আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

উপজেলা চেয়ারম্যান এখন নপুংসক নিধিরাম সর্দার!

ফজলুল বারী  

উপজেলা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক বদনিয়ত-শয়তানি সম্পর্কে এই প্রজন্মের অনেকেই জানেনা। এক সময় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এসবই ছিল সক্রিয় স্থানীয় সরকার কাঠামো। পরে আসে সিটি কর্পোরেশন। এখন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানগুলোই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার তুলনামূলক কার্যকর কাঠামো। সামরিক জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করে উপজেলা পরিষদ-জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। মুখে তখন প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলা হলেও এর পিছনের রাজনৈতিক শয়তানিটা ব্যাখ্যা করে বলছি।

জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখলের পর তার রাজনৈতিক স্বপ্ন পূরণে প্রথম যে কাজটি করেন তাহলো দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কলুষিত করা। দেশের ইতিহাসের প্রথম ভোটারবিহীন রেফারেন্ডাম তথা হ্যাঁ-না ভোটের কাগুজে গণরায়ের প্রহসন করেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়া। এরপর জেলখানা থেকে দাগী যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে, রাজনৈতিক পতিতা-নীতিহীন রাজনীতিকদের সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে সংগ্রহ করে গঠন করেন বিএনপি। জিয়াকে তার অনুসারীরা সৎ মানুষ হিসাবে প্রচার করেন। বাংলাদেশের রাজনীতি যে অসৎ ধান্দাবাজদের হাতে গিয়ে পড়েছে, এর সূচনা কিন্তু জিয়ার মাধ্যমে। অসৎ-ধান্ধাবাজদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা তুলে দেবার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়া যে দুর্বৃত্তায়নের সূচনা করেছিলেন, তা দিনে দিনে সেটি শুধু খারাপের দিকেই ধাবমান। যে লোক দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সততা-কৌলীন্য ধ্বংসের জনক সে সৎ হয় কী করে?

এরপর আসে আরেক ধান্দাবাজ আরেক জেনারেল এরশাদের রাজনৈতিক দলগঠন আর প্রতিষ্ঠার খেলাধুলা! জিয়ার মতোই ধান্ধাবাজদের সংগ্রহ করে রাজনৈতিক দল করতে উপজেলা পরিষদ-জেলা পরিষদ গঠন করেন এরশাদ। জিয়ার অসৎ রাজনীতির সহযোগী ব্যারিস্টার মওদুদ, মির্জা ফখরুলের রাজাকার পিতা মির্জা রুহুল আমিনরা সবাই তখন বিএনপি ছেড়ে এরশাদের পিছনে গিয়ে ভিড়েন। এমনকি আওয়ামী আমলের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্লাহ লক্ষ্মীপুরের রায়পুর থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান হন! রাষ্ট্রপতি পদ থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান! বাংলাদেশের রাজনৈতিক মোহ আর স্খলনের নমুনাটি আঁচ করা যায়?

তখন সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত আওয়ামী লীগ-বিএনপি সহ রাজনৈতিক দলগুলো এবং ছাত্র আন্দোলনের দাবি ছিল সবার আগে এরশাদের পদত্যাগ এবং সংসদ নির্বাচন। আন্দোলনের চাপে এরশাদ প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচন স্থগিতেও বাধ্য হন। 'রাজার পদ্য' নামের এক ছড়া কবিতায় তখন আমি লিখেছিলাম, 'উপজেলা-উপজ্বালা নতুন বিলাপ/সারাদেশে খ্যাতি পায় রাজার প্রলাপ/ বিরোধীরা শক্ত হয় দেয় হুংকার/তোমাকে ফেরাবোই ব্যারাকে আবার/ মরণ কাছাকাছি পেয়ে গন্ধ/ উপজেলা নির্বাচন করে বন্ধ/বাঘ-ব্যাটা হয়ে যায় ভীরু শেয়াল/ সুযোগে বেরিয়ে পড়ে থলের বিড়াল।'

প্রবল বিরোধিতার মুখে পরবর্তীতে এক রকম কার্ফু দিয়েই এরশাদ প্রথম উপজেলা নির্বাচন করেছিল। সেই নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণা চেয়ারম্যান, তাদের মাধ্যমে নির্বাচিত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের নিয়েই এরশাদ সৃষ্টি করে জাতীয় পার্টির ভিত্তি। তখন বলা হয়েছিল উপজেলা চেয়ারম্যান-জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানরাই থাকবেন স্থানীয় উন্নয়নের নেতৃত্বে। কিন্তু তা কার্যত তা হয়নি। একদার থানা সার্কেল অফিসার, সিও পদের নাম থানা নির্বাহী কর্মকর্তা, টিএনও ঘুরে এর নতুন নাম হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউএনও। তিনিই থাকেন উপজেলা প্রশাসনের ব্যবহারিক কর্তৃত্বে। উপজেলা কমপ্লেক্সে ইউএনও সাহেবদের জন্যে সুন্দর নতুন বাড়িও তৈরি হয়।

জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান-উপজেলা চেয়ারম্যানদের সরকারি অফিস-স্টাফ-গাড়ি-ড্রাইভার হয়েছে ঠিক, কিন্তু তাদের জন্যে কোন সরকারি বাড়িরও ব্যবস্থা করা হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-পৌরসভা চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগসাজশে ধান্দা করে অথবা দুর্নীতি করে টাকাকড়ি কামানো ছাড়া জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান-উপজেলা চেয়ারম্যানরা উন্নয়নের নেতৃত্বে আসীন হতে পারেননি। এগুলো এখন মূলত তৃনমূল পর্যায়ে দুর্নীতি সম্প্রসারণের বিষফোঁড়া।

আমলাতন্ত্র যেমন তাদের নিজস্ব পদায়নের স্বার্থে বিভাগ-বিভাগীয় কমিশনার এসব রাজনীতিকদের দিয়ে করিয়ে নিয়েছে, তেমনি ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের কোন একজনের প্রাইজ পোস্টিং তথা রাজনৈতিক পদায়নের জন্যে করা হয়েছে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের পদ। স্টাফ সমেত এদের পিছনে সরকারি ব্যয় বাড়ানো, ফিতা কাটা এবং দুর্নীতিতে বখরা বসানো ছাড়া বিভাগীয় কমিশনারের মতো জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানেরও তেমন কাজ নেই। এ পদগুলো শূন্য হলে আবার আমলারাই সেগুলোয় বসে শূন্যপদ পূরণ করে বেতন-ভাতা খায়।

এরশাদের পতনের পর বিএনপি-আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জেলা পরিষদ-উপজেলা পরিষদ বাতিল বা এসবের ক্ষমতা-গুরুত্ব না বাড়িয়ে যথারীতি চেয়ারম্যান পদ দুটিকে করেছে তাদের স্থানীয় নেতাদের প্রাইজ পোস্টিং পদ। যাদেরকে তারা সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়না বা দিতে পারেনা তাদেরকে দল দুটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বা উপজেলা চেয়ারম্যান করিয়ে দেবার দেবার প্রলোভন দেখায়। এরশাদ আমলে উপজেলা পরিষদের যে সব ক্ষমতা-গুরুত্ব ছিলো, সে সবও এখন আর বহাল নেই। অতএব শুরু থেকে নিয়তের সমস্যার কারণে জেলা পরিষদ-উপজেলা পরিষদ আজ পর্যন্ত স্থানীয় উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু নয়। মুখে বিকেন্দ্রীকরণের বুলি আওড়ালেও এখনতো দেশে অদ্ভুত এক উন্নয়ন চিন্তা চলমান!

সারা পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় সংসদ সদস্যদের কাজ হলো আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন তদারকির কাজ করা। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর অমনোযোগী-অসতর্ক অথবা খামখেয়ালি ভূমিকার কারণে যারা সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হন বা এমপি হন বা যাদের এমপি বানিয়ে দেয়া হয় তাদের সিংহভাগ আইন-সংসদ এরকিছুই বোঝেননা। সংসদ ভবনের লাইব্রেরি কোথায় সেটিও অনেকে জানেননা। মনোনয়ন কিনে অথবা পেয়ে এরা মূলত ভোটারদের রাস্তা ঠিক করে দেবার, এই দেবার সেই দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচন করেন। অথচ যে কাজগুলো মূলত ইউনিয়ন পরিষদ-পৌরসভা-উপজেলা পরিষদ, অথবা স্থানীয় সরকার বিভাগের।

বাংলাদেশে যেহেতু নির্বাচনে প্রার্থীরা কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করেন সেহেতু নির্বাচিত হলে এদের মূল ধান্ধা থাকে খরচ করা টাকা সুদেআসলে তোলা অথবা টাকা বানানোর। দুর্নীতিগ্রস্ত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নানা দুর্নীতি-অনিয়মের নেতৃত্বে তাই এখন স্থানীয় সংসদ সদস্য। উন্নয়ন নামের স্থানীয় দুর্নীতি সভার তিনিই সভাপতি। তার অগোচরে অথবা তাকে ভাগ না দিয়ে দুর্নীতি করার সাহস-সামর্থ্য কোন ইউপি চেয়ারম্যান-পৌর মেয়র বা উপজেলা চেয়ারম্যানের নেই। দুর্নীতি নিরাপদ করতে এখন আবার এমপিরা তাদের পারিবারিক সদস্যদের, অথবা অনুগত ঘনিষ্ঠদের উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করান বা পাশ করান। অথচ কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট তত্ত্বে এটিও কোন গণতান্ত্রিক দেশে সম্ভব নয়। স্থানীয় উন্নয়ন কর্তৃত্বে আইন প্রণেতা এমপির দাপটে-খবরদারিতে উপজেলা চেয়ারম্যান এখন নপুংসক ঢাল-তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দার। এমপি সাহেবকে তার সারাদিন 'সহমত ভাই', 'আপনে খুশি হইয়া যা দেন ভাই' বলে নিজের পদরক্ষা ছাড়া বিকল্প নেই উপজেলা চেয়ারম্যানদের। কারণ স্থানীয় সরকার আইনে ইউপি চেয়ারম্যান-পৌর-সিটি মেয়রদের মতো উপজেলা চেয়ারম্যানদের পদও বাতিল-বরখাস্ত অথবা খেয়ে দেয়া যায়।

ফজলুল বারী, প্রবাসী সাংবাদিক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ