আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

আ ন ম শফিকুল হক: ভালোবাসা প্রিয় নেতা

এনামুল হক এনাম  

নিজেই হাস্যরস করে বলতেন, “৩০ বছর জেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বে; কখনো ভারপ্রাপ্ত, কখনো নির্বাচিত”। বলছি আমাদের আমাদের নেতা আ.ন.ম. শফিকুল হক ভাইয়ের কথা। দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে আজ (১৪ আগস্ট) শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন।

মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ভাড়া বাসায় থেকেছেন। স্থাবর অস্থাবর কোন সম্পদ নেই, নামেও নেই, বেনামেও নেই। আছে শুধু গ্রামের পৈত্রিক সম্পত্তি। নেতা হিসেবে আলোচনা, সমালোচনা করতেই পারেন, কিন্তু একজন সৎ, সত্যনিষ্ঠ, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানবিক মানুষ হিসেবে তিনি সিলেটের রাজনীতিতে অদ্বিতীয়, অম্লান ছিলেন, থাকবেন আজীবন।

সিলেট ছোট শহর, আমরা সবাই জানি আওয়ামী লীগ করে কে কী করেছেন। কিন্তু শফিক ভাই! সারা জীবন শুধু আওয়ামী লীগকেই দিয়ে গেছেন।

এক বিখ্যাত নেতা সম্পর্কে শফিক ভাই আফসোস করে বলেছিলেন, "তারে আমি ধরে এনে নেতা বানালাম, পোস্ট দিলাম, নেত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম, সিলেটের মানুষ তারে এখন এক নামে চিনে.... অথচ আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ভারত যাওয়ার সময় সে দেখা করতেও আসেনি! সে কি মনে করেছিলো ভারত থেকে আমার লাশ ফিরে আসবে!!"

বর্ষীয়ান নেতা আ ন ম শফিকুল হকের রয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। ছাত্রজীবন থেকেই সরাসরি আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত। ১৯৭১সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাঠপর্যায়ে সংগঠকের কাজ করেছেন নিরলস ভাবে। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী সীমান্তের ওপারে ট্রেনিং-এ মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানো থেকে শুরু করে সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মিটিং করেছেন, জনমত তৈরি করেছেন, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং ঢাকার সাথে সর্বাত্মক যোগাযোগও রক্ষা করেছেন একই সময়ে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যে কয়জন উঠতি নেতার নাম বঙ্গবন্ধু স্মরণ করতেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আমাদের শফিক ভাই। প্রায়ই শফিক ভাই নিজেই বলতেন, “আমি আব্দুস সামাদ আজাদের রাজনীতি করেছি, আমি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি করেছি...”। আ ন ম শফিকুল হক ভাইয়ের কাছে রাজনীতিতে হাতেখড়ি এমন জনাবিশেক নেতাই আজ সিলেটের আওয়ামী লীগ চালাচ্ছেন।  
 
আ ন ম শফিক ভাই শিক্ষকতা দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন। প্রচুর বই পড়তেন, তাঁর ঘরে গেলেই দেখা যেত রাজনীতি, দর্শন আর যুক্তিবিদ্যার বইয়ে ভর্তি শোকেস। বলতেন, বইই আমার অন্তরচক্ষু খুলে দিয়েছে। আমি ভালমন্দের তফাৎ বুঝি, সত্য মিথ্যা বুঝি, রাজনীতি বুঝি, দুর্বৃত্তায়ন বুঝি বই পড়ার কারণেই। অসুস্থতার সময়ে শফিক ভাইকে কিছু বই উপহার দিয়েছিলাম, তিনি বইগুলোর দিকে অশ্রু সজল চোখে তাকিয়ে ছিলেন, জেনেছিলাম কারণতা অসুস্থতা, বই পড়তে পারেন না। আপনারা তো অনেক নেতাকে চিনেন, ক’জন নেতার বাসায় সারি সারি বই সাজানো থাকে, ক’জন নেতা বই পড়তে ভালবাসেন?

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে আওয়ামী রাজনীতি যখন প্রায় নিষিদ্ধ ছিল এবং আশির দশকে দল যখন ক্রান্তিকাল পার করছিলো, তিনি দল সংগঠনের কাজ করেছেন মাঠ পর্যায়ে, নির্ভয়ে। প্রধানমন্ত্রী সিলেট শহরে তখন একজন নেতাকেই চিনতেন, ভালবাসতেন, বিশ্বাস করতেন, তিনি আমাদের শফিক ভাই। সেই সময়ের ছবিগুলোই বলে দেয় নেত্রী আর আব্দুস সামাদ আজাদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা কত গভীর আর আপন ছিল।

ছাত্রলীগ নেতা আলী আহমদ ভাই স্বাধীনতা বিরোধী চক্র দ্বারা বোমায় আহত হলে, গভীর রাতে শফিক ভাইই কোলে করে হাসপাতাল নিয়ে গিয়েছিলেন। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ছাত্র, সৌমিত্র দাদাকে স্বাধীনতা বিরোধী চক্ররা যখন কুপিয়ে ব্লু-বার্ড স্কুল সংলগ্ন এলাকায় ফেলে যায়, কেউই ভয়ে এগিয়ে আসেনি। তখন আমাদের শফিক ভাই সৌমিত্র দাদাকে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যান, কেউ মামলা করতে রাজি হচ্ছিলো না ব্যক্তিগত ক্ষতির ভয়ে, এই শফিক ভাইই সেদিন মামলার ব্যবস্থা করে দেন। হাজারো স্মৃতি শফিক ভাইকে নিয়ে।

শ্রদ্ধেয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ মারা যাবার পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ে আ ন ম শফিকুল হককে নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয় সিলেট থেকে, ঢাকা গিয়ে শফিক ভাইয়ের নামে একের পর এক নালিশ, শীর্ষ নেতাদের শফিক ভাই সম্পর্কে খেপিয়ে তুলতে কারা কলকাটি নেড়েছেন শফিক ভাই তাদের ভাল করেই চিনতেন, কিন্তু কখনোই মুখ ফুটে অভিযোগ করেননি, রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে যাননি। কে কোথায়, কিভাবে নেতা হয়েছেন বা হচ্ছেন সেই খবর ঢাকা থেকে আসতো শফিক ভাইয়ের কাছে। শফিক ভাই শুধু হাসতেন, বলতেন, আমার সময় আমি পার করে এসেছি, রাজনীতি করেছি, আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছি, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি করেছি, রাজা হতে চাইনি... চেয়েছি প্রিয় দল ক্ষমতায় আসুক, মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হোক। জীবনের শেষাংশে ব্যক্তির ভাগ্য পরিবর্তনের গ্রাফ দেখে নীরবে কাঁদতেন, এই আওয়ামী লীগ আমরা চাইনি, এই আওয়ামী লীগের জন্য রাজনীতি করিনি। এত নিরাশার মাঝেও তাঁর একমাত্র আশার স্থল ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি কেন জানি বিশ্বাস করতেন নেত্রীর কাছে জাদুর কাটি আছে, সেই কাটির ছোঁয়ায় সব পরিবর্তন হয়ে যাবে।   
         
আ.ন.ম. শফিক ভাই আমার নেতা, প্রতিবেশী ছিলেন দুই যুগেরও বেশি সময়। নেতার মত অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, মুক্তমনা মানুষ আমি কমই দেখেছি। চলে গিয়ে ভালই করেছেন, হালুয়া রুটির নষ্ট রাজনীতি আর পথভ্রষ্ট তথাকথিত নেতারা বহু আগেই আপনাকে খুন করে ফেলেছিল।

খুব বেশি মিস করবো আপনার স্পষ্ট ভাষী ভাষণ আর 'ইন্টেলেকচুয়াল' রাজনৈতিক চরিত্র।  বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতের জাদুর কাটির ছোঁয়ায় বদলে যাক প্রিয় বাংলাদেশ, আ ন ম শফিকুল হকের স্বপ্নের বাংলাদেশ। ভালবাসা আর শ্রদ্ধা প্রিয় নেতা।

এনামুল হক এনাম, কলামিস্ট, সাহিত্যিক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ