প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ১৮ জুলাই, ২০১৯
বাঙালি এত মহান, এরশাদের মৃত্যু না হলে জানাই হতো না! একদা বাংলাদেশে এরশাদ নামে কোন স্বৈরাচারী শাসক ছিল এই ইতিহাস হয়তো এক প্রজন্ম পরে কেউ আর জানতে পারবে না। সাবেক সেনাশাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে পত্রিকাগুলোর শিরোনাম যদি কেউ দেখেন সেই ধারণা পেয়ে যাবেন। অথচ ব্রিটেন সহ বিশ্ব গণমাধ্যমে তার মৃত্যু সংবাদগুলোর শিরোনামে স্বৈরাচারী হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, কলামিস্ট টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সবাই দেখলাম এরশাদবন্দনায় ব্যস্ত।
পতিত স্বৈরাচার এরশাদ বাংলাদেশে এতো জনপ্রিয় ছিলেন, তার মৃত্যু না হলে সেটা আসলেই জানা হতো না।
সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যখন শোক প্রকাশ করে পোস্টারিং করে, প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রীয় নিয়মে শোক বাণী দিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে দিতে হয়তো বাধ্য। কিন্তু ছাত্রলীগ বা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী কি আদৌ বাধ্য শোকবার্তা দিতে? ৭৫-এর ১৫ আগস্টে জাতির জনকের হত্যার পর রাত পোহাতেই ভারত ট্রেনিং থেকে বাংলাদেশে ছুটে এসেছিলেন এরশাদ, খুনিদের সাথে হাত মিলাতে। বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনি মেজর ডালিম ও নূর হোসেনের সাথে মাঝখানে বসা হাস্যজ্বল এরশাদের ছবিটি অন্তর্জালে আছে, একবার দেখে নিতে পারেন।
জাতির জনকের খুনি কর্নেল ফারুককে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করেছিল এরশাদ। আরেক খুনি বজলুল হুদাকে সংসদে নিয়ে এসেছিলেন এরশাদ। চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার জনসভায় গুলি করে ২৪ জন লোককে হত্যা করেছিল এরশাদ সরকার। এই কথাগুলো গণমাধ্যম বলছে না। এনটিভির এক সাংবাদিক তো এরশাদের জন্মস্থানই বদলে দিয়েছেন। এরশাদকে নিয়ে করা তাদের সংবাদে ভারতে জন্ম নেয়া এরশাদের জন্মস্থান রংপুর বলে উল্লেখ করেছেন।
মানুষ মরে গেলে লাশ হয়ে যায়। লাশের উপর কারো ক্ষোভ থাকার কথা নয়। কিন্তু মৃত্যু মানেই সব শেষ নয়। কোন কোন মৃত্যু জীবনের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে যায়। আসাদ থেকে মিলন বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় উদাহরণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবাই দেখলাম এরশাদের আত্মার শান্তি কামনা, তার জান্নাত কামনা করছেন তাকে ক্ষমা করে দেয়ার কথা বলছেন। গোলাম আযম সহ যুদ্ধাপরাধীদের কি একদিন এইভাবেই ক্ষমা করে দিতে বলবেন?
‘বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম’ শীর্ষক বইয়ে (আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৩) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘ময়েজ উদ্দিন, তিতাস, রমিজ, বসুনিয়া, চুন্নু এমনি হাজারো আত্মাহুতির প্রয়োজন হলো গণতন্ত্রের জন্য, অধিকার লড়াইয়ে। উদাম নূর হোসেন যেদিন বুকে-পিঠে “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক” লিখে জীবন্ত পোস্টার আর সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ হয়ে আমাকে সালাম করে বলল, “আপা, আমাকে দোয়া করবেন”। ভীষণভাবে আঁতকে উঠেছিলাম আমি। আতঙ্কে চিৎকার করে বলেছিলাম, “শার্ট পরো এই ছেলে, শার্ট পরো।” বারণ মানেনি সেদিন বীরপ্রসূ বাংলার বীর সন্তান নূর হোসেন। এগিয়ে গিয়েছিল সামনের দিকে। তার এ অগ্রযাত্রা ছিল হয়তো গণতন্ত্রের দিকে। কিন্তু সামরিক স্বৈরাচারের বন্দুকের গর্জনে ঢলে পড়েছিল নূর হোসেন। ঘাতক বুলেট নিথর, নিস্পন্দ, স্তব্ধ করে দিয়েছিল সেই সচল প্রতিবাদকে। সেই জীবন্ত গণতন্ত্র প্রেমিক পোস্টারকে। ডা. মিলন, শিশুকে স্তনদানরত গৃহবধূ হাসিনা বেগম। আরও কত নাম বলব! মৃত্যুর ফিরিস্তি সৃষ্টি করতে করতে এখন ক্লান্ত আমি। আর পারি না। অ্যাতো মৃত্যু, অ্যাতো রক্ত!’ (পৃ. ৮৫-৮৬)
এরশাদ প্রসঙ্গে অনেকেই আওয়ামী লীগকে টেনে নিয়ে আসেন, আওয়ামী লীগ তার ভোটের রাজনীতিতে কাকে জোটে নিলো, বা কাকে ত্যাগ করলো, সেটা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। শুধু তো জাতীয় পার্টি নয়, কট্টর বাম দলকেও সাথে নিয়েছে, তাই বলে আওয়ামী লীগ কি দল হিসাবে তাঁদের আদর্শ বা নীতি লালন করে? করেনা। রাজনৈতিক হিসাব নিকাশ না হয় বাদ দিলাম।
বলা হয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায় রাজনৈতিক দলগুলো। পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র বিচিত্র এক জাতি, যারা ২৫ মার্চ এলে শোক করি, ২১ এলে প্রভাতফেরী করি, গণতন্ত্রের কথা বলি, নূর হোসেন দিবস পালন করি, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ চেতনার কথা বলি, আবার গোলাম আযম, কাদের মোল্লাহ কামরুজ্জামানকে শহীদ মানি, তাদের স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পর তাদের ক্ষমা করার ইচ্ছা প্রকাশ করি। আমাদের দেশই একমাত্র দেশ যে দেশে দেশবিরোধীরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসার সুযোগ পায়, পতিত স্বৈরাচার, বহাল তবিয়তে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়। মৃত্যু পরবর্তী সব ভুলে গিয়ে তাকে মহান করে তুলি। তাই দোষ আওয়ামী লীগের নয়, আমরা সাধারণ মানুষ তাকে মেনে নিয়েছি বলেই, এরশাদের রাজনৈতিক বেঁচে থাকাও সাধারণ জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন।
অনলাইনের বদৌলতে আমাদের প্রজন্ম ১৯৮৯ সালের শিরোনাম ইত্তেফাক পত্রিকার শিরোনামটি দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে। এরশাদের মাথায় টুপি পরা, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ থেকে চুরি করে মেরে দেন, এবারের সংগ্রাম দেশকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার সংগ্রাম.. সেই কাজটা তিনি ভালভাবেই সম্পন্ন করেছিলেন। যদিও গুলশান ক্লাব তার মৃত্যুতে এরশাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে কিছু সময়ের জন্য মদ বিক্রি বন্ধ রেখেছিল বলে একটা নোটিশ দেখেছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এরশাদ এবং পাকিস্তানের জনক কায়েদে আজম জিন্নাহর প্রচণ্ডরকমের মিল। দুইজনই ব্যক্তিগত বিশ্বাসে ধর্মের ধারেকাছেও ছিলেন না। কিন্তু ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেছেন প্রচণ্ডরকমের। এরশাদ যেমন পীর পুষতেন অন্যদিকে নাকি পতিতাও পুষতেন বলে প্রচলিত আছে ।
হুমায়ুন আজাদ এরশাদ চরিত্র নিয়ে খুব স্পষ্টভাবে লিখেছিলেন, এরশাদ ছিলো একটি চরম নষ্ট একনায়ক, সে পেয়েছিলো সমানে সমান নষ্ট এক সহধর্মিণীকে, সংগ্রহ করেছিলো অসংখ্য নষ্ট নারী, এবং অজস্র নষ্ট দাস। বাংলাদেশের পুরুষরা আগে থেকেই দূষিত ছিলো, এরশাদ দূষিত ক'রে গেছে এমনকি নারী ও কবিতাকে।সে বাংলাদেশের চরিত্রটিকেই নষ্ট ও দূষিত ক'রে গেছে। বাঙলাদেশে একটি সৎ মানুষ পাওয়াই দুর্লভ হয়ে উঠেছে। অত্যাচার ও চরিত্রহীনতায় সে ছিলো অতুলনীয়; শিল্পী কামরুল হাসান তাকে ব'লে গেছেন "বিশ্ববেহায়া"। এ- নামও সম্ভবত তার জন্য প্রশংসা।
কোন শব্দই তার স্বৈরাচার, ভণ্ডামো, দুর্নীতি ও চরিত্রহীনতাকে প্রকাশ করতে পারে না। তাকে কি বলবো 'ছোটখাটো ক্যালিগুলা', ছোটোখাটো চেংগিশ', নাকি নিতান্তই 'আপাদমস্তক ইতর'? খলতা, ভণ্ডামো, ভাঁড়ামো, নারীলিপ্সা, চরিত্রহীনতা, অভিনয়, দুর্নীতিতে এরশাদ তুলনাহীন, সে গোপাল ভাঁড় ও ক্যাসানোভা ও জল্লাদের এক তিক্ত মিশ্রণ। এমন কোন কোন অপরাধ নেই যা সে করে নি, এমন কোন পদ্ম নেই যা সে দূষিত করে নি, এবং সে আমাদের প্রচুর মজাও দিয়েছে। ধর্ম থেকে কবিতা পর্যন্ত সবকিছু সে নষ্ট করে। হয়তো সে ছিল মনোবিকলনগ্রস্তও, অস্বভাবী- সন্তান জন্ম দিতে না পারার ব্যর্থতা তাকে পাগলে পরিণত করেছিলো।
চেঙ্গিস খাঁও ছিল নপুংসক, এটা তাকে হিংস্র করে তুলেছিলো।" (হুমায়ূন আজাদ - আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম)
অতীত বাদ দিলে বাকি থাকে কি? তোফায়েল আহমেদ কিংবদন্তি ছাত্রনেতা, তিনি যখন এরশাদের প্রশংসা করেন! তখন বাকরুদ্ধ হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা। সর্বশেষ নির্বাচনী হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এরশাদের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা ছিল। এর মধ্যে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে চারটির কার্যক্রম স্থগিত ছিলও একই অভিযোগে তেজগাঁও থানার আরও একটি মামলা ঢাকার সিএমএম আদালতে বিচারাধীন ছিল এবং চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় বহুল আলোচিত মঞ্জুর হত্যা মামলা বিচারাধীন ছিল।
আমরা আলোচনা করছি এরশাদের সম্পত্তি কার অংশে কতোটুকু পড়ল, রওশন কি পেলেন আর বিদিশা কি পেলেন না। কিন্তু কেউ প্রশ্ন তুলিনি একজন সেনা কর্মকর্তার এতো সম্পত্তির উৎস কী। বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত সেনাঅফিসার মঞ্জুর হত্যার বিচার কেন দ্রুত হয়না। কেউ না কেউ কখনো এই দাবিগুলো জানাই নি।
অনেকেই এরশাদের হামলা-মামলা আর পুলিশী নির্যাতন সইতে না পেরে দেশান্তরীও হয়েছিলেন সেই সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতারা দেশে জেল জুলুম খেটেছেন অনেকে। এমন দুইজন মানুষই দেখলাম উল্লেখ করেছেন এরশাদকে ক্ষমা করে দিতে।
মিনহাজ গাজী হবিগঞ্জ অঞ্চলের তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেন, এরশাদের মৃত্যু পরবর্তী তার ফেসবুকে লিখেছেন, এরশাদ শাসনামলে আমার জীবন অনেক ওলট-পালট হয়েছে। আমি অনেক নিগৃহীত হয়েছি, নির্যাতিত হয়েছি, কারারুদ্ধ হয়েছি। রাষ্ট্রীয় অপরাধী হিসাবে তাকে দণ্ডিত করা যায়নি, তিনি বরং সম্মানিতই হয়েছেন! ফলে বেশ আগেই আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
প্রিয় সহযোদ্ধারা; ওঁকে ক্ষমা করুন! ক্ষমা করে বড় হোন। গণতন্ত্রের লড়াইয়ে আমরা বিজয়ী। আমাদের স্বপ্নভঙ্গের জন্য এরশাদ দায়ী নন। যারা দায়ী-তারা অনেক বড় অপরাধী ।
কিন্তু আমরা মানুষ হিসাবে, এরশাদের লাশকে ক্ষমা করে দিলেও ইতিহাস ক্ষমা করবে না। তাই গণমাধ্যম কিংবা ইতিহাস রচয়িতা যারা, তাদের নৈতিক দায়িত্ব ইতিহাসের জন্য সত্যলিপি লিখে রাখা।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য