আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

Advertise

ডেঙ্গুর দিনগুলিতে রবীন্দ্রচর্চা

মাসকাওয়াথ আহসান  

গত একসপ্তাহের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দেখলে মনে হবে না ডেঙ্গু আক্রান্ত জনপদে উপায়হীন মৃত্যুর অপেক্ষায় অসহায় মানুষ। বরং মনে হবে কোথায় এক ভিডিওতে কে একজন 'জাতীয় সংগীত অনুভূতি'তে আঘাত দিয়েছে; সেটাই প্রথম এবং প্রধান সমস্যা।

ভারতে যে শিবসেনা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ভারতের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের বৃথা সংকল্প নিয়ে ঘুরছে; সেই শিবসেনাই আবার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের অবাস্তব প্রলাপে 'জাতীয় সংগীত' অনুভূতিতে আহত হয়ে আহাজারি জুড়ে দেবার ব্যাপারটা বেশ বিনোদন দিয়েছে। আর শিবসেনার যমজ ভাই শিবির এসে যোগ দিয়েছে 'কলতলার' রবীন্দ্রনাথ বিতর্কে। এখন এই যে শিবসেনা ও শিবিরের কাইজ্জার দিনরাত্রি; এটা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার হাজার বছরের ঐতিহ্য।

যে কোন সুস্থ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগবে; ডেঙ্গুতে মানুষ মরছে; এই খরখরে বাস্তবতা বাদ দিয়ে কাল্পনিক 'রবীন্দ্রনাথ বিতর্ক' আর 'জাতীয় সংগীত অনুভূতি'তে আঘাতের বিষয়টি এতো প্রধান হয়ে দাঁড়ালো কীভাবে! এইতো হয় এখানে, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো ছেড়ে কাল্পনিক বিষয়াদি নিয়ে কাইজ্জা করে করেই তো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো আজ 'দোজখ'-এ রূপান্তরিত হয়েছে।

প্রায়োরিটি বা অগ্রাধিকার বুঝতে না পারাটাই যে অসভ্যতা। আপনার মনে হতে পারে কেবল শিবসেনা আর শিবিরই তো নয়; অনেক শিক্ষিত মানুষকেও তো এই অলীক বিতর্কে তাপিত হতে দেখলাম। এটা শৈশবের চুলকানি থেকে ধারাবাহিকভাবে শরীরে বাসা বাঁধা রোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট, সংস্কৃতি সভায় মাথা দোলানো, হজ বা তীর্থ যাত্রার আত্মার পরিশোধন প্রক্রিয়ায়ও এ রোগ যাবার নয়।

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিটি শিশু তাদের সামনে বড়দের অবসর যাপন মানেই পরচর্চা করতে দেখেছে। প্রতিবেশি ইঁচা মাছ খেয়েছে নাকি রুইমাছ খেয়েছে তাই নিয়ে রগড় যাদের বিনোদন সংস্কৃতি; তারা গ্রিস ঘুরতে গিয়ে ফেসবুকে এথেন্সের ছবি দিয়ে সাক্ষাত সক্রেটিস হিসেবে হাজির হলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় কোন পরচর্চা দেখলে ভ্রমণ বাদ দিয়ে হোটেলে ফিরবে; ভালো ইন্টারনেট স্পিড পেলে ঝগড়া জমবে ভালো; এই হচ্ছে শেকড় সঞ্জাত টানাপড়েন।

প্রতিবেশীর সঙ্গে তুলনামূলক জীবন যাপন, প্রতিবেশীর সমালোচনা; এই হচ্ছে দক্ষিণ এশিয় কমপ্লিট কোড অফ লাইফ। সেইখানে হিন্দু-মুসলমান প্রতিবেশি মানে সোনায়-সোহাগা; ওটা শিবসেনা বনাম শিবিরের যুদ্ধে রূপান্তরিত হতে বাধ্য। এই প্রতিবেশিরা কাইজ্জার দিনরাত্রিতে এতো ব্যস্ত যে; এদের বাসায় অবাধে এডিস মশা বাসা বাঁধতে পারে। ডেঙ্গুর কামড় খেয়ে মরতে মরতেও 'এইডা তোর দোষ; না এইডা তোর দোষ বলে' কাইজ্জা করতে থাকবে।

এমনকি অনাবাসে শরণার্থী হয়ে এসেও সুখ সহ্য হয় না দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের। হয় অমুক সমিতি, তমুক সমিতি বানিয়ে কাইজ্জা; কিংবা হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের সমালোচনা; এই হচ্ছে অবসর বিনোদনের প্রধান উপাদান।

এই যে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের যে স্বভাব; সেখানে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিভাজন খোঁজা কান নেয়া চিলের পিছে দৌড়ানোর মতো। কেউ কারো ভালো চায় না যেখানে; শুধু নিজে ভালো থাকতে চায়; সেই কাঁকড়া সভ্যতার মানুষের জীবনে পরমতসহিষ্ণুতা, অহিংসা, অসাম্প্রদায়িকতা; এগুলো খুব ভারি ভারি শব্দ। কেউ কেউ আয়াত কিংবা মন্ত্র উচ্চারণের মতো এসব ভারি ভারি শব্দের ডালি নিয়ে হাজির হন। কিন্তু সব নৈতিকতাই ঠোঁটে রয়ে যায়; হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছায় না।

এতো হিংস্র কাঁকড়া মানস যে সমাজে উপস্থিত; সেখানে ঘৃণা-বিদ্বেষ-বিভাজন ছড়ানোটাই ব্যবসার সবচেয়ে বড় উপাদান। সেই ব্যবসা করেই এ উপমহাদেশে ধন-সম্পদ অর্জন সম্ভব; সম্পদ লুণ্ঠন করে পশ্চিমে সেকেন্ড হোম তৈরি সম্ভব। এটাকে কাঁকড়ার বাচ্চার অর্থনীতিও বলা যায়।

আজকের বাণিজ্য বাস্তবতায় কাঁকড়াদের জন্য শিবসেনা ও শিবিরের উস্কানি আছে; কট্টরপন্থী ইসলামিক স্টেট বনাম কট্টরপন্থী হিন্দু স্টেটের উন্মাদনা আছে। ফলে মানুষের জীবন এখন সবচেয়ে ঝুঁকিতে এই উপমহাদেশে।

যারা কট্টরপন্থী ইসলামিক স্টেট বনাম কট্টরপন্থী হিন্দু স্টেটের মানসিক উন্মাদনার উস্কানিতে উত্তপ্ত হবে; তারা অসভ্যতার চোরাবালিতে নিমজ্জিত হবে। জোনাথন সুইফটের গালিভারস ট্রাভেলস-এর লিলিপুটিয়ান ও ব্লেফুসকুডিয়ানদের মতো একটা ডিমের সামনের না পেছনের দিক থেকে ভাঙ্গলে সঠিক হবে; তাই নিয়ে নিরন্তর কাইজ্জার আড়ালে হারিয়ে যাবে অসংখ্য জীবন।

অলীক অনুভূতির বিতর্ক যখন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়; বাস্তব সংকট আড়াল করে; তখন দক্ষিণ এশিয় কাঁকড়া মননকে প্রত্যাখ্যান করে; যৌক্তিক চিন্তা করে; মাথা ঠাণ্ডা রেখে যারা মানবিক সংকট মোকাবেলায় স্থিতধী থাকতে পারবে; তারাই অতিক্রম করবে সভ্যতার পরীক্ষা।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ