আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

সমকামিতা কোন কুকামের কাম না ভাই ইহা আসলে একপ্রকার ‘কাম’ই

কাজল দাস  

‘Freedom is the most worthiest thing of a man in a life’- Rosa Luxembourg, a German communist leader
আমেরিকান আদালত সমকামীদের পক্ষে যুগান্তকারী রায় দিয়েছে। তারা সম লিঙ্গের বিয়ের স্বীকৃতি দিয়ে মানুষের স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য। অভিনন্দন তাদের প্রাপ্য। বর্তমান লিখাটা সমকামীদের নিয়েএপ্রিল ১৬, ২০১৪ সালে লিখা। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে সমকামীদের পক্ষে আদালতের রায় ও বাংলাদেশে সমকামিতার আলোচনা-সমালোচনার প্রাসঙ্গিকতাস্বরুপ লিখাটা নতুন করে লিখা হল।

সমকামিদের সমর্থন করে লিখায় আমার উপর অনেকে চটেছেন, অনেকে নানান প্রশ্ন করেছেন, প্রশ্নটা ইনবক্সে হয়েছে বেশী, কেউ বলেছেন ভাই আপনি কি সমকামী? কেউ লিখেছেন ভাই আধুনিক সমাজে এটা গ্রহণযোগ্য কি না? ধর্মেতো এটা নিষিদ্ধ? সমাজে এতো সমস্যা থাকতে আপনারা সমকামিতা নিয়ে চিল্লাইতেছেন ক্যান? ইত্যাদি ইত্যাদি।

আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে একটা গল্প বলি শুনেন, গল্পটা একটা সংসার ভাঙ্গার গল্প, আমার এক পরিচিত বন্ধু, খুব দামী বেতনের চাকরি করে, খুব সুন্দরী মেয়েকে প্রেম করে বিয়ে ও করেছিল, কিন্তু তার ‘মেল ফিলিয়া’ ছিল ছোট বেলা থেকেই। সমাজের চাপে কাউকে সে এটা কখনো মুখ ফুটে বলতে ও পারে নি কোনদিন। বিয়ের পরে একসময় মেল ফেলিয়াটা তার মধ্যে চরম আকারে ধারণ করায় স্বাভাবিকভাবেই সে সমকামিতার দিকে এগিয়ে যায় (যদিও সে বিষমকামী ছিল তবু তার টেন্ডেন্সিটা ছিল ঐদিকে)। কিন্তু সমস্যা দাঁড়ায় অন্যখানে, তার স্ত্রী এটা মেনে নিতে পারেনি। স্ত্রী ভাবল, তার স্বামী আরেকটা ছেলের সাথে সমকামিতা করে এটা স্ত্রী হিসেবে তার জন্য মেনে নেওয়া ছিল কষ্ট দায়ক। ফলাফল হিসাবে আসে বিচ্ছেদ। মেয়েটার ডিভোর্সের কারণটা কি ছিল, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়, নিচে এই বিষয়টার মাজেজা নিয়ে আলোচনা আছে।

যারা বলেছেন আমি সমকামী কি না? তাদের বলি, সমকামিদের নিয়ে কথা বলার জন্য সমকামি হবার কোন দরকার আছে বলে আমি মনে করি না, যদিও ব্যাক্তিগতভাবে আমি সমকামি নই। সমকামিতা হল একটা যৌন প্রকারভেদ। প্রকৃতিতে নারী-পুরুষের যৌন কাঠামোর বাইরে ও ভিন্ন ধরনের যৌন কাঠামো আছে। তার মধ্যে রয়েছে পুরুষ-পুরুষ সম্পর্ক (গেইজম) আর নারী-নারী সম্পর্ক (লেসবিয়ানিজম),এর বাইরে রয়েছে থার্ড জেন্ডার আমরা যাদের হিজড়া বলি এবং ট্রান্সজেন্ডার (যারা মেল অথবা ফিমেল ফিলিয়ার দিকে ধাবিত হবার জন্য লিঙ্গান্তরের দিকে আগায়)। এটা একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার তার জীনগত ভিত্তি আছে, প্রানীবৈচিত্র্যগত ভিত্তি আছে, ইতিমধ্যে এসব বিষয় অনেক প্রমাণ হয়েছে, অনেক বিষয় নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে, দেশে বিদেশে অনেক লিখালিখি হচ্ছে, আমাদের দেশে অভিজৎ রায় এবং মুক্তমনা ব্লগ অগ্রগন্য ভূমিকা পালন করছে এই ব্যাপারে, আগ্রহীরা ঐদিকে ডু মারতে পারেন।

আমি একটু অন্য বিষয় নিয়ে আলাপ করতে চাই, সেটা হল সমাজের যৌনতার ধারনা নিয়ে। যারা মনে করেন সমকামি যৌনতা একটি অসামাজিক কাজ, এক ধরনের বিকৃতি বা ধর্ম বিরুদ্ধ কাজ তারা আসলে ভুল চিন্তা করেন। এই ভুলের কারন হল যৌনতাকে সমাজ দিয়ে বিচার করা, যৌনতা সমাজ দিয়ে বিচার করলে চলবে না, এটাকে বিচার করতে হবে প্রকৃতি দিয়ে। যৌনতা প্রকৃতি নির্ধারিত ব্যাপার। সমকামি যৌনতা প্রকৃতিগতভাবে খাপ খাইয়ে মানুষের সহজাত মানসিকতা থেকে এসেছে। এটাকে শুধু সমাজ বা সাংস্কৃতিক চিন্তা দিয়ে বিচার-বিবেচনা করলে আমাদের ভুল হবে।

এই সমাজ দিয়ে সবকিছু বিচারের কাহিনীটা অন্য জায়গায়। এটা অনুন্নত, কূপমুন্ডুক, উগ্র জাতীয়তাবাদী, সাম্প্রদায়িক, রক্ষনশীল বিশ্বের চিন্তা প্রক্রিয়ার গলদ। এসব দেশে যেহেতু বিজ্ঞান এখনো ধর্ম বা সমাজের বিবেচনায় চলে, সামাজিক বিচার দিয়ে জাস্টিফাইড হয় সেজন্য বিজ্ঞানের আগে প্রভাব কাঠায় সমাজ বা ধর্ম। শুধু সমকামিতা নয় এসব সমাজে আরো কিছু জিনিস বলা হয় যেমন- কন্ডম ব্যবহার চলবে না, মাতৃনিয়ন্ত্রণ চলবে না ইত্যাদি। ফলে সমাজ নয় আমাদের ভাবনায় নিয়ে আসা উচিৎ প্রকৃতিগত বিচার। সমকামি যৌনতাকে প্রকৃতি পারমিট করে কি না সেটা দিয়ে আপনাদের বিবেচনা করা দরকার সমাজ বা ধর্ম দিয়ে নয়।

কেউ কেউ আরেকটা প্রশ্ন করেন, যদি সবাই সমকামি হয় তাহলে প্রজাতি নিয়ন্ত্রণের কি হবে? এটা একটা বোকার মতো প্রশ্ন। কারন, প্রকৃতির সকল মানুষ একই সাথে কখনো সমকামি হচ্ছে না, এটা হবার সম্ভাবনা ও খুবই কম, এটা বৈচিত্র্যগত যৌনতার ব্যাপার, তবে অস্বাভাবিক নয়। পৃথিবীতে বেশীরভাগ মানুষরা জীনগতভাবে বিষমকামী। এটা একটা ন্যাচারাল অর্ডার। যেভাবে সমকামিতাও এক প্রকারের সেক্সুয়াল অর্ডার এ্যাডাপটেড বাই ন্যাচারাল প্রসেস অফ হিউম্যান সেক্সুয়াল স্ট্রাকচার।

আমাদের সমাজে যারা সমকামিতার বিরোধিতা করেন তাদের এই বিরোধিতা আসার অন্যতম আরেকটা দিক হচ্ছে যৌন মানসিকতা। এরা যখন সমকামিতার ব্যাপার চিন্তা করেন তখন তারা ভাবেন উনি নিজে হয়ত সমকামিতা করছেন উনারই পরিচিত একজনের সাথে, কিংবা উনার ছেলে করছে আরেকটা ছেলের সাথে, উনার মেয়ে করছে তার বান্ধবীর সাথে। এটাকে এভাবে চিন্তা করার প্রয়োজন নাই। স্বাভাবিকভাবে নারী-পুরুষের যেমন যৌন সম্পর্ক গড়ে উঠে, তেমনি সমকামিদের মধ্যে ও ব্যাপারটা একই রকম হয়ে থাকে। এখানে হুট করেই কেউ সমকামি হয়ে যায় না। তার শরীরগত ব্যাপার তাকে ঐদিকে নিয়ে যায়।যেভাবে আমার মত স্বাভাবিক একজন পুরুষ এগিয়ে যায় আমার মতই নারীর দিকে ।

উপরের যে উদাহরণটা দিলাম, সেখানে ডিভোর্স হয়েছিল মূলতঃ সেক্স-সাইকোলজিক্যাল বা যৌন-মানসিক কারনে। বিষয়টা খুলে বলি। মেয়েটা তার স্বামীকে কখনো কোন ছেলের সাথে মিশতে দিত না, এমনকি তার ফোনে কোন ছেলের কল আসলে এটা সেই রিসিভ করত। সে ছেলেদের ব্যাপারে যতটা বিদ্ধেষী ছিল তার চেয়ে নমনীয় ছিল মেয়েদের ব্যাপারে। তার স্বামী কোন মেয়েদের সাথে কথা বললে বা ঘুরলে তার কোন আপত্তি ছিল না আপত্তি যত তা ঐসব ছেলের বেলাতেই। এই যে কাহিনী ইহা এক প্রকারের বাই পোলার সিন্ড্রোম। আমাদের সমাজে একজন পুরুষ/স্বামী যেমন নারী/ স্ত্রীর পরকিয়াকে খারাপভাবে দেখে মেয়েটার ক্ষেত্রে হয়েছিল সেই রকম। সে তার স্বামীর এটাকে পরকীয়ার মতই মনে করত, তার স্বামীকে অন্য কেউ ভোগ করছে সে এটাই মনে করত। ঘটনার এই যে মাজেজা ইহা সাকোলজিক্যাল ফ্যাক্ট। আমাদের এই ফ্যাক্ট নিয়ে ভাবতে হবে।

এখানে আরেকটা বিষয় ও খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হল যৌন কাঠামোর আধিপত্যবাদী মানসিকতা, যেহেতে নারী-পুরুষ যৌন প্রকরণ এখানে একটা ডমিনান্ট ফ্যাকটর ফলে সেটা অন্যান্য প্রকরণের উপর তার আধিপত্য খাটাতে চায়। ৪০, ৫০, ৬০ এর দশকে ইউরোপের দেশগুলো এই আধিপত্যকে ভেঙ্গে গেইজম আর লেসবিয়ানিজম প্রতিষ্টা করেছে, পুরো বিশ্ব আগামীতে সেই দিকেই হাঁটবে, নিজেদের অধিকার প্রতিষ্টা করবে, বাংলাদেশে মাত্র তার ডেউ লেগেছে, বাঁধ ভাঙ্গতে সময় দরকার।
 
সবশেষে আসি কাজের কথায়, যারা বলেছেন সমাজে এতো কিছু থাকতে সমকামিতা নিয়ে চিল্লানো ক্যান? তাদের জন্য আমি উত্তরটা প্রথমেই দিয়ে রেখেছি, সমকামিতা বলেন আর যে কোন বিপ্লব বলেন সবই ব্যাক্তির স্বাধীনতার প্রশ্ন, তার মুক্তির প্রশ্ন, তার অস্তিত্বের প্রশ্ন। যারা হাজারো সমস্যার দোহাই দিয়ে সমকামিতা নিয়ে কথা বলতে চান না তারা আসলে অবৈজ্ঞানিক চিন্তা করেন। এই চিন্তাকে বলে রিডাকশনিজম, মানে হল বৌ শিখাতে গিয়ে ঝিয়ের গলা কাটা, দোহাই আপনারা কারো গলা কাটোবেন না, ঝি এবং বৌ দুজনকেই আমাদের বাঁচানো দরকার। কেউ সমকামি হলে তার সেটা করার স্বাধীনতা থাকতে হবে, আমাদের সেটা দিতে হবে। যারা সমকামিতার সমালোচনা করেন তাদের জন্য দুটি উক্তি দিয়ে শেষ করি ।

‘Any Injustice of any corner of the world is injustice for the entire world’ - Matrin Luther King, An American Activist and Leader. হ্যাঁ, আপনাকে অন্যের উপর কোন অবিচার হলে, সে যেখানেই থাকুক না কে, তারা সংখ্যায় যাই থাকুক না কেন, তার পক্ষে কথা বলতে হবে। সবশেষে  ফরাসী  দার্শনিক মহামতি ভলতেয়ারের একটা কথা বলে শেষ করি। ‘I do not agree with what you have to say, but I'll defend to the death your right to say it’. কথাটির বাংলা তর্জমা দাঁড়ায় এরকম, ‘আমি কারো মত মানতে পারি অথবা না পারি কিন্তু দরকার হলে আমি আমার জীবন দিয়ে হলে ও তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করে যাব’। দয়া করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বন্ধ করবেন না, এটা দিয়ে যান, সবার মঙ্গলের জন্যই কাজে লাগবে।

কাজল দাস, অনলাইন এক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ