প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আরিফ জেবতিক | ২৮ জুন, ২০১৫
সিলেটিদের সম্পর্কে একটা ধারণা হচ্ছে সিলেটিরা তাঁদের আঞ্চলিক ভাষার বাইরে কথা বলতে পারেন না। এ ধারণা আজকের নয়, খোদ রবিঠাকুর সৈয়দ মুজতবা আলীকে নাকি বলেছিলেন, 'তোমার মুখ দিয়ে কমলালেবুর গন্ধ বের হয়।'
সিলেট ছেড়েছি দেড়যুগেরও বেশি হয়, ঢাকায় আমাদের ভাইবোনদেরকে প্রায়শই একটি কথা শুনতে হয়, 'বাহ, আপনাদের বাড়ি সিলেটে? কথায় কিন্তু বুঝা যায় না।' আঞ্চলিক ভাষা আর প্রমিত ভাষার এই স্পষ্ট ভেদরেখাটা আমাদেরকে টেনে দেয়া হয়েছে সেই সুদূর শৈশবে। এই কাজটি খুব যত্নের সঙ্গে করেছেন আমাদের সবার প্রিয় বাবুলদা।
সিলেটে শিশু একাডেমি শুরু হলে আমরা একেবারে গোড়ার দিকের প্রশিক্ষণার্থী সেখানে। প্রতি শুক্রবারে সকাল ১০টায় বাবুলদা আবৃত্তি আর অভিনয়ের ক্লাস নিতেন, তাঁকে গোল করে শতরঞ্জিতে বসে আছি আমরা শ’খানেক শিশু-কিশোর। স্বরে অ, স্বরে আ-জোরে জোরে পড়া হচ্ছে। ছড়ায়-ছন্দে। তাঁরপর কোথায় ঠোঁট গোল করতে হবে, কোথায় হ্রস্বধ্বণি কোথায় নয়-একেবারে ভেঙ্গে ভেঙ্গে শেখাচ্ছেন বাবুলদা।
ছোটবেলায় আমাদের তাড়া ছিল টিভিতে টারজান দেখা, কার্টুন দেখা-শুক্রবার সকালে সেই মায়া কাটিয়ে বাবুলদার ক্লাসে হাজির হতে হলে কত বেশি টান জন্মানো লাগে, সেটি বাবুলদা ঠিকই জানতেন। কোথা থেকে যে স্ক্রিপ্ট জোগাড় করতেন জানি না, একেকটা নাটক যেমন ছিল হাসির তেমন ছিল আনন্দের। আমরা মাসের পর মাস চরম আনন্দে সেই রিহার্সাল করেছি, টারজানের চেয়ে বাবুলদার টান বেশি ছিল আমাদের।
সুকুমার রায়ের ছড়াগুলো প্রায় ঠোঁটস্থ হয়ে গিয়েছিল, কিংবা রবিঠাকুরের ডাকঘর নাটকটির সেই দারুণ উপস্থাপনা। আমার বন্ধু চয়ন ডাকঘরের অমল, আমরা ঠিকই জানি সে আর কেউ নয় আমাদেরই অমল, কিন্তু আলো-শব্দ আর খুদে অভিনেতা অভিনেত্রীদের একাত্মতায় চয়ন কখন যে অমল হয়ে গেছে- সেই অমল মরে যাচ্ছে আর আমরা গ্যালারির চেয়ারে বসে চোখ মুছে চলছি-আজ এত্তো এত্তো বছর পরেও মনে পড়ে যায়।
আমি কোনোদিনই কখনো শুক্রবারের সকালে শিশু একাডেমিতে গিয়ে বাবুলদাকে পাইনি, এমনটি স্মরণে এলো না। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কী ধৈর্য নিয়ে তিনি সেখানে শিশুদেরকে সময় দিয়েছেন, আজকে ভাবলেই অবাক লাগে। ব্যবসায়ী ছিলেন, আরো হরেক রকম কাজ-সামাজিকতা ছিল- শিশু একাডেমির ঐ বারান্দায় শতরঞ্জি বিছিয়ে শিশুদের জন্য ভুতের বেগারে মাস-বছর না পার করলে কিছুই হতো না। কিন্তু তিনি করেছেন, কোনো কিছু পাওয়ার আশা না করেই করেছেন। আর তাই আমরা বড় হয়েছি, কথা বলা শিখেছি, লেখা শিখেছি, রবি ঠাকুর- সুকুমার রায় হয়ে অনেক কিছু পড়তে শিখেছি।
হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য বাবুল তাই আমাদের অস্তিত্বে, আমাদের দিনযাপনে রয়ে গেছেন। গত কিছুদিন আগেই শুনেছিলাম তাঁর শরীর খুব খারাপ, হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ছোটবোনটা বলছিল, দেখতে যাবে। শুনে আমার মায়ের খুব রাগ, 'এখন মনে পড়েছে দেখতে যাবে, সিলেটেই তো থাকো, একবার তো আগেও খোঁজ নিতে পারতে।'
মহানগর তকমা লাগালেও সিলেট এখনও আমাদের পাড়া মহল্লাই বটে, আমি নিশ্চিত আমার বোনের সঙ্গে বাবুলদার অনেকবারই দেখা হয়েছে-কিন্তু তবু আমার বোন চুপ করে থাকে। আমার মা জানেন, সিলেট শহরের একদঙ্গল শিশু-কিশোরের বাবা-মা জানেন, বাবুল ভট্টাচার্য তাঁদের সন্তানদেরকে কত বেশি কিছু দিয়েছেন।
আমরা তখনকার অবোধ শিশু, তখনও বুঝিনি, এখনও বুঝি বলে দাবি করি না। আজ বাবুল ভট্টাচার্য চলে গেলেন। সত্যিই কি চলে গেলেন? বাবুল ভট্টাচার্য বেঁচে থাকবেন সিলেটের শতশত ছেলেমেয়েদের মনে ও মননে। দিনের পর দিন যে যত্নে তিনি সেখানে স্থাপিত হয়েছেন, শারিরীক মৃত্যু তাঁর সেই ছবিকে বিন্দুমাত্র ম্লান করতে পারবে না।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য