আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

Advertise

ঈদের পাঞ্জাবি

ফজলুল বারী  

খুব দারিদ্রের মধ্যে আমার শৈশব কেটেছে। পিটিআই সুপারেন্টেন্ড হিসাবে আমার সৎ মানুষ বাবা যখন অবসরে যান তখন আমরা ভাইবোনরা সবাই ছোট। কেউ কর্মক্ষম হইনি। ওই অবস্থায় বাবা’র পেনশনের টাকায় আমাদের বড়বোনকে বিয়ে দেয়া হয়। আর সংসার চালাতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাবা অনেকগুলো টিউশনি করতেন। এমন একটি পরিবারের সদস্য হিসাবে যেখানে তিন বেলা খাবার পাওয়াই ছিল দায় সেখানে ঈদের নতুন জামা বা পাঞ্জাবি পাবার আশা করাটা ছিল বাতুলতা মাত্র।

বাবা’র বদলির চাকরির সুবাদে আমার শৈশব কেটেছে লক্ষ্মীপুর-ভোলা এবং সান্তাহারে। অবসর গ্রহণের পর বাবা যেহেতু কুলাউড়ায় বাড়ি করেন তাই কুলাউড়ার জীবনটায় স্মৃতিপটে ভাসে বেশি। ঈদ যে একটা উৎসব, বন্ধুদের মতো আমারও যে ঈদের একটি নতুন জামা বা পাঞ্জাবি দরকার, এই বোধটি কুলাউড়ার জীবনটাতেই সৃষ্টি হয়। কিন্তু বাবা’র সে সামর্থ্য ছিলোনা। ঈদের পাঞ্জাবি পাবার চিন্তাও ছিলোনা। তবে ঈদের দিন অন্তত একটা নতুন জামা’র চিন্তা থেকে কখনো কখনো বিকল্প একটা পথ বেছে নিতাম। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে পরিচিত নয় এমন কারও থেকে একটি শার্ট একদিনের জন্যে ধার চেয়ে আনতাম। সেটি ধুয়ে মাড় কড়কড় করে শুকিয়ে ভাজ করে রাতে বালিশের নীচে রেখে ইস্ত্রির কাজ সেরে চালিয়ে নিতাম এটি আমার ঈদের নতুন জামা। ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা বিষয়টি বুঝতে পারতো। কিন্তু যেহেতু তারাও আমাদের পরিবারের দারিদ্রের কথা জানতো, তাই চেপে যেতো।

পড়াশুনা, পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমণ শেষে ঢাকায় আমার প্রথম কাজ হয় সাপ্তাহিক বিচিন্তায়। মূলত এ সময়ই সম্পাদক মিনার মাহমুদের উপহার দেয়া দামী কাপড়চোপড় প্রথমে আমার গায়ে ওঠে। এর আগের পুরো শিক্ষা জীবন জুড়েই ছিল এক বা দুটি শার্ট-প্যান্টের জীবন। এ কাপড়গুলোর বেশিরভাগও নানাবাড়ি থেকে উপহার হিসাবে পাওয়া। কিন্তু তখনও ঈদে নতুন জামা বা পাঞ্জাবি কেনার কোন আদিখ্যেতা অথবা ঝোঁক তৈরি হয়নি।ঢাকায় বিচিন্তা অফিসে আমরা একদল তরুণ রিপোর্টার থাকতাম। ঈদে চেষ্টা করতাম বিচিন্তার বন্ধুদের আমার গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাবার। বিচিন্তার বন্ধুদের অনেকে এভাবে আমার সঙ্গে প্রথম সিলেটে গেছেন।

মূলত ওই সময়েই আমি পরিবারের সদস্যদের ঈদের কাপড় কিনে দিতে শুরু করি। কিন্তু কখনো নিজের জন্যে কিছু কিনতাম না। কেনো জানি ইচ্ছাও করতোনা। ঈদের দিন নামাজে যাবার আগে বড় ভাই তার একটি পাঞ্জাবি পরতে দিতেন। নামাজ শেষে বাসায় ফিরে সেটি খুলে রেখে আমার শার্ট-প্যান্ট পরেই বেরিয়ে যেতাম বন্ধুদের আড্ডায়। কুলাউড়ায় আমাদের ঈদের আড্ডা মানেই ছিল

বুলবুল-লাভলু-পারভেজ-নাসির-নীলু-ফয়সল-মুহিত-মন্টু-শাহীন--সজল-মৃণাল-আশিষ-দীপক সহ আরও অনেককে নিয়ে সময় কাটানো। ঈদের ভালো খাওয়াদাওয়া তাদের বাসা-বাড়িতেই হয়ে যেতো। সাংবাদিকতায় কিছুটা নামডাক হবার পর ঈদে বাড়ি গেলে মাসুম-ইসহাক-অলোক-সঞ্জয়সহ একদল জুনিয়র গ্রুপ আমার সঙ্গে সর্বক্ষণ ঘুরে বেড়াতো। সিলেট গেলেই তেমন একজন অনিবার্য বন্ধু আরজু আলী। কুলাউড়ায় আমাদের শৈশবের ঈদ মানে ছিল লিলি আর পূবালী সিনেমা হলে সিনেমা দেখা। নাসির-মুহিবের বাসায় টিভি দেখা। শৈশবে আমাদের বাড়িতে টিভি ছিলোনা। বিদ্যুৎ’ও না। কুপির আলোয় পড়ে পড়ে কেটেছে আমার প্রাইমারী-হাইস্কুল এবং কলেজ লাইফ।

আমি প্রথম ভালো বেতনে কাজ করা শুরু করি জনকণ্ঠে। এই পত্রিকার হয়ে দেশেবিদেশে রিপোর্ট করে করে ফজলুল বারী হিসাবে আমার বিকাশ ঘটেছে। নানান বিদেশ ট্যুরে গেলে টাকা বাঁচিয়ে আমি অফিসের দেড়-দু’শো লোকের জন্যে উপহার কিনে আনতাম। জনকণ্ঠের রিপোর্টিং টিমেও জুনিয়ররা ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ঈদে তাদের নতুন জামা কিনে দেবার চেষ্টা করতাম। তাদের একজন আমাকে একবার এক ঈদে সোনালী রঙের একটি সিল্কের পাঞ্জাবি কিনে দেন। সঙ্গে কারুকাজ করা সোনালী বোতাম। এটিই আমার জীবনে পাওয়া প্রথম সবচেয়ে দামী ঈদ গিফট। এই পাঞ্জাবিটা আমি ধারাবাহিক অনেক ঈদে পরেছি। ঈদের পর প্যাকেট করে রেখে দিতাম। পরের ঈদের আগে লন্ড্রিতে দিয়ে প্রতিবার সেটি হয়ে উঠতো আমার ঈদের ঝকমকে নতুন পাঞ্জাবি। এই পাঞ্জাবিটা এখনও আমার সংগ্রহে আছে। বিদিশা যখন এরশাদের স্ত্রী তখন এক ঈদে আমার জন্যে একটি পাঞ্জাবি পাঠিয়েছিলেন। এরশাদ বিতর্কের কারণে সে পাঞ্জাবিটা তখন আমি গ্রহণ না করে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। জনকণ্ঠের তখন একটি জনপ্রিয় বিভাগ ছিল রিপোর্টারের ডায়েরি। সে পাঞ্জাবি গ্রহণ না করার কারণ উল্লেখ করেছিলাম সেই রিপোর্টারের ডায়েরিতে। সে কারণে তখন রাজনীতির অনেক পাঠকেরা বিষয়টি জানেন।

এখন আমার বিদেশে অন্য এক পরিশ্রমী সচ্ছল জীবন। নিজে ঈদের পাঞ্জাবি না কিনলেও সারা বছর দেশ থেকে যত পাঞ্জাবি আসে সেগুলোর কোন একটি ঈদের দিন পরে নেই। আমাদের আসলে ঈদ, পহেলা বৈশাখের মতো দিন ছাড়া কখনও পাঞ্জাবি পরাও হয়না। দেশ থেকে যত পাঞ্জাবি আসে এগুলোর কোনটি থাকে বেশি বড়, কোনটি বেশি ছোট। কোনটি আবার রঙের কারণেও পরা হয়না। এবারও ঈদের দিন পরার জন্যে পাঞ্জাবির সংগ্রহ থেকে পুরনো একটি পাঞ্জাবি বাছাই করে রেখেছি। আমার আবার সাদা বা পাঞ্জাবির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে পরার মতো পাজামা না থাকায় জিনসের প্যান্টই পরি। শীতের কারণে আমাদের পাঞ্জাবির সঙ্গে স্যান্ডেল পরা হয়না। এসব নিয়ে কেউ এখানে অবশ্য কাউকে জিজ্ঞেসও করেনা। জিজ্ঞেস করলে মজা করে বলে পাঞ্জাবির সঙ্গে পাজামা-স্যান্ডেল পরতেই হবে এ কথাতো সংবিধানে লেখা নেই।

এখনও ঈদে নিজের জন্যে পাঞ্জাবি বা নতুন কিছু কিনিনা। পরিবারের সদস্যদেরও ঈদে নতুন কিছু কিনে দেইনা। যার যখন যা দরকার হয় তাতো সারাবছরই কিনে দেয়া হয়। তবে ঈদটাকে এনজয় করতে প্রতিবছর একটা কাজ করি আমি। দেশে প্রিয়জনদের অনেককে ঈদে পাঞ্জাবি পাঠানোর চেষ্টা করি। চট্টগ্রামে এবার সবাইকে এক রঙের পাঞ্জাবি দিতে কাপড় কিনে সেখানে তা দর্জি দিয়ে সেলাই করানো হয়েছে। এ কাজের আয়োজনে  আমাকে  সেখানে সহায়তা দিয়েছেন অনুজ এক প্রখ্যাত সাংবাদিক। আমার যতো মামাতো-চাচাতো বোন-ভাবী আছেন তাদের প্রতি বছর আমি ঈদে কাপড় দেবার চেষ্টা করি। ভাই হিসাবে এটিকে আমি আমার বার্ষিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসাবে দেখি। আমেরিকা-ব্রিটেনের আত্মীয়স্বজনকে দেবার চেষ্টা করিনা। ডলারগুলো যেখানে টাকা হয় সেখানে অল্পতে অধিক আনন্দ কেনার যে সুখ তা বলে বা লিখে বোঝানো যাবেনা। ঈদ মুবারক।

ফজলুল বারী, প্রবাসী সাংবাদিক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ