐতিহ্যের পথ ধরে এ আন্দোলনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে এদেশের সাহসী ছাত্র সমাজ। অথচ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় খোদ সেই ছাত্র সমাজকেই গণতন্ত্রের সুফল চর্চা থেকে বঞ্চিত করা হয়। যে বঞ্চনার শিকার হতে হয়নি সামরিক শাসনামলেও। ফলে, দেশও বঞ্চিত হল পরিশীলিত নেতৃত্ব তৈরির ধারাবাহিকতা থেকে। অথচ একটি দেশের সামগ্রিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জাতির সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠসহ অন্যান্য সকল বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে নিয়মিত এই ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনের কোন বিকল্প ছিল না।

বেশ ক’বছর ধরেই রাজনীতি ও পার্লামেন্টে ব্যবসায়ী ও আমলাদের আধিক্য ও আধিপত্য বাড়ছে। প্রায়শ সমালোচনার পাশাপাশি সুধী সমাজকে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়। বলা হয়, ব্যবসায়ীরা জনগণের হৃৎস্পন্দন না বুঝলেও নিজেদের ব্যবসায়ীক স্বার্থবুদ্ধি ভালোই বুঝেন। রাজনীতিতে আসেন ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে কিভাবে ব্যবসার আরও প্রসার ঘটানো যায়। পুঁজিবাদী সমাজে রাজনীতি তাই এক শ্রেণির জন্য জনসেবা নয়, যেন পুঁজি বৃদ্ধির মোক্ষম হাতিয়ার।

বিকশিত গণতন্ত্র ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতি চর্চার জন্য তাই দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন সময়ের দাবি। সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চা, একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক মান বৃদ্ধি, সমাজ ও রাজনীতিতে পরমত সহিষ্ণুতা বৃদ্ধির জন্যেও এই নির্বাচন জরুরি। সদ্য সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ দেশে শিক্ষার মান না বাড়িয়ে রাতারাতি পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভের সংখ্যা বাড়ানো ও লাগামহীন প্রশ্নফাঁস নিয়ে নানাসময় তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হলেও স্কুল পর্যায়ে স্টুডেন্ট ক্যাবিনেট নির্বাচন চালু তাঁর আমলের সাফল্যমুকুটে নিশ্চয় একটি উজ্জ্বল পালক হয়ে থাকবে।

একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই যেন দুর্ভাগ্য ও সমালোচনার কালো মেঘ তাঁর পিছু ছাড়ছে না। তাঁর আমলেই কোটা সংস্কার আন্দোলন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথমবারের মত উপাচার্যের বাসভবনে আগুন, ভাংচুর ও সপরিবারে তাঁর উপর হামলা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস- তাঁর ভাবমূর্তিকে ম্লান করেছে। একই সঙ্গে দীর্ঘ ২৮ বছর কেউ কথা না রাখলেও তাঁর আমলেই বহুল প্রতীক্ষিত ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রতিক্রিয়াশীল ব্যতীত ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল সকল ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করে নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বন্ধ্যত্ব কাটিয়ে ইতিহাসে বাঁক বদলের এই হাতছানি তাঁর সামনে রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় একটি দেশে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও নতুন জ্ঞান তৈরির কারখানা। একই সঙ্গে একটি প্রগতিশীল ধ্যান ধারণা চর্চা ও অগ্রসর সমাজ বিনির্মাণে অগ্রপথিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সে বোধ ও সৃজনশীল মনন তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। রাজনীতি, দলাদলি, নিজেদের কোন্দল, অযোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ— এসব সংকটের জন্ম দিচ্ছে। প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘জলপাই রঙের অন্ধকার’ বইয়ে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এক লেখায় বলেছিলেন, ‘‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মনে হয় বিশাল হাসপাতালের মত, যে হাসপাতাল নিজেই শোচনীয়ভাবে রুগ্ন; অন্যের চিকিৎসা কী করবে, তার নিজেরই দরকার গভীর চিকিৎসা। অসংখ্য তার রোগ, অনেক রোগ স্পষ্ট, অনেক রোগ প্রচ্ছন্ন।’’

স্পষ্ট ও প্রচ্ছন্ন এসব রোগের জরুরী চিকিৎসা দরকার। না হলে উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নিগ্ধ সুন্দর সবুজ ধ্বংস করে উর্ধ্বমুখী ভবনের পর ভবন হবে, জেলায় জেলায়ও বিশ্ববিদ্যালয় হবে কিন্তু এর মান ঊর্ধ্বগামী না হয়ে দিনদিন নিম্নগামীই হবে। ফলে জাতি হিসেবে আমরা এসব প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ সুফল ভোগ করতে পারব না। সমাজে বিক্ষুব্ধ বেকার, হতাশ, কর্মবিমুখ প্রজন্ম তৈরি হবে। যা সমাজে বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে।

গভীর হতাশার সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় শিক্ষকেরা তাদের অনুগত রাজনৈতিক দলের জন্য ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ইশতেহার প্রণয়নে যুক্ত থাকেন কিন্তু নিজেদের প্রতিষ্ঠান এনালগ ও মান্ধাতার আমলের সিস্টেমের গলদে পড়ে হাবুডুবু খায়; তা তাদের নজরে আসে না। অথবা সচেতনভাবে উপেক্ষা করে চলেন। প্রথম বর্ষে ভর্তিচ্ছু একটি ছেলে-মেয়ে হল, টিএসসি, রেজিস্টার ভবন, নিজ বিভাগে দৌড়ে- প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে থাকে। কিন্তু তাদের দুর্ভোগ নিয়ে কথা বলবার কেউ নেই।

পর্যাপ্ত ক্লাস রুম নেই, গবেষণার জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ নেই, উন্নত মানসম্পন্ন কোন প্রকাশনা নেই, ধুঁকে ধুঁকে শেষ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের রুগ্ন প্রকাশনা---দেখবার কেউ নেই। উন্নত আধুনিক লাইব্রেরি নেই, নামে মাত্র লাইব্রেরি আছে কিন্তু সংকটের শেষ নেই, চর দখলের মত লড়াই করে শিক্ষার্থীদের একটু বসার জায়গা পেতে লাইব্রেরির প্রবেশমুখে দীর্ঘসারির শেষ নেই। বই ব্যবহারে প্রাচীন পদ্ধতির কোন পরিবর্তন নেই, শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে নিয়মিত সাংস্কৃতিক কোন কর্মকাণ্ড নেই। এরকম অজস্র ‘নেই’ আর ‘নেই’-ই এখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের করুণ নিয়তি। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে---সেইসব নেইগুলোও যেন দেখবার কেউ নেই। ডাকসু নেতৃত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা এমন অসংখ্য জঞ্জাল পরিষ্কারে এগিয়ে আসবে। বঞ্চিত ছাত্র সমাজের পক্ষে কথা বলবে। তাদের ন্যায্য দাবি দাওয়া উত্থাপন করবে। আদায় করবে।

নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারি, সিনেট, সিন্ডিকেট, ডিন- নির্বাচন হয়; কিন্তু যে শিক্ষার্থীদের ঘিরে এ সকল আয়োজন তাদেরই নির্বাচন হয় না। এটা শুধু অধিকার থেকে বঞ্চনা নয়, অন্যায়। এই অন্যায় থেকে ১১ মার্চ একটি সুষ্ঠু সুন্দর নির্বাচন আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের মুক্তি দিক।

আলমগীর শাহরিয়ার, কবি ও প্রাবন্ধিক। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ